নন্দীগ্রাম আসলে যা ঘটেছিল #১৬: কালো প্যান্ট, গেঞ্জি, কাঁধে রাইফেল! সোনাচূড়া মোড়ে সিপিআইএম বাহিনী এলাকা পাহারা দিচ্ছে

আগের পর্ব যেখানে শেষ হয়েছিল: ২০০৭ সালের ১০ নভেম্বর মহেশপুরে গুলি চালিয়ে নন্দীগ্রাম পুনর্দখল সম্পূর্ণ করল সিপিআইএম। বিকেলে মেচেদার মোড়ে রাস্তা অবরোধ করে আমাকে আটকে দিল সিপিআইএম……

 

১০ নভম্বর ২০০৭, সন্ধ্যা হয়নি তখনও, কোলাঘাট পেরিয়ে মেচেদার মোড়ে সিপিআইএমের অবরোধে আটকে পড়লাম। সেই ৩ জানুয়ারি থেকে নন্দীগ্রামে যাচ্ছি, একাধিকবার তৃণমূল কংগ্রেস এবং সিপিআইএমের বিক্ষোভ, অবরোধের মুখোমুখি হওয়ার অভিজ্ঞতা হয়েছে আমার। কিন্তু এতদূরে মেচেদায় অবরোধ কখনও দেখিনি। এ তো কার্যত পূর্ব মেদিনীপুর জেলাতেই ঢুকতে বাধা দেওয়া। কিছু ছেলে জোর করে গাড়ি ঘুরিয়ে নিতে বলছে। বুঝলাম ওই মুহূর্তে আর এগনো যাবে না। গাড়ি ঘুরিয়ে কোলাঘাটের শের ই পাঞ্জাব ধাবার উল্টোদিকে রাস্তার ধারে গিয়ে দাঁড়ালাম। তখনও নিজের উপর বিশ্বাস ছিল, সিপিআইএমের নেতাদের ফোন করে নন্দীগ্রাম পর্যন্ত যেতে পারব। রাস্তায় দাঁড়িয়ে ফোন করলাম লক্ষ্মণ শেঠকে। কিন্তু তমলুকের সাংসদ ফোন ধরলেন না। ভাবছি আর কাকে ফোন করব।

কিছুক্ষণ পরেই খবর পেলাম, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতা থেকে রওনা দিচ্ছেন নন্দীগ্রামে যাবে বলে। সঙ্গে সঙ্গে এসএমএস করলাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। ‘আপনি কি নন্দীগ্রামে আসছেন? এখানকার অবস্থা খুব খারাপ। আমাদের আটকে দিয়েছে সিপিআইএম।’ ১৫-২০ মিনিট কোনও উত্তর নেই। তখন সন্ধে প্রায় সাড়ে ছ’টা। কোলাঘাটে রাস্তায় পায়চারি করছি, আর একে-ওকে ফোন করছি। প্রায় আধ ঘন্টা বাদে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গাড়ি থেকে আমাকে ফোন করলেন তৃণমূল নেতা শোভন চট্টোপাধ্যায়।

‘বিতনু, ওখানে কী অবস্থা, তুই এখন কোথায়?’

‘কোলাঘাটে দাঁড়িয়ে আছি, সিপিআইএম মেচেদায় রাস্তা অবরোধ করে রেখেছে। পূর্ব মেদিনীপুরেই ঢুকতে দিচ্ছে না। তোমরা কোথায়?’

‘আমরা রওনা দিয়েছি, দ্বিতীয় হুগলি সেতুতে।’

 

‘আমি শের ই পঞ্জাবের ঠিক উল্টোদিকে রাস্তার ধারে গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। এখানে এসে তোমাদের গাড়ি একটু আস্তে করে দিও, আমি গাড়ি নিয়ে তোমাদের কনভয়ে ঢুকে যাব। একসঙ্গে যাব।’

‘ঠিক আছে।’

কোলাঘাটে অপেক্ষা করছি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কনভয়ের জন্য। ঠিক সেই মুহূর্তে জেলা পুলিশের এক অফিসার মারফত খবর পেলাম, গড়বেতার দুই সিপিআইএম নেতা তপন ঘোষ এবং শুকুর আলি আটক হয়েছেন এগরা থানায়। বুঝতে পারছি, জেলার পরিস্থিতি উত্তপ্ত হচ্ছে। সকালে মহেশপুরে মৃত্যুর প্রতিবাদে বিকেল থেকেই জেলার বিভিন্ন জায়গায় অবরোধ শুরু করেছিল তৃণমূল কংগ্রেস এবং বিরোধীরা। এবার সন্ধের মুখে পালটা শক্তি প্রদর্শনে নেমেছে সিপিআইএমও।  জেলার বিভিন্ন জায়গায় রাস্তা অবরোধ শুরু করেছে শাসক দল। সিপিআইএমের অভিযোগ, বাইরের লোক নন্দীগ্রামে গিয়ে গণ্ডগোল করছে। নন্দীগ্রামে বিরোধীদের হিংসাত্মক আন্দোলনে মদত দিচ্ছে। তাই নন্দীগ্রাম এবং জেলাকে শান্ত রাখতে বাইরের কাউকে ঢুকতে দেওয়া হবে না। আসল উদ্দেশ্য, সংবাদমাধ্যম এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নন্দীগ্রামে ঢোকা আটকানো। কারণ, তখনও যে মাস্টারদার পুরো দল খেজুরিতে আটকে।

তপন ঘোষ এবং শুকুর আলির খবর নিয়ে এক পুলিশ অফিসারের সঙ্গে ফোনে কথা বলছিলাম। তিনি বলছিলেন, এগরা থানায় ব্যাপক গণ্ডগোল হচ্ছে। তার আঁচ গোটা জেলায় পড়লে সর্বনাশ। এই কথার মাঝেই আটটা নাগাদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এসে পৌঁছলেন কোলাঘাটে। আমি দাঁড়িয়েই ছিলাম রাস্তায়। তাঁর গাড়ি এসে থামল, পেছনের সিটে শোভন চট্টোপাধ্যায়। তৃণমূল নেত্রীর গাড়ির পেছনে আরও ২-৩টে সংবাদমাধ্যমের গাড়ি। আমার গাড়ি সেই কনভয়ে ঢুকিয়ে আমার এগোলাম মেচেদার দিকে। ততক্ষণে সর্বত্র খবর হয়ে গিয়েছে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নন্দীগ্রাম যাচ্ছেন। মেচেদার যেখানে অবরোধে আমি আটকে গিয়েছিলাম, সেখানে তখন সিপিআইএম কর্মীর সংখ্যা আরও অনেক বেড়েছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কনভয় পৌঁছনো মাত্রই শুরু হয়ে গেল তারস্বরে স্লোগান। ‘বহিরাগত এনে নন্দীগ্রামকে অশান্ত করা চলবে না, তৃণমূল-মাওবাদী নন্দীগ্রাম থেকে দূর হঠো, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দূর হঠো,’ ইত্যাদি।

কয়েক’শো সিপিআইএম ক্যাডারের লাঠি, বাঁশ হাতে মারমুখী অবরোধে আটকে গেল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কনভয়।

১৪ মার্চ রাতে চন্ডিপুর মোড়ে যেমন ঘটেছিল, হুবহু এক ছবি। শুধু জায়গাটা পালটে হয়েছে মেচেদা। সাংসদ এবং বিরোধী নেত্রীকে নজিরবিহীনভাবে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে, কোথাও কোনও পুলিশ নেই। গাড়ির সামনের সিটে গম্ভীর মুখে বসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কতক্ষণ এমন অবরোধ চলবে কেউ জানে না। আমার ক্যামেরাম্যান পার্থ দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে সিপিআইএম কর্মী-সমর্থকদের হাতে অবরুদ্ধ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবি তুলছে। সেই ছবি পাঠানোর পর রাত ৯টায় অফিস থেকে আমার ফোনো নিতে শুরু করল। লাইভ হচ্ছিল। আমি ফোনোতে বলছি সিপিআইএমের অবরোধের কথা, সেখানকার পরিস্থিতি। ফোনে পরিষ্কার শোনা যাচ্ছিল সিপিআইএম ক্যাডারদের স্লোগান। আমাকে থামিয়ে ফোনে ধরা হয়েছিল সিপিআইএম নেতা বিনয় কোঙারকে। আমি শুনতে পাচ্ছি, তিনি বলছিলেন, ‘তাঁর দল সিপিআইএম কোথাও কোনও অবরোধ করেনি, তাঁদের কোনও পরিকল্পনা নেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ঘেরাও করে রাখার’ ইত্যাদি। বিনয় কোঙার যখন লাইভে ফোনে এই সব বলছেন, তখন আমাদের পাঠানো ছবি চলছিল চ্যানেলে। আমি শুধু ভাবছিলাম, এই যুগে দাঁড়িয়ে এও সম্ভব? রাজ্যের লক্ষ লক্ষ মানুষ টেলিভিশনে দেখছেন এক জিনিস, আর সিপিআইএম নেতারা তার পুরো উল্টো কথা বলে চলেছেন কলকাতায় বসে। ভাবছিলাম, এই দিশেহারা পার্টি, প্রায় ভেঙে পড়া প্রশাসনের পক্ষে কীভাবে রাজ্য সরকার চালানো সম্ভব!

এইভাবে ঘেরাও হয়ে কাটল আরও প্রায় দু’ঘণ্টা। টানা গাড়িতে বসে থাকলেন রাজ্যের পরবর্তী মুখ্যমন্ত্রী। কখনও ফোন করছেন, কখনও এসএমএস। কখনও কথা বলছেন ঘটনাস্থলে উপস্থিত সাংবাদিকদের সঙ্গে। যত রাত বাড়ছে জেদ বাড়ছে তৃণমূল নেত্রীর। আর ততই স্লোগানে জোর বাড়ছে সিপিআইএম বাহিনীর। মাঝেমধ্যেই কেউ মজা করছে, অশ্লীল মন্তব্য করছে মমতা বন্দোপাধ্যায়কে নিয়ে। ঘটনাস্থলে না থাকলে কারও বিশ্বাস করাও কঠিন, এই শক্তিশালী বৈদ্যুতিন সংবাদমাধ্যমের যুগে সিপিআইএমের মতো তিন বছর অন্তর পার্টি কংগ্রেস করা একটা সংগঠিত দলের পক্ষে এমন হঠকারী কাজ কীভাবে করা সম্ভব।

মুজফফর আহমেদ ভবনের কোনও নেতা একবারও ভাবলেন না, এই গণতান্ত্রিক কাঠামোতে দাঁড়িয়ে, একটা পরিকল্পিত দলীয় অবরোধের জন্য রাজ্যের বিরোধী নেত্রী একটা জেলায় ঢুকতে পারছেন না, এর কী মারাত্মক প্রতিক্রিয়া হচ্ছে সাধারণ মানুষের মধ্যে। কী একদলীয় উদ্ধত্য এবং শক্তি প্রদর্শনের বার্তা যাচ্ছে গোটা রাজ্যের মানুষের কাছে। দু’ঘণ্টা ঠায় গাড়িতে বসে থেকে তৃণমূল নেত্রী ঠিক করলেন, আজ আর নয়, কাল নন্দীগ্রামে ঢোকার চেষ্টা হবে। রাত প্রায় সাড়ে ১১টা, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গাড়ি ঘুরিয়ে রওনা দিলেন কোলাঘাট থার্মাল পাওয়ার প্রজেক্টস লিমিটেডের গেস্ট হাউসের দিকে। রাতে তিনি সেখানেই থাকলেন। আমি, পার্থ, সিএনএন-আইবিএনের সৌগত এবং ওর ক্যামেরাম্যান কোলাঘাটেরই একটা হোটেলে ছোট একটা ঘর জোগাড় করলাম। ঘুম তো হল না। চারজন প্রায় জেগেই কাটিয়ে দিলাম রাতটা।

পরদিন সকালে তাড়াতাড়ি উঠে রেডি হয়ে বেরোলাম। সকাল সাতটা-সাড়ে সাতটা হবে, মেচেদার মোড়ে পৌঁছে দেখি তখনও সিপিআইএমের অবরোধ চলছে। মেচেদা-হলদিয়া রাস্তা পুরো বন্ধ। হলদিয়া যাওয়ার ট্রাক এবং বড় বড় ট্যাঙ্কার লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে রাস্তার ওপর। সেখান থেকে গেলাম কোলাঘাট থার্মাল পাওয়ারের গেস্ট হাউসে। গেস্ট হাউসের বাইরেই দেখা শোভন চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে।

‘দিদি একটু পরেই বেরোবে, রেডি হচ্ছে।’

‘কিন্তু এখনও তো অবরোধ চলছে দেখে এলাম।’

‘দেখা যাক, কী করা যায়।’

১১ নভেম্বর। সকাল সাড়ে ৯টা নাগাদ কোলাঘাট থার্মাল পাওয়ারের গেস্ট হাউস থেকে বেরোলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পেছনে যথারীতি আমাদের গাড়ি। কোলাঘাট মোড় থেকে মেচেদার দিকে না ঘুরে তাঁর গাড়ি চলেছে সোজা পাঁশকুড়ার দিকে। পাঁশকুড়া মোড় থেকে বাঁদিকে ঘুরে গেল কনভয়। পাঁশকুড়া শহর ছাড়িয়ে গ্রামে ঢুকলাম। একটা গাড়িই যেতে পারে এমন সরু রাস্তা। ডাইনে-বাঁয়ে পুকুর, ধান ক্ষেত, ছোট বাড়ি। বেশ কিছুটা যাওয়ার পর আবার সিপিআইএমের অবরোধের মুখে পড়ে গেলাম। শ’খানেক পুরুষ-মহিলা লাল ফ্ল্যাগ হাতে রাস্তায় অবরোধ করেছে। সরু গ্রামের রাস্তায় লাইন দিয়ে সব গাড়ি থেমে গেল। আবার আগের দিনের মতো পরিস্থিতি। সিপিআইএম ঠিকই করে নিয়েছে, নন্দীগ্রাম তো বটেই, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে তমলুকেই যেতে দেবে না। বিনা গুলি, বোমায় চূড়ান্ত রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস। এক ঘণ্টারও বেশি সময় অবরোধের জেরে গাড়িতে বসে আছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আশপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে আছি আমরা। হঠাৎ ৩-৪ জন যুবক কোথা থেকে যেন আচমকা মোটরসাইকেল চালিয়ে চলে এল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গাড়ির একদম সামনে। কথা বলল তৃণমূল নেত্রীর সঙ্গে। অবরোধকারী সিপিএম বাহিনী কিছু বুঝে ওঠার আগেই মুহূর্তের মধ্যে গাড়ি থেকে নেমে এক যুবকের মোটরসাইকেলের পেছনে উঠে বসলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অন্য মোটরসাইকেলগুলোর পেছনে শোভন  চট্টোপাধ্যায় এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ২-৩ জন পুলিশ অফিসার। গাড়ি থেকে গেল পাঁশকুড়ার গ্রামে। গ্রামের অলি-গলি রাস্তা দিয়ে মমতা বন্দোপাধ্যায়কে নিয়ে মোটরসাইকেল গিয়ে থামল তমলুক হাসপাতালে। সেদিন মোটরসাইকেল চালিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে তমলুকে পৌঁছে দিয়েছিলেন যিনি, তাঁর নাম আনিসুর রহমান। পাঁশকুড়ায় সিপিআইএমের প্রাক্তন যুব নেতা। তমলুক জেলা হাসপাতালে তখন আগের দিন মহেশপুরে সিপিআইএমের চালানো গুলিতে জখম বহু লোক ভর্তি। আগের দিন মহেশপুরে মৃতদের পরিবার, জখম পুরুষ, মহিলাদের আত্মীয়স্বজন সব মিলে হাজার মানুষের ভিড় তখন তমলুক হাসপাতালে। সোজা ভেতরে ঢুকে গেলেন তৃণমূল নেত্রী। তাঁকে ঘিরে হাজার মানুষের ভিড়।

ওদিকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গাড়ি থেকে নেমে মোটরসাইকেলে চেপে চলে গিয়েছেন এই খবর জানাজানি হতেই মাথায় বাজ পড়ে পাঁশকুড়ার গ্রামে অবরোধকারী সিপিআইএম ক্যাডারদের। তারপর মিনিট দশেকের মধ্যেই উঠে গেল অবরোধ। আমিও গাড়ি নিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যে পৌঁছোই তমলুক হাসপাতালে। প্রায় ৩টে বাজে। হাসপাতালের বেডে লাইন দিয়ে শুয়ে নন্দীগ্রামের মানুষ। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁদের দেখছেন, তাঁদের সঙ্গে কথা বলছেন। হাসপাতালের বাইরে নন্দীগ্রামের মানুষের ভিড়। ভর্তি হওয়া লোকজনের আত্মীয়-পরিজনদের কান্না, চিৎকার। পার্থ ছবি তুলছে। আমি ওই প্রচণ্ড ভিড়ে না ঢুকে হাসপাতালের বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। শুধু ভাবছি, কীভাবে নন্দীগ্রামে ঢোকা যাবে। খবর পাচ্ছিলাম, তখনও নন্দীগ্রামে ঢোকার রাস্তা ব্যারিকেড করে রেখেছে সিপিআইএম। হাসপাতালের বাইরে দাঁড়িয়ে থেকেই সেদিন প্রায় পুরোটা কেটে গেল। সন্ধের মুখে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গিয়ে উঠলেন তমলুকের গ্রিন ভ্যালি হোটেলে। ওই হোটেলেই তিনি ছিলেন ১৪ মার্চ রাতেও। তিনি নিজস্ব সূত্র মারফত খবর পেয়েছেন নন্দীগ্রামে ঢোকার সমস্ত রাস্তায় সিপিআইএমের অবরোধের। তাই বাধ্য হয়েই সেদিনের মতো নন্দীগ্রামে যাওয়ার চেষ্টা বাতিল করে হোটেলে চলে যান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই হোটেলে জায়গা না পেয়ে আমি আর পার্থ গিয়ে উঠলাম তমলুকের অন্য একটা হোটেলে।

সেদিন সকালে স্নান করতে পারিনি। হোটেলের ঘরে গিয়ে টিভিতে খবর চালিয়ে স্নান করতে গেছি। ফিরে এসে, খবরে দেখলাম নন্দীগ্রাম পুনর্দখল নিয়ে সিপিআইএমের অফিশিয়াল বক্তব্য। ‘নন্দীগ্রামে সূর্যোদয় হয়েছে। মানুষের প্রতিরোধের সামনে পিছু হঠেছে তৃণমূল কংগ্রেস, মাওবাদী জোট।’ এর ঠিক দু’দিন বাদে তমলুকের হোটেলে বসেই সন্ধ্যায় দেখেছিলাম, মহাকরণে মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সাংবাদিক সম্মেলন। লাইভ। সাংবাদিক সম্মেলনের প্রায় শেষে মুখ্যমন্ত্রী বললেন, ‘দে হ্যাভ বিন পেইড ব্যাক বাই দেয়ার ওন কয়েন।’ বলে বেরিয়ে গেলেন মহাকরণ থেকে। টেলিভিশনে দেখাচ্ছে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের পিঠ। কয়েক পা হেঁটে গিয়ে লিফটে উঠলেন। নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, কী শুনলাম। ঠিক শুনেছি তো? তার মানে গত ৩ জানুয়ারি থেকে নন্দীগ্রামে চলা লাগাতার গণ্ডগোল, সংঘর্ষ, বাড়িছাড়া, কখনও পুলিশের গুলিতে, কখনও নিজেদের মধ্যে সশস্ত্র লড়াইয়ে এত মানুষের মৃত্যু, এত রক্তপাত নিয়ে এটাই সরকারের অবস্থান।

১১ তারিখ শ্যামল চক্রবর্তীর ‘নন্দীগ্রামে সূর্যোদয়ে’র তত্ত্ব শোনার কিছু বাদেই ফোন করলাম লক্ষ্মণ শেঠকে। আগের দিন সন্ধ্যায় ধরেননি, এবার একবারই ফোন ধরলেন তমলুকের সাংসদ।

‘কাল নন্দীগ্রামে যেতেই হবে, কিচ্ছু করার নেই। আপনি ব্যবস্থা করে দিন।’ বললাম লক্ষ্মণ শেঠকে।

‘আর দু’একদিন পরে যাও। সব ঠিক হয়ে যাবে।’

‘না না, কালকেই যেতে হবে, আপনি খেজুরিতে আপনার দলের লোকদের বলে দিন। আমি খেজুরি দিয়ে ঢুকব।’ অনেকক্ষণ কথা এবং জোরাজুরির পর অবশেষে তমলুকের সাংসদ রাজি হলেন। আশ্বাস দিলেন, ‘ঠিক আছে, আমি বলে রাখব, তুমি খেজুরি দিয়ে যেও।’

বললেন বটে, কিন্তু আমি পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, সত্যিই ঢুকতে পারব তো? এমন আশ্বাস তো তিনি ১৩ মার্চ সন্ধ্যাবেলাও দিয়েছিলেন তমলুকের পার্টি অফিসে বসে। কিন্তু ১৪ মার্চ তো ঢুকতেই পারিনি। তাই বিকল্প চিন্তাও করে রাখলাম। যদি খেজুরি দিয়ে ঢুকতে না পারি, নৌকো ভাড়া করে নদী পেরিয়ে নন্দীগ্রামে যাওয়ার চেষ্টা করতে হবে।

 

১২ নভেম্বর, ২০০৭

 

পরদিন ১২ নভেম্বর। আমার সাংবাদিক জীবনে এক অবিশ্বাস্য অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ দিন। একদম সকাল-সকাল আমি আর পার্থ গাড়ি করে বেরিয়ে যাই হোটেল থেকে। চন্ডিপুর মোড় পেরিয়ে হেঁড়িয়ার দিকে যাচ্ছি, যেখানে থেকে খেজুরি ঢুকতে হবে। গাড়িতে বসে দূর থেকে দেখতে পাচ্ছি, রাস্তার এক জায়গায় বড়ো জটলা, অবরোধ। সর্বনাশ করেছে, আবার সিপিআইএমের অবরোধ? একদম কাছে পৌঁছে গাড়ি থামালাম। বাজকুল মোড়। দেখি সিপিআইএমের নয়, ওই মানুষগুলো তৃণমূল কংগ্রেস, কংগ্রেস বা এসইউসি’র  সমর্থক। স্থানীয় মানুষ। নন্দীগ্রামে কয়েকদিন ধরে সিপিএমের সশস্ত্র বাহিনী যে আক্রমণ চালিয়েছে তার বিরোধিতায়, প্রতিবাদে তাঁরা রাস্তায় জটলা করেছেন। অবরোধ করছেন। গাড়ি থামাতেই সংবাদমাধ্যমের লোক বুঝতে পেরে কয়েকজন রীতিমতো আর্তি জানালেন, ‘আপনারা নন্দীগ্রামে যান।’ ভিড়ের মধ্যে চিনতেও পারলেন দু’একজন। ‘দাদা, গিয়ে দেখুন নন্দীগ্রামে কী অবস্থা। ওখানকার লোকজনকে বাঁচান। ভাল করে খবর করুন।’ তারপর রাস্তা করে দিলেন, আবার এগোলাম।

হেঁড়িয়ার মোড় থেকে বাঁদিকে ঘুরলাম খেজুরির দিকে, সকাল সওয়া আটটা-সাড়ে আটটা বাজে। রাস্তার মোড়ে প্রচুর মানুষ। বেশিরভাগ লোকজনরই মুখ-চোখ থমথমে। ছোট ছোট জটলা, বেশি কথা বলছেন না। অধিকাংশ লোককে দেখে মনে হচ্ছে না, সিপিআইএম যে নন্দীগ্রাম দখল করে নিয়েছে তাতে তারা খুব খুশি হয়েছে। একটা দম বন্ধ করা পরিবেশ খেজুরিতে ঢোকার মুখে। কিছুটা এগোতেই দেখি সিপিআইএমের ৫০-৬০টা ছেলে রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে। হাতে লাঠি, বাঁশ, পতাকা। রাস্তায় পাহারা দিচ্ছে। দূর থেকেই হাত দেখাল গাড়ি থামানোর জন্য। কয়েকজন তেড়ে এল গাড়ির কাছে, ড্রাইভার তখন ভয়ে গাড়ি ঘোরাচ্ছে। কয়েকজন গাড়িতে চড়-থাপ্পড়ও মারল। সঙ্গে সংবাদমাধ্যমকে গালিগালাজ। দু’একজন বলল, আর যাওয়া যাবে না, গাড়ি ঘুরিয়ে নিন। গাড়ি ঘুরিয়ে অনেকটা পিছিয়ে এলাম। এসে দাঁড়ালাম হেঁড়িয়ার মোড়ে সিপিআইএমের পার্টি অফিসের সামনে। তারপর ফোন করলাম লক্ষ্মণ শেঠকে। একবারেই ফোন ধরলেন তিনি।

‘কী ব্যাপার, আপনি যে বললেন খেজুরিতে বলে রাখবেন, কিন্তু এখানে তো আটকে দিয়েছে। ঢুকতে দিচ্ছে না।’ জানালাম তাঁকে।

‘ঠিক আছে, আমি দেখছি, কোথায় আটকেছে?’

‘জায়গার নাম জানি না, হেঁড়িয়া মোড় থেকে খেজুরিতে ঢুকে ৩-৪ কিলোমিটার পর।’

‘ঠিক আছে, আমি দেখছি।’ ফোন রাখলেন তমলুকের সাংসদ।

রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে আছি। চা খাচ্ছি, পায়চারি করছি। আজও ঢুকতে পারবো না? সময় কাটছে না, দশ মিনিট বাদে আবার ফোন করলাম লক্ষ্মণ শেঠকে। এবার জবাব দিলেন, ‘বলে দিয়েছি, কোনও অসুবিধা হবে না।’

রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি। বুঝতে পারছি না আর এগনো ঠিক হবে কিনা।  প্রায় আধ ঘণ্টা পরে এক ব্যক্তি ফোন করলেন আমাকে।

‘দাদা, আমি হিমাংশু দাস বলছি, আপনি কোথায়? লক্ষ্মণদা আমাকে বলেছেন আপনি নন্দীগ্রাম যাবেন। চলে আসুন। কোনও অসুবিধা হবে না।’

হিমাংশু দাসের নাম আগে শুনেছি বহুবার, কিন্তু আলাপ ছিল না তেমন। পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি নামেই, স্থানীয় মানুষ মাত্রই জানেন, হিমাংশু দাসই খেজুরির প্রধানমন্ত্রী। তাঁর এক ইশারায় খেজুরিতে গাছের পাতা থেমে যায়। বাঘে এবং বিরোধীতে এক ঘাটে জল খায়!

‘কিন্তু আপনাদের ছেলেরা তো রাস্তা আটকে রেখেছে। যাব কীভাবে?’

 

‘ওরা জানত না, আপনি চলে আসুন, আর কোনও সমস্যা হবে না। আপনার কী রঙের গাড়ি?’

‘লাল, টাভেরা।’

‘ঠিক আছে। সোজা চলে আসুন। আমি সবাইকে বলে দিয়েছি।’

আবার এগোলাম, সিপিআইএমের ছেলেগুলো তখনও একইভাবে রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে, গাড়ি আস্তে করে বেরিয়ে গেলাম। কেউ কিছু বলল না, শুধু সন্দিহান দৃষ্টিতে দেখছে আমাদের। বুঝতে পারছে না, কোন ম্যাজিকে এই গাড়িটা খেজুরির ঢোকার ভিসা জোগাড় করেছে। ওরা ছাড়াও রাস্তার দু’ধারে বেশ কিছু সাধারণ মানুষজন। কিছু দোকানপাট খোলা। লোকজনের চোখ-মুখে স্পষ্ট বার্তা, পরিস্থিতি স্বাভাবিক নয়। জটলাটা পেরোতেই আবার হিমাংশু দাসের ফোন। ‘কোনও সমস্যা হয়নি তো?’

‘না।’

‘কামারদা মোড়ে এসে একটু দাঁড়াবেন, আমি ওখানে অপেক্ষা করছি।’

কামারদা মোড়ে আরও বেশি ভিড়। বোঝাই যাচ্ছিল বেশিরভাগই সিপিআইএম কর্মী। হঠাৎ একটা সংবাদমাধ্যমের গাড়ি চলে আসায় অনেকেই অবাক। গাড়ি থামতেই কম উচ্চতার এক ব্যক্তি, পাজামা-পাঞ্জাবি পরা, গায়ে কালো জহর কোট, কুচকুচে কালো চুল, এগিয়ে এলেন। বয়স ৫০ থেকে ৬০ এর মধ্যে যা খুশি হতে পারে। উনিই হিমাংশু দাস, সিপিআইএম নেতা। খেজুরির ১ নম্বর ব্লকে ইনিই শেষ কথা।

‘বিতনুদা, একটু চা খেয়ে যান।’

‘না দাদা, দেরি হয়ে যাবে। পরে একদিন আপনার কাছে এসে চা খেয়ে যাব।’

‘ঠিক আছে আপনি যান। সব জায়গায় বলা আছে কোনও চিন্তা নেই। আর কোনও অসুবিধে হবে না। কিন্তু নন্দীগ্রামে খুব বেশিক্ষণ থাকবেন না। তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আসবেন। বুঝতেই তো পারছেন।’

ওই প্রথমবার পরিচয়। পরে একাধিক বার খেজুরিতে হিমাংশু দাসের আতিথেয়তার প্রমাণ পেয়েছি। কিন্তু তখন আর নষ্ট করার মতো সময় ছিল না আমার হাতে। হিমাংশু দাসের সঙ্গে দাঁড়িয়ে রাস্তায় কথা বলছি, দেখছি আশেপাশের লোকজন আমাকে অবাক হয়ে দেখছে। কামারদা মোড় যথেষ্ট জমজমাট। প্রচুর লোকজন, বেশিরভাগ দোকান খোলা। অনেককেই দেখে মনে হচ্ছিল, কিছু বলতে চাইছে, কিন্তু কোনও অদৃশ্য কারণে বলতে পারছে না। এমন হাবভাব মুখে ফুটিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বুঝতে পারছিলাম, চাইলেও এদের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব নয়। তাড়াতাড়ি রওনা দিলাম খেজুরি বিদ্যাপীঠ মোড়ের দিকে। বিদ্যাপীঠের মোড় থেকে বাঁদিকে ঘুরে বেশ কিছুটা গিয়ে ভাঙাবেড়া ব্রিজ। ভাঙাবেড়া ব্রিজে যখন পৌঁছলাম তখন প্রায় সাড়ে ১০ টা-১১ টা বাজে। রাস্তায় বেশ কিছু জায়গায় সিপিআইএমের ছেলেদের অবরোধ বা জটলা ছিল। সব জায়গায়তেই গাড়ি আস্তে করে দিয়েছি, ওরাও কিছু বলেনি, থামানোর চেষ্টাও করেনি গাড়ি। শুধু এটুকু বুঝতে পারছিলাম, সব জায়গায় সিপিআইএম নেতাদের বলা আছে, লাল বড়ো গাড়ি আটকানো যাবে না। অন্য সমস্ত বাইরের গাড়ির তখনও নন্দীগ্রামে প্রবেশ নিষিদ্ধ। কিন্তু গাড়ি থামাতে হল ভাঙাবেড়া ব্রিজের কাছে পৌঁছে। প্রচুর ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। আর গাড়ি যাবে না। কারণ, ব্রিজ টপকে নন্দীগ্রামের দিকে নামতেই রাস্তা কাটা। জানুয়ারি মাসে যে রাস্তা কেটেছিল ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি, তা তখনও মেরামত হয়নি।

ভাঙাবেড়া ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে আমি এবং পার্থপ্রতিম। ভাবছি, কী করা যায়! সোনাচূড়া প্রায় চার কিলোমিটার, গড়চক্রবেড়িয়া আরও দূরে। একবার ভাবলাম হেঁটেই যাব, যাতায়াত মিলে প্রায় ১৪-১৫ কিলোমিটার হাঁটতে হবে। কোনও অসুবিধা নেই, এতটা রাস্তা যখন এত বাধা পেরিয়ে এসেছি, নন্দীগ্রামে ঢুকতেই হবে। এদিকে ওদিকে তাকিয়ে দেখছি, সেই ৩ জানুয়ারির মতো একটা বা দুটো সাইকেল জোগাড় করা যায় কিনা। তাহলে সমস্যা অনেকটাই মিটবে। এমনই সময় ঘড়ঘড় আওয়াজ করে প্রায় মাটি ফুঁড়ে সামনে এসে দাঁড়াল একটা মোটরসাইকেল। নন্দীগ্রামের দিক থেকে। তার ওপর বসা নবকুমার সামন্ত। গায়ে উইন্ড চিটার, গলায় মাফলার। ৭ জানুয়ারি সকালে যে শঙ্কর সামন্তকে কুপিয়ে, পুড়িয়ে খুন করেছিল ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি, তাঁর ভাই নবকুমার সামন্ত। তখনও বিশেষ পরিচয় ছিল না নব সামন্তের সঙ্গে, আগে কয়েকবার কথা হয়েছিল মাত্র। একদম সামনে এসে মোটরসাইকেল থামিয়ে সিটে বসেই নব বললেন, ‘বিতনুদা ভালো আছেন? চিনতে পারছেন? আমি নবকুমার সামন্ত।’ একটু থেমে থেমে কথা বলেন। মোটরসাইকেলর স্টার্ট বন্ধ না করার জন্য সব কথা ভালো করে শোনাও যাচ্ছে না। নন্দীগ্রাম নিয়ে আমার সন্দেহপ্রবণ মন বলছে, আবার একটা নতুন সমস্যা তৈরি হল না তো? নবকুমার সামন্তের নেতৃত্বে খেজুরির দিক থেকে ভয়ঙ্কর আক্রমণ হচ্ছে বলে বারবার অভিযোগ করছে ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি। সেই নবকুমার সামন্ত আমার সামনে মোটরসাইকেলে বসে।

 

নন্দীগ্রামে জরুরি অবস্থা

 

‘বিতনুদা চলুন, আপনাকে নন্দীগ্রামে নিয়ে যেতে এসেছি। ১০ মাস বাদে বাড়ি ফিরেছি আজ সকালে।’ মোটরসাইকেলে স্টার্ট বন্ধ করে অপ্রত্যাশিত প্রস্তাব পেশ করলেন দশ মাস আগে খুন হওয়া শঙ্কর সামন্তের ভাই। একেই কিনা আমি সন্দেহ করেছিলাম!

নবকুমার সামন্তর এই নিজে থেকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসা প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না। এ কি ম্যাজিক নাকি? সেই পরশু সন্ধে থেকে নন্দীগ্রামে ঢুকতে পারছি না। আর গত দু’ঘন্টা ধরে যা যা হচ্ছে তাকে একমাত্র মেঘ না চাইতেই প্রবল বৃষ্টির সঙ্গে তুলনা করা যায়। আমি এবং পার্থ ওঁর মোটর সাইকেলের পিছনে বসলাম। পার্থর হাতে ক্যামেরা, আমি মাইক হাতে। আমাদের সঙ্গে সঙ্গে কয়েকটা মোটরসাইকেলে চলতে শুরু করলো বেশ কিছু সিপিআইএমের ছেলে, যারা সেই জানুয়ারির গোড়া থেকেই ঘরছাড়া ছিল। সবাই মোটামুটি ১০ মাস বাদে ঘরে ফিরছে বা ফিরেছে। কেউ আনন্দে শিস দিচ্ছে, কেউ জামা খুলে মাথার ওপর ঘোরাচ্ছে। একজন আর একজনকে জড়িয়ে ধরছে আনন্দে। তাদের দেখে সেই মূহুর্তে মনে হচ্ছিল চারিদিকে একটা উৎসবের পরিবেশ তৈরি হয়েছে।

 

পড়ুন আগের পর্ব: নন্দীগ্রাম আসলে যা ঘটেছিল #১৫: তপন-শুকুরকে ছাড়াতে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে ফোন করলেন সুশান্ত ঘোষ

সামান্য আগে ভাঙাবেড়া ব্রিজেই দেখেছি, ছোট্ট বাচ্চা কোলে কম বয়সী মা রাস্তার ধারে মাটিতে বসে। পাশে বাক্স-প্যাঁটরা বাঁধা। যুবক স্বামী এতদিন ঘরছাড়া ছিল সিপিআইএম করার অপরাধে। সে স্ত্রী-বাচ্চাকে রাস্তায় বসিয়ে তিন চাকার ভ্যান চালকের সঙ্গে ভাড়া নিয়ে দরদাম করছে দীর্ঘদিন বাদে বাড়ি ফেরার জন্য। মোটরসাইকেলে যেতে যেতে ভাবছিলাম, তবে যে সিপিআইএম এতদিন ধরে বলছিল, বন্দুকের ট্রিগারে হাত দিয়ে নন্দীগ্রামকে অবরুদ্ধ করে রেখেছে তৃণমূল কংগ্রেস- মাওবাদীদের যৌথ বাহিনী, সাধারণ মানুষকে প্রাণে মেরে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে আন্দোলন করতে বাধ্য করেছে, আসলে সাধারণ মানুষের এই আন্দোলনে ততটা সায় নেই, এসব তো তাহলে অনেকটাই ঠিক। সত্যিই কি সাধারণ মানুষ অপেক্ষা করছিল, কবে সিপিআইএম এসে তাদের এই দমবন্ধ পরিবেশ থেকে উদ্ধার করবে তার জন্য? এই সব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে যাচ্ছি। কিন্তু রাস্তার আশেপাশে কোথাও কোনও সাধারণ মানুষ নেই, কোনও গ্রামবাসীকেও দেখতে পাচ্ছি না। একমাত্র সিপিআইএমের কিছু ছেলেকে বাদ দিলে আর কোনও লোককে দেখতে পাচ্ছি না কোথাও। তাতে সামান্য একটু খটকা লাগছিল ঠিকই, কিন্তু বিষয়টা তখনও ভালভাবে বুঝতে পারিনি। প্রথম ধাক্কাটা খেলাম সোনাচূড়ার মোড়ে পৌঁছে।

নব সামন্ত জোরে মোটরসাইকেল চালাচ্ছে। সোনাচূড়া বাজারের কাছে পৌঁছে দেখি, রাস্তার ধারে বেঞ্চে, মাটিতে বসে আছে ৮-১০ টা ছেলে। সবার পরনে কালো হাফ প্যান্ট, কালো হাত কাটা গেঞ্জি। সবার হাতে বা কাঁধে একটা করে বন্দুক! যা তা বন্দুক নয়, চকচকে নতুন রাইফেল। কারও কারও মুখ কালো কাপড়ে ঢাকা। সবার বয়েস ১৮-২০ থেকে ৩০ এর মধ্যে। মোটরসাইকেল আসতে দেখেই উঠে দাঁড়াল তারা। সামনে যেতেই বুঝলাম, নব সামন্তকে দেখে আশ্বস্ত হল। নতুন অতিথিকে দেখে একটু সন্দেহ চোখে মুখে, কিন্তু সারথি চেনা দেখে কেউ কিছু বলল না। সোনাচূড়ায় না থেমে গড়চক্রবেড়িয়ার দিকে এগিয়ে চলল নব সামন্তের মোটরসাইকেল। আমি তখন ভাবছি, দু’দিন আগেই  ১০ তারিখ পুরো নন্দীগ্রামে ঢুকে পড়েছে সিপিআইএম। কলকাতা এবং জেলার নেতারাই বলেছেন, সন্ত্রাস মুক্ত হয়েছে নন্দীগ্রাম। মাওবাদীরা সব সাধারণ মানুষের প্রতিবাদের মুখে পালিয়েছে। তাই যদি ঠিক হবে, তা হলে এখন সশস্ত্র বাহিনী নন্দীগ্রামে মোতায়েন করে রাখার প্রয়োজনটা কী? আরও একটা জিনিস লক্ষ্য করেছিলাম, পুরো রাস্তার মতোই সোনাচূড়ার মোড়ে সিপিআইএমের সশস্ত্র ওই ১০-১২টা ছেলেকে বাদ দিয়ে একটা লোকও নেই। পুরো শুনশান। অথচ সোনাচূড়া এই আন্দোলনের অন্যতম আঁতুড়ঘর। যে সোনাচূড়া মোড় ১০ মাস দিন- রাত জেগেছে, সেখানে বেলা ১২ টার সময় এমন কারফিউয়ের পরিস্থিতি কেন?

 

চলবে

 

(১৮ সেপ্টেম্বর থেকে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে নন্দীগ্রাম আসলে যা ঘটেছিল। প্রতি পর্বে লাল রং দিয়ে আগের পর্বের লিঙ্ক দেওয়া থাকছে)

Comments are closed.