এনপিআরের মধ্যে দিয়ে তৈরি হবে ভারতের বাসিন্দাদের তালিকা। যা এনআরসির প্রথম ধাপ। এনআরসি তৈরি হওয়ার পর, সেই তালিকা থেকে বাদ যাওয়া মানুষরা আইনত বেআইনি অনুপ্রবেশকারী হিসেবে গণ্য হবেন। ভারতীয় আইন মোতাবেক তাঁদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপও করতে পারে সরকার।
এই প্রেক্ষিতে এনপিআর বয়কট করেছে একাধিক রাজ্য। মূল বিরোধিতার জায়গা হল, এনপিআরের প্রশ্নমালায় একাধিক প্রশ্নের উপস্থিতি। এই প্রক্রিয়াকে শুরুতেই ভোঁতা করে দিতে দ্বিমুখী কৌশল নিয়েছেন আন্দোলনকারীরা। একাংশ বলছেন, তাঁরা এনপিআর ফর্মে আপত্তি থাকা প্রশ্নের উত্তর দেবেন না, কাগজ দেখাবেন না। আবার একাধিক রাজ্য বলেছে, এনপিআরে ২০১০ সালের প্রশ্নমালা থাকলেই একমাত্র তা রাজ্যে হতে পারে, নতুন কোনও প্রশ্নের অন্তর্ভুক্তি মানা হবে না। এভাবেই দেশজুড়ে এনআরসির প্রক্রিয়াকে শুরুতেই বানচাল করে দেওয়ার উদ্যোগ শুরু হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হল, এভাবে কি সত্যিই এনআরসি আটকানো সম্ভব?
মঙ্গলবার এই বিষয়ের উপর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ইংরেজি নিউজ পোর্টাল scroll.in। সেই প্রতিবেদনে সাংবাদিক শোয়েব ড্যানিয়েল উদাহরণ দিয়ে দেখিয়েছেন, বিরোধিতায় পড়ে কেন্দ্র যদি পুরনো এনপিআর প্রশ্নমালাই রাখতে রাজি হয়, তাও এনআরসি প্রক্রিয়ার জন্য তথ্য জোগাড়ে বিন্দুমাত্র সমস্যায় পড়বে না কেন্দ্রীয় সরকার। কারণ ২০১০ সালের এনপিআর ফর্মেও ছিল একই গোত্রের প্রশ্ন।
আরও জানতে ক্লিক করুন, নাগরিকত্ব প্রমাণে লাগবে ধর্মীয় পরিচয়ের উল্লেখ
২০১০ সালের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যাচ্ছে ২০২০ সালের এনপিআরে ৮ টি অতিরিক্ত তথ্য দেওয়ার জায়গা রয়েছে। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিতর্ক মা-বাবার জন্মস্থান ও জন্ম তারিখ সংক্রান্ত জায়গাটি নিয়ে। বিরোধীদের একাংশের যুক্তি, আসলে মা-বাবার জন্মস্থান ও জন্ম তারিখের হিসেব সরকারের প্রয়োজন এনপিআর তৈরির জন্য। তাই এই নতুন পংক্তি হঠাতে হবে। অর্থাৎ, ২০১০ সালের ফর্মে এনপিআর হলে তা দিয়ে আখেরে এনআরসি তৈরি করা সম্ভব হবে না। কিন্তু সত্যিই কি তাই?
আসুন দেখে নেওয়া যাক, ঠিক কী কারণে একথা বলা হচ্ছে।
২০১০ সালের এনপিআরে মা-বাবার জন্ম তারিখ এবং জন্মের স্থান নেওয়ার সংস্থান ছিল, যদি কোনও ব্যক্তি তাঁর মা-বাবার সঙ্গে একই বাড়িতে থাকেন। ২০১০ এনপিআরের ৯ নম্বর প্রশ্নের জন্য দিতে হতো মা-বাবা সম্পর্কে তথ্য। যদিও ২০১০ সালে মা-বাবার জন্মস্থান বা জন্ম তারিখ আলাদা করে জিজ্ঞাসা করা হয়নি। মা-বাবার সঙ্গে কেউ একই বাড়িতে থাকলে, তাঁকে এই সমস্ত তথ্য দিতে হয়েছিল।
এবার দেখুন কীভাবে এটা কাজ করল। প্রতিটি এনপিআর ফর্মে গৃহস্থের সম্পূর্ণ তথ্য দেওয়ার জায়গা ছিল। তা পূরণ করার পর বাড়ির প্রতিটি সদস্যের জন্য একটি সিরিয়াল নম্বর বরাদ্দ হয়। ৯ নম্বর প্রশ্নে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল মা-বাবার নাম। যদি মা-বাবা সেই বাড়িতে না থাকেন, তাহলে এনপিআর কর্মীকে শুধু তাঁদের নাম লিখে নিতে হতো। কিন্তু মা-বাবা সেই বাড়িতেই থাকলে, ৯ নম্বর প্রশ্নের অংশ হিসেবে মা-বাবার জন্যও একটি নির্দিষ্ট সিরিয়াল নম্বর বরাদ্দ হতো। আর সেই সিরিয়াল নম্বর পেতে দিতে হতো জন্মস্থান ও জন্ম তারিখ।
৫ বছরের কম বয়সী ৩৮% শিশুরই নেই বার্থ সার্টিফিকেট, কীভাবে পাবে তাঁরা নাগরিকত্ব? আরও জানতে ক্লিক করুন
স্বভাবতই যাঁরা মা-বাবার সঙ্গে একই বাড়িতে থাকেন না বা মা-বাবার মৃত্যু হয়েছে, এমন ক্ষেত্রে মা-বাবার তথ্য না দিলে চলে। যা সংখ্যায় নগণ্য। ভারতে সাধারণত বিয়ের আগে পর্যন্ত ছেলে-মেয়েরা মা-বাবার সঙ্গেই থাকেন। অপ্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রেও যা প্রযোজ্য।
নাগরিকত্ব আইন অনুযায়ী, ১৯৮৭ সালের পয়লা জুলাইয়ের আগে জন্ম নেওয়া ব্যক্তি জন্মসূত্রেই ভারতীয় নাগরিক। তাঁদের মা-বাবার নাগরিকত্বের বিষয়টি এক্ষেত্রে অপ্রাসঙ্গিক। তারপরে যাঁরা জন্মেছেন, আজ তাঁদের বয়স ৩৩ কিংবা তার কম। কেবলমাত্র তাঁদের নাগরিকত্ব প্রমাণের ক্ষেত্রেই মা-বাবার তথ্য গুরুত্বপূর্ণ। এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই বয়সীরা মা-বাবার সঙ্গেই থাকেন। তাই ২০১০ সালের প্রশ্নমালা ব্যবহার হলেও ৯ নম্বর প্রশ্নে তাঁদের মা-বাবার জন্ম তারিখ ও জন্মস্থান দিতেই হচ্ছে।
সুতরাং দাবি মেনে নতুন সংযোজিত প্রশ্ন বাদ দিয়ে, হুবহু ২০১০ সালের এনপিআর ফর্মই যদি রেখে দেওয়া হয়, তাহলেও সমস্যা থাকছেই।