বড়দিনের রাত মানেই কলকাতা মিশবে পার্ক স্ট্রিটে, খাওয়া-দাওয়া থেকে হুল্লোড়ের প্রস্তুতি এখন এই রাস্তাজুড়ে

বাঙালির খাই খাই স্বভাবের জন্য কম কথা শুনতে হয় না, তাই বলে বাঙালি কি খাওয়া ছেড়ে দেবে? এক্কেবারে না! মশাই না খেলে বাঙালি বাঁচবে কী করে? আবার কথায় আছে বাঙালির বারো মাসে নাকি তেরো পার্বণ। এই যেমন সামনে ক্রিসমাস, আর বাঙালি ঘরে বসে শুধু  কেক কাটবে, তা তো হতে পারে না। আসলে বড়দিন যে শুধু কেক কাটার দিন নয়, একটা উৎসব বটে। আর এই দিনটায় কলকাতার সব রাস্তা এসে মেশে পার্ক স্ট্রিটে। সারাটা দিন না হয় যেমন তেমন ভাবে কাটল, কিন্তু সন্ধ্যেবেলায় পানীয়তে চুমুক আর তার সাথে খাওয়াদাওয়া তো আমাদের চাই-ই-চাই। আসলে এসব যে বিলীতি কায়দা বলে কেউ কেউ আবার নাক সিঁটকান। কিন্তু ওই যে, আমাদের মধ্যে একটা আত্তীকরণের স্বজাত বৈশিষ্ট্য আছে। আমরা সব কিছুই নিজের করে নিতে পারি।
আসলে ব্রিটিশরা যখন কলকাতায় জাঁকিয়ে বসেছে তখন নাকি তারা আমাদের কল্লোলিনীকে দু’ভাগে ভাগ করে। এসব ভাগ খাতায় কলমে ছিল না, এটা ছিল মানসিকতায়। উত্তর কলকাতা জুড়ে বনেদিয়ানা, রাজবাড়ি, আর আভিজাত্য। সেখানেই বাস করতেন সিংহভাগ বাঙালি। সেই জন্যই নাকি এই উত্তর কলকাতাকে ব্রিটিশরা ‘ব্ল্যাক টাউন’ বলে মনে করতো। নিজেদের সরকারি কাজকর্মের জন্য ডালহৌসি, চৌরঙ্গি চত্বরে গড়ে তোলা হল একের পর এক সরকারি অফিস। ব্রিটিশরা থাকতে শুরু করলেন এই সব চত্বরজুড়ে যাকে কিনা ‘হোয়াইট টাউন’ বলা হোত। এই যেমন এলিজা ইম্পের বিলাস বহুল বাগান বাড়ি, যা ডিয়ার পার্ক নামে পরিচিত ছিল। সেটা থেকেই তো এই পার্ক স্ট্রিটের নামকরণ। নিজেদের মতো করে ব্রিটিশরা সাজাতে শুরু করলেন পার্ক স্ট্রিটকে। গড়ে উঠল রেস্তোরাঁ, পানশালা, নাচা-গানার জায়গা সমূহ। তখন বড়দিন উদযাপনও এনারা এখানেই করতেন। মেমসাহেব আর সাহেবি আদব কায়দা দেখার জন্য বাঙালি ভিড় করতে শুরু করল পার্ক স্ট্রিট চত্বরে। ক্রিসমাস কী এবং কীভাবে উদযাপিত হয় তা জানতে শুরু করল বাঙালি।

ওইটাই ছিল শুরু। এখনও সেই ট্র্যাডিশন চলে আসছে। অনেকে আবার বলেন, সাহেবরা চলে গেছেন কিন্তু সাহেবিয়ানা রেখে গেছেন। তবে যে যাই বলুক তাতে কান দেওয়ার সময় নেই এই ক্রিসমাস সিজনে। পার্ক স্ট্রিটে খাবারের জায়গা বললে একেবারে প্রথম যে নামটা আসবে তা হল ট্রিঙ্কাস। ১৯৪০ এর দশক নাগাদ ট্রিঙ্কাস তৈরি হয়। মিস্টার ট্রিঙ্কা নামক একজন সুইস ভদ্রলোক স্থাপন করেছিলেন ট্রিঙ্কাস। আসল উদ্দেশ্য ছিল স্বদেশীয় ফ্লুরিজকে টক্কর দেওয়া।
‘তখন ট্রিঙ্কাস ছিল নেহাতই টি-রুম। তারপরে ১৯৫৯ সাল নাগাদ এই জায়গাটা কিনলেন আমার বাবা ওমপ্রকাশ পুরি আর এলিস জোসুয়া। ১৯৫৯ সাল থেকেই ট্রিঙ্কাস তার চরিত্র বদলাতে শুরু করল। আমাদের একটা নিজস্ব বেকারি ছিল, যেটা ১৯৮০ সালে বন্ধ করা হয়। তখন থেকে শুধু বার আর রেস্তোরাঁ চলতে থাকে। সেই সঙ্গে সব থেকে বড় আর্কষণ ছিল আমাদের এখানকার লাইভ মিউজিক। অবশ্য সেই সময় এই চত্বরে বেশ নামকরা রেস্তোরাঁ ছিল যেখানে লাইভ মিউজিক হোত। মোলারুজ, ব্লু ফক্স, মোকাম্বো ইত্যাদি রেস্তোরাঁতেও গান হোত। আর আজ আমাদের এখানেই একমাত্র লাইভ পারফরমেন্স পাবেন। আসলে আমরা এটা কখনও বন্ধ করিনি। কিন্তু একটা সময় এসেছিল যখন সরকার থেকে ৩০ শতাংশ কর ধার্য করেছিল, যেখানে লাইভ মিউজিক চলত। তখনই আস্তে আস্তে বাকি সব জায়গায় এই গান বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু আমরা এখনও চালিয়ে যাচ্ছি, একদিনের জন্যও গান এখানে বন্ধ হয়েনি। প্রথমে দেশিয় গান চলে আর তারপর শুরু হয় ওয়েস্টার্ন মিউজিক। একাধিক ব্যান্ডকে সুযোগ দিই আমরা।’ জানালেন ট্রিঙ্কাসের বর্তমান কর্ণধার দীপক পুরি।

আবার একটা ক্রিসমাস, সেজে গুজে তৈরি হচ্ছে ট্রিঙ্কাস বাঙালির রসনা তৃপ্তির জন্য। স্পেশাল লাঞ্চ আর ডিনার তো রয়েছেই, তাছাড়াও রয়েছে নানান রকমের জিভে জল আনা সব পদ। যেটার জন্য বাঙালি একবার না একবার ট্রিঙ্কাসে ঢুঁ মারবেই।
এ তো গেল অর্ধ শতাব্দী পার করে আসা ট্রিঙ্কাসের গল্প। বছর পনেরো হল পার্ক স্ট্রিটে চালু হয়েছে মার্কো পোলো। ‘২০০৪ সালের অক্টোবর মাসে চালু হয়েছিল মার্কো পোলো, তখন নাম ছিল মার্কো পোলো ইন চায়না। প্রথমে চাইনিজ রেস্তোরাঁ হিসেবে শুরু হলেও, পরে অবশ্য আমরা সবরকম খাবার বানাতে শুরু করি। ক্রিসমাসে আমাদের নতুন প্ল্যানিং তো রয়েছেই। তবে একটা কথা না বললেই নয়, আগের সঙ্গে আজকের ক্রিসমাসের অনেক তফাৎ। অনেক সময় আনন্দের উদ্দমতা অন্য মানুষের অসুবিধার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বড়দিনে সামান্য উশৃঙ্খল হয়ে পড়ে এই চত্বর। অনেক মানুষের সমাগম ঘটে ঠিকই, কিন্তু একটু সাবধানতা অবলম্বনও প্রয়োজন বটে। তাই আমরা কয়েক বছর ধরে এই ক্রিসমাস আর নিউ ইয়ার ইভে সারা রাত খোলা রাখছি না। রাত ১২টায় আমাদের রেস্তোরাঁ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।’ কথায় কথায় জানালেন মার্কো পোলোর ম্যানেজার কল্লোল ব্যানার্জি এবং তাপস সেনগুপ্ত। আর বাকি রইল মেনু, মানে ক্রিসমাসের স্পেশাল মেনু। তার কথা জানতে চাইতেই মেনুর লম্বা তালিকা হাতে ধরিয়ে দিলেন মার্কো পোলোর চিফ শেফ মার্ভিন লি। কী নেই সেখানে? স্মোকড হ্যাম অ্যান্ড পাইনাপ্যাল স্যালাড, স্প্যাগেটি উইথ ক্রিমি স্পিনাচ সস, গ্রিল ভেটকি স্টেক, চিকেন ব্রচেটে, গ্রিলড পর্ক চপ, অরেঞ্জ কাস্টার্ড ইত্যাদি। নাম শুনেই কি জিভে জল আসছে? তাহলে দেরি না করে চলে আসাই যায় এখানে।

অর্ধ শতাব্দী প্রাচীন, এক দশক পুরনো সব তো হল, এবার না হয় সদ্য প্রতিষ্ঠিত কোনও রেস্তোরাঁয় যাওয়ার প্ল্যান করেছেন! যেখানে হয়তো একটু নতুন কিছু স্বাদ পেতে পারেন । তাহলে অবশ্যই মামা গোতোতে এসে পড়ুন। ঝাঁ চকচকে এই রেস্তোরাঁর বয়স মাত্র ২ বছর। বয়স কম হলেও পাল্লা দিচ্ছে অন্য রেস্তোরাঁগুলোর সাথে। একটু অন্যরকমভাবে তৈরি করা হয়েছে এই রেস্তোরাঁটি। দেওয়ালজুড়ে বিভিন্ন ছবি, ওপেন কিচেন, লম্বা জায়গা জুড়ে ওয়াইন সেলার। সব সময় হাল্কা মিউজিক। আসলে পুরোটাই ওয়েস্টার্ন কালচারের সামজ্ঞস্য রেখে তৈরি হয়েছে। আর আজকালের অল্প বয়সীরা তো এইরকম অ্যাম্বিয়েন্স খুঁজে বেড়ান,  যেখানে পানীয়তে গলা ভেজানোর পাশাপাশি প্লেটে চলে আসবে বিভিন্ন ধরনের সাইড ডিশ। ‘আসলে আমাদের কাছে কাস্টমার স্যাটিসফেকশনটা খুব জরুরি। একটু ভিন্ন ধরনের স্বাদ দিতে চাই খাদ্যরসিক বাঙালিকে। আমাদের নিজেদের আলাদা সব রেসিপি রয়েছে, যেটা একেবারে আমাদের নিজেদের। যেমন আমাদের এখানে যে সসেজটা পাওয়া যায় সেটা অন্য কোথাও পাবেন না। আমাদের এটা একটা এশিয়ান কুইজিন যেখানে চাইনিজ, জাপানিজ আর তাইওয়ান ফুড পাবেন। আর ক্রিসমাসে আমাদের একটা স্পেশাল মেনু রয়েছে। যাকে আমরা নাম দিয়েছি ‘ওক ট্রাক ফেস্টিভাল’ সেখানে কলকাতাকে আমরা বিভিন্ন স্বাদের চাইনিজ খাবার খাওয়াতে চলেছি। ২৪ শে ডিসেম্বর আর ২৫শে ডিসেম্বর চলবে এই ফেস্টিভাল।’ জানালেন মিলন দত্ত, যিনি মামা গোতোর কর্পোরেশন ম্যানেজার।

আসলে এই পার্ক স্ট্রিটজুড়ে এরকম অজস্র রেস্তোরাঁ রয়েছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। আর ক্রিসমাস থেকে নিউ ইয়ার পর্যন্ত একেবারে জমজমাট পার্ক স্ট্রিট। সেই সঙ্গে সুস্বাদু সব খাবার নিয়ে তৈরি হচ্ছে রেস্তোরাঁগুলো। কয়েক বছর ধরে ১৮ই ডিসেম্বর থেকে ক্রিসমাস সেলিব্রেশন শুরু হচ্ছে, আর চলছে প্রায় নতুন বছরের প্রথম দিন পর্যন্ত। ঝলমলে আলোয় ফুটে উঠবে পার্ক স্ট্রিট চত্বর। মানুষের উৎসাহ কোলাহল চলবে পার্ক স্ট্রিটজুড়ে। আবার বাঙালি উৎসব মুখর হবে। আর এই উৎসবের সব  রাস্তা গিয়ে মিশবে পার্ক স্ট্রিটের অ্যালান পার্কে, যেখানে গান আড্ডায় মুখরিত হবে কল্লোলিনী।

Comments are closed.