তীব্র সাম্প্রদায়িকতার নেপথ্যে পুঁজিবাদের সঙ্কট, মোকাবিলা সম্ভব বিপ্লবী গণ আন্দোলন দিয়েঃ সোশ্যালিস্ট নেট

হিন্দু থেকে বৌদ্ধ, মুসলিম থেকে ক্রিশ্চান, সব ধর্মেই রয়েছেন কট্টরপন্থীরা। আর সাম্প্রতিক ঘটনাবলী থেকে পরিষ্কার, তাদের দাপট ক্রমেই বাড়ছে বিশ্বজুড়ে। কখনও নিউজিল্যান্ড আবার কখনও শ্রীলঙ্কা কিংবা মায়ানমার, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণে ঘটনা ঘটছে। কিন্তু মানুষ যখন বিশ্বজুড়ে বেকারত্ব এবং মূল্যবৃদ্ধির সমস্যায় জেরবার, তখন এই বিষয়গুলোকে পিছনের সারিতে ঠেলে ধর্মীয় ভাবাবেগ কীভাবে সামনে উঠে আসছে? মার্ক্সবাদী পত্রিকা সোশ্যালিস্ট নেট-এ সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বিশ্বজুড়ে বেড়ে চলা ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ করা হয়েছে। ক্রমবর্ধমান সাম্প্রদায়িক হিংসার নেপথ্যে দায়ী করা হয়েছে পুঁজিবাদের সঙ্কটকে।
সোশ্যালিস্ট নেট-এর ‘ধর্মীয় কট্টরপন্থা, কেন বাড়ছে এবং কী এর প্রতিকার’ শীর্ষক প্রতিবেদনে ফ্রেড ওয়েস্টন দেখাচ্ছেন, পৃথিবীজুড়ে প্রাচীন ধার্মিক উপাসনাস্থলগুলো থেকে ইদানিং কীভাবে মুখ ফেরাচ্ছেন মানুষ। ফ্রেড ওয়েস্টন লিখেছেন, ১৯৯০ সাল নাগাদ যেখানে গোটা আমেরিকার ২০.৪ শতাংশ মানুষ সপ্তাহে একদিন হলেও গির্জায় যেতেন, সেখানে ২০০৪ সালে চার্চে যাওয়া মানুষের সংখ্যা কমে হয়েছে ১৭.৭ শতাংশ। একই অবস্থা ইউরোপেও। ইংল্যান্ডের গার্ডিয়ান সংবাদপত্রের একটি প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করে সোশ্যালিস্ট নেট-এ ফ্রেড ওয়েস্টন লিখেছেন, ইউরোপজুড়ে সাধারণ মানুষের উপর প্রভাব হারাচ্ছে অর্থোডক্স চার্চ। তার জায়গা নিচ্ছে নতুন নীতিতে গড়ে ওঠা নিউ চার্চ, যার মূলকথা ধর্মীয় কট্টরপন্থা। গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ইংল্যান্ডে ৭০ শতাংশ যুব সম্প্রদায় কোনও ধর্মের সঙ্গে নিজেদের জুড়তে চাইছেন না। যুব সম্প্রদায়ের ৫৯ শতাংশ আবার জীবনে কোনও দিন কোনও ধার্মিক অনুষ্ঠানে অংশ নেননি। অর্থাৎ, একটা বিষয় পরিষ্কার, যুব সম্প্রদায়ের উপর ক্রমেই কমছে চিরাচরিত চার্চের প্রভাব। আর এই সুযোগ নিয়েই জাঁকিয়ে বসছেন কট্টরপন্থীরা। নতুন চার্চ তৈরি করে সেখানে ধর্মীয় কট্টরপন্থার চর্চা চলছে ইউরোপ-আমেরিকাজুড়ে। পাল্লা দিয়ে কমছে পরধর্ম সহিষ্ণুতা। যুব সম্প্রদায়ের একটা বিশাল অংশের অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে অত্যন্ত সুকৌশলে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে ধর্মীয় কট্টরপন্থা। সোশ্যালিস্ট নেট-এ প্রকাশিত প্রতিবেদনে ফ্রেড ওয়েস্টন জানাচ্ছেন, ভয়ঙ্কর সঙ্কটের মুখে পড়েছে পুঁজিবাদ, নতুন কাজ তৈরি করা যাচ্ছে না। যার অবশ্যম্ভাবী ফল তীব্র বেকারত্ব। আর অন্যদিকে, একই কারণে ক্রমাগত বাড়ছে দারিদ্র। লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে বৈষম্য। ফ্রেড বলছেন, বেকারত্ব এবং দারিদ্রের জোড়া ফলাকে মোকাবিলা করার মত ক্ষমতা আর পুঁজিবাদের নেই। তাই এই বিষয় থেকে মানুষের নজর ঘোরানোর একটাই উপায়। সোশ্যালিস্ট নেট-এর প্রতিবেদনে ফ্রেড লিখছেন, সেই উপায় হল, ধর্মের জিগির। আর সেটাই দুনিয়াজুড়ে চলছে।
সোশ্যালিস্ট নেট-এ লেখা হয়েছে, বেকারত্ব কিংবা দারিদ্রের মতো বুনিয়াদি ইস্যু থেকে সরিয়ে মানুষকে ধর্মীয় কট্টরপন্থার দিকে টেনে আনার একটি প্রয়াস শুরু হয়। যা ক্রমেই ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। আর এখানেই সমালোচনা করছেন ফ্রেড ওয়েস্টন। তাঁর বক্তব্য, পুঁজিবাজের চরম সঙ্কটকালে যেখানে মানুষকে বোঝানো দরকার ছিল বাস্তব পরিস্থিতি, সেখানে বামপন্থীদের অন্তত দশ গোল দিয়েছে পুঁজিবাদের কারবারিরা। অত্যন্ত কৌশলে মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া হল, বেকারত্ব কিংবা দারিদ্র, সবেরই কারণ মানুষের ধর্মের পথ থেকে সরে আসা। সঙ্গে সঙ্গে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিয়ে এই মনোভাবের মোকাবিলা করা উচিত ছিল, কিন্তু বাস্তবে তা হল না।
সোশ্যালিস্ট নেটএর প্রতিবেদনে উঠে এসেছে ভারতের প্রসঙ্গও। সেখানে বিশ্বব্যাপী পুঁজিবাজের সঙ্কটের প্রভাব বোঝাতে বর্তমান ভারতের গতিপ্রকৃতিতে তুলে ধরা হয়েছে। ফ্রেড ওয়েস্টন লিখছেন, নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় বসার পর থেকে এদেশে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে মূলত বিজেপি প্রবর্তিত হিন্দুত্ব। বর্তমানে ক্ষমতাসীন বিজেপি ধর্মীয় মোড়কে বেকারত্ব কিংবা দারিদ্রের মোকাবিলা করতে চাইছে, যা বাস্তবে সম্ভব নয়, বলছে সোশ্যালিস্ট নেট।
তাহলে কি অতি দক্ষিণপন্থা অপ্রতিরোধ্য? এখানেই মোক্ষম কথা বলছেন ফ্রেড ওয়েস্টন। তিনি বলছেন, এই প্রসঙ্গের দিশানির্দেশ রয়েছে মার্ক্স-এঙ্গেলসের কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোর শেষ লাইনে। ফ্রেড লিখছেন, পুঁজিবাজের মুখ থুবড়ে পড়ার দিনে ধর্মীয় জিগিরকে সহায় করে বিশ্বজুড়ে যে অতি দক্ষিণপন্থার বাড়বাড়ন্ত, তা একমাত্র মোকাবিলা সম্ভব বিপ্লবী গণ আন্দোলন দিয়ে। যা পুঁজিবাদের শিকড় উপড়ে প্রতিষ্ঠা করবে মানুষের সরকার। আর এর জন্য প্রয়োজন, বিশ্বব্যাপী মার্ক্সবাদী প্রবণতার অনুশীলন।

Comments are closed.