নির্ভয়া কাণ্ডে ফাঁসি: জেলে কী ঘটে ফাঁসির আগের রাতে? ফাঁসুড়ে নাটা মল্লিকের ছেলে মহাদেব জানালেন নিজের অভিজ্ঞতা

ফের পিছিয়ে গেল নির্ভয় কাণ্ডে অপরাধীদের ফাঁসির দিন। কিন্তু পয়লা ফেব্রুয়ারি ফাঁসি হবে ধরে নিয়ে দিল্লির তিহাড় জেলে প্রায় শেষ ফাঁসির প্রস্তুতি। চার অপরাধীকে ফাঁসি দেওয়ার জন্য তিহাড় জেলের পক্ষ থেকে ফাঁসুড়ে চেয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে উত্তরপ্রদেশ সরকারের কাছে। সূত্রের খবর, ইতিমধ্যেই মেরঠ জেলের ফাঁসুড়ে পবন পৌঁছেও গিয়েছেন তিহাড় জেলে।
কিন্তু জানেন, ফাঁসির আগে কীরকম মানসিক অবস্থা থাকে ফাঁসুড়ের? কী করেন তাঁরা? সত্যিই কি তাঁরা এই পেশায় থাকতে চান? কী বলছেন এরাজ্যের সরকারি তালিকায় নাম থাকা একমাত্র ফাঁসুড়ে মহাদেব মল্লিক? তিনি প্রয়াত ফাঁসুড়ে নাটা মল্লিকের ছেলে। নাটা মল্লিকের দেওয়া একাধিক ফাঁসির ঘটনায় বাবার সঙ্গী হিসেবে ছিলেন মহাদেব মল্লিক।
সরকারি খাতায় ফাঁসুড়ে হিসেবে নাম রয়েছে তাঁর। বাবা ছিলেন পেশাদার ফাঁসুড়ে। তাঁর হাত দিয়ে হয়েছে ২৫ জনের ফাঁসি। কলকাতায় শেষ ফাঁসিটি হয় ২০০৪ সালে, স্কুলপড়ুয়া হেতাল পারেখ হত্যার আসামী ধনঞ্জয় চ্যাটার্জির। তখন মহাদেব মল্লিক ছিলেন বাবার প্রধান সহকারী। ফাঁসুড়ে নাটা মল্লিকের কনিষ্ঠ পুত্র বছর পঞ্চান্নর মহাদেব পেশায় কলকাতা পুরসভার কর্মী।
১৯৯১ সালে বাবার কাছেই এই পেশায় হাতেখড়ি মহাদেবের। ২০০৯ সালে নাটার মৃত্যুর পর এখন কলকাতায় যদি কোনও ফাঁসির সাজা কার্যকর হয় তবে ডাক পড়বে মহাদেবেরই। কারণ, রাজ্যে এখন একমাত্র ফাঁসুড়ে বলতে আছেন তিনিই।
কথা হচ্ছিল টালিগঞ্জের বাড়িতে বসে। নির্ভয়া কাণ্ডে দোষীদেরও মহাদেব ফাঁসি দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেটা আর হয়ে উঠছে না। যখনই ওই চার জনের ফাঁসির আদেশ কার্যকর হোক, তা দেবেন উত্তরপ্রদেশের পবন ফাঁসুড়ে। এ ব্যাপারে কিছুটা আক্ষেপের সুর শোনা গেল মহাদেবের গলায়। কথায় কথায় মহাদেব জানালেন, দাদু শিবলাল মল্লিক ইংরেজ জমানার ফাঁসুড়ে ছিলেন। তারপর বাবা স্বাধীনতার আগে-পরে মিলিয়ে মোট ২৫ জনের ফাঁসি দিয়েছিলেন। ফাঁসি দেওয়ার পর কি কখনও অনুশোচনা হয়েছে? মহাদেবের জবাব, কিছুটা খারাপ তো লাগেই। হাজার হোক, একটা মানুষের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছি। তবে আমি তো খুনি নই। এটা ভেবেও ভালো লাগে যে, সমাজের একটা ভালো কাজ করলাম।
কেমন হয় ফাঁসির আগের প্রস্তুতি? তিনি বলেন, প্রথমে বাড়িতে চিঠি আসে। সেই চিঠি নিয়ে আমরা জেলে গিয়ে সুপারের সঙ্গে দেখা করি। এর পর ফাঁসির মঞ্চ ও দড়ি পরীক্ষা করা হয়। তার কিছুদিন পর হয় ট্রায়াল। এই ট্রায়ালে আসামির ওজনের থেকে ২০-২৫ কিলো বেশি ওজনের বালির বস্তা ঝোলানো হয়। সাধারণত তিনবার হয় এই ট্রায়াল। তবে ধনঞ্জয়ের ফাঁসির সময় পাঁচবার ট্রায়াল হয়েছিল বলে আমার মনে আছে। তিনি জানান, ফাইনাল ট্রায়ালের সময় আসামী ছাড়া উপস্থিত থাকেন জেলের সুপার ও ম্যাজিস্ট্রেট। ফাঁসির আগের রাতে তাঁদের জেলেই থাকতে হয়। দড়িতে কলা ও সাবান মাখাতে হয়। সেদিন রাতে সেরকম কিছুই খাওয়া যায় না।
মহাদেব জানালেন, আসামীকে ফাঁসি দেওয়ার আগে তাঁরা তার কাছে ক্ষমা চান। এরপর তার পা ও হাত দড়ি দিয়ে বাঁধা হয়। মাথায় পরানো হয় কালো টুপি। গলায় ফাঁসির দড়ি পরানো হয়। সুপারের নির্দেশ পেলেই হাতল টানা হয়। এরপর প্রায় ৩০ মিনিটের অপেক্ষা। শেষে নীচে গিয়ে দেহ নামানো হয়। ডাক্তার দেহটি পরীক্ষা করে সার্টিফিকেট দেন।
সকারের তরফ থকে কত টাকা পান? মহাদেব বলেন, ফাঁসি দিলে এককালীন কিছু টাকা দেয় সরকার। আর মাসিক ভাতা বা পেনশন? আমার দাদু ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বেঁচেছিলেন। উনি আমৃত্যু ১৬ টাকা করে মাসে পেতেন।
ধনঞ্জয়ের ফাঁসির সময় সব কাজ নিজের হাতে করেছিলেন মহাদেব। শুধুমাত্র হাতলটি টানা ছাড়া। সেটি টেনেছিলেন বাবা নাটা মল্লিক। মহাদেব বলেন, বাবা বলেছিলেন, আমি যতদিন বেঁচে আছি, ততদিন তোকে হাতল টানতে হবে না। এখন অবশ্য রাজ্যে ফাঁসি হলে মহাদেবকেই হাতল টানতে হবে।
ধনঞ্জয়ের ফাঁসির পর অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন নাটা। তাঁর বয়স তখন ৮৪। সুস্থ হতে বেশ কিছুদিন সময় লেগেছিল। মহাদেবের দুই ছেলে। তাঁরা পড়ুয়া। ছেলেরাও কি এই পেশায় আসবে? সেই সিদ্ধান্ত মহাদেব ছেলেদের উপরই ছেড়ে রেখেছেন।

Comments are closed.