সুগত বসু: উত্তর প্রদেশের ক্রিমিনাল গুমনামী বাবাকে নেতাজি সাজিয়ে যাঁরা সিনেমা করছেন তাঁরা হয় মূর্খ, নয়তো শয়তান

তাইওয়ানের তাইহোকু বিমান দুর্ঘটনার দিনকে নেতাজির তিরোধান দিবস হিসেবে ঘোষণার ঘটনায় তৈরি হয়েছে দেশজোড়া বিতর্ক। এর মধ্যেই এরাজ্যে নেতাজিকে নিয়ে গুমনামী বাবা নামে একটি ছবি তৈরি করছেন পরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায়। গুমনামী বাবার চরিত্রে প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়। পুজোর মধ্যেই মুক্তি পাবে এই ছবি। এবার এবিষয়ে বিস্ফোরক মন্তব্য করলেন নেতাজি পরিবারের সদস্য অধ্যাপক সুগত বসু।

 

প্রশ্ন: গুমনামী বাবাকে নিয়ে বাংলায় ছবি হচ্ছে। এবিষয়ে আপনার মত কী?

ডক্টর সুগত বসু: দেশ স্বাধীন করার জন্য প্রাণ বলিদান দিয়েছিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। তাঁর স্বাধীন করা ভারতবর্ষে আজ তাঁকে অপমান করার স্বাধীনতা কারও রয়েছে! অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক।

 

প্রশ্ন: ছবিটি মুখার্জি কমিশনের তথ্যের উপর নির্ভর করে তৈরি বলে দাবি করছেন সমসাময়িক বাংলার জনপ্রিয়তম পরিচালক। প্রধান চরিত্রে বাংলার জনপ্রিয়তম অভিনেতা। তাহলে নেতাজিকে অপমান কেন বলছেন?

ডক্টর সুগত বসু: আপনি যাঁকে জনপ্রিয়তম চিত্র পরিচালক বলছেন, তাঁর কথা শুনে তো মনে হচ্ছে নেতাজিকে অপমান করা বুঝি তাঁর মৌলিক অধিকারের মধ্যেই পড়ে। ইতিহাসবিদ ও স্বাধীন ভারতবর্ষের একজন নাগরিক হিসেবে এর তীব্র নিন্দা করছি। আর মুখার্জি কমিশনের নামটা আইন-আদালত থেকে বাঁচতে যোগ করা হয়েছে। যাতে বলা যায়, একটা বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশনের কর্ম প্রক্রিয়ার ভিত্তিতে ছবিটি তৈরি। একটি খুব ছোট উগ্র দক্ষিণপন্থী গোষ্ঠী, গত দু’দশক ধরে যাদের ব্যবসাই হচ্ছে এই ক্রিমিনাল গুমনামী বাবাকে নেতাজি বলে চালানো। আসলে তো ছবিটা সেই নির্জলা মিথ্যা বইয়ের ভিত্তিতে হচ্ছে। মনে রাখতে হবে, যাঁরা প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন তাঁরা শাহনওয়াজ কমিটিতে এসে তাঁদের জবানবন্দি দিতে পেরেছিলেন। কেউ কেউ খোসলা কমিশনকেও দিয়েছিলেন। কিন্তু মুখার্জি কমিশন যত দিনে হল, তার মধ্যে বেশিরভাগ প্রত্যক্ষদর্শীই এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গিয়েছেন। তাই যেটা হল, যাঁদের সাক্ষী বলা হয়, তাঁরা আসলে সাক্ষী নয়। যে কেউ, যে কোনও আজগুবি গল্প এসে ওই কমিশনের সামনে বলতে পারত। এখন আমার কথা হচ্ছে, যাঁদের সন্দেহ আছে ১৮ ই অগাস্ট ১৯৪৫ এর বিমান দুর্ঘটনা সম্বন্ধে, যাঁরা একটু বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন, তাঁরা সকলেই স্বীকার করবেন, এটার অন্তত ৯৯ শতাংশ সম্ভাবনা আছে। সেই ঐতিহাসিক তথ্যও রয়েছে। অন্যদিকে একটা আজগুবি গল্প, যেটার জি়রো পসিবিলিটি। এই দুটোকে যে সমান গুরুত্ব দেয়, সে হয় মূর্খ, নয় শয়তান। তিনি ঠিক কী, তা আপনারাই বিচার করবেন।

 

প্রশ্ন: আপনি বলছেন ফেক নিউজ আর ফেক ইতিহাসের সময়ের কথা। তাহলে কি আপনি বলতে চান, নেতাজিকে এই ‘ফেক’ বৃত্তের মধ্যে আনার অপচেষ্টা চলছে?

ডক্টর সুগত বসু: শুধু কি ইতিহাস, এটা বাংলার মানুষের চরম অপমান। উত্তর প্রদেশের একজন অপরাধীকে নেতাজি সাজিয়ে রহস্যের জাল বোনা চলছে। এর চেয়ে বড় লজ্জার আর কিছুই হতে পারে না। এটা বাঙালির অপমান। শিল্পের অপমান। শুনছি পুজোর সময় নাকি সেই রহস্যের উপর থেকে পর্দা উন্মোচিত হবে। আমার বিশ্বাস তরুণ প্রজন্ম বুদ্ধিমত্তা দেখাবেন এবং বিভ্রান্ত হবেন না।

 

প্রশ্ন: আপনি যেমন বলছেন, একটি মিথ্যা ইতিহাসের উপর দাঁড়িয়ে সিনেমা তৈরির কাজ চলছে। সারা দেশে যখন ইতিহাস বিকৃতি বা মিথ্যা ইতিহাসের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বলে বিজেপি বিরোধীরা অভিযোগ করছেন। সেই সময়ে দাঁড়িয়ে বাংলার বুকে এটা কেন করা হচ্ছে বলে আপনার মনে হয়?

ডক্টর সুগত বসু: আসলে টালিগঞ্জের প্রযোজক, অভিনেতাদের মধ্যে কয়েকজন পড়েছেন ভারি মুশকিলে। বেআইনি অর্থলগ্নি সংস্থার রমরমার সময় যেমন ইজি মানির একটা ব্যাপার ছিল, এখন আর সেটা নেই। তাই পুজোর সময় আজগুবি সমস্ত গপ্প সত্যির মোড়কে মুড়ে বাজারে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। যাতে অর্থ উপার্জনে সমস্যা না হয়। নেতাজিকে এত বড় অপমান আমি আমার জীবনে দেখিনি। এটা চরম অপমান।

 

প্রশ্ন: একটা বিরাট সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় ফিরেছে বিজেপি। অনেকেই বলছেন ‘আইডিয়া অফ ইন্ডিয়া’ আজ প্রশ্নের মুখে। এমন একটা সময় আপনি পার্লামেন্টে নেই। আপনার মনে হয় না, যে ‘আইডিয়া অফ ইন্ডিয়া’কে ডিফেন্ড করে গেলেন গত ৫ বছর। আজ সেটা আরও বেশি দরকার ছিল?

ডক্টর সুগত বসু: সরাসরি রাজনৈতিক বৃত্তে নেই কিন্তু জনজীবনে আমি আছি এবং থাকব। ক’দিন আগেই সাবরমতী আশ্রমে দাঁড়িয়ে বলেছিলাম, ‘we are becoming unthinking worshippers of state power’. ব্যাপারটা হল, আমরা দেশপ্রেম ভুলে গেছি। দেশকে কীভাবে ভালোবাসতে হয় ভুলে গেছি। সব হারিয়ে আমরা এখন রাষ্ট্রশক্তির একনিষ্ঠ পূজারী হয়ে উঠেছি। দেখছেন না চারদিকে অ্যান্টি ন্যাশনাল বলে দাগিয়ে দেওয়ার রেওয়াজ চলছে।

 

প্রশ্ন: তৃণমূলে কবে ফিরছেন?

ডক্টর সুগত বসু: এখন শুদ্ধকরণের একটা প্রচেষ্টা দেখতে পাচ্ছি। আশা করি সেটা আরও ভালোভাবে হবে এবং এগোবে। আমি আমার মূল্যবোধ আঁকড়ে ধরে রেখেই রাজনীতি ও সমাজজীবনে থাকব। এই মুহূর্তে ভালো এবং জোরালো বিরোধীর খুব দরকার। এই মুহূর্তে বিরোধীরা সত্যিই খুব ছন্নছাড়া অবস্থায় আছেন।

Comments are closed.