কে চন্দ্রশেখর কুণ্ডু, আসানসোলের ‘ফুডম্যান’ থেকে আজ তৃণমূলে? কেন এলেন রাজনীতিতে?

পরিচিতদের অবাক করে শুক্রবার তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন আসানসোলের সমাজকর্মী চন্দ্রশেখর কুণ্ডু। সোশ্যাল মিডিয়ায় যিনি পরিচিত ‘ফুডম্যান’ হিসেবে। কেন তিনি রাজনীতিতে? কোন ঘটনার প্রেক্ষিতে শিক্ষক চন্দ্রশেখর ব্রতী হলেন রাজনীতিতে?

বছর চারেক আগের একটি রাত। সেদিন ছেলের জন্মদিন উপলক্ষ্যে একটা পার্টি দিয়েছিলেন আসানসোল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের শিক্ষক চন্দ্রশেখর কুণ্ডু। আমন্ত্রিতরা চলে যাওয়ার পর বেশ কিছুটা খাবার বেঁচে যায়। ব্যাঙ্কোয়েট থেকে বলা হয় খাবারগুলো বাড়ি নিয়ে যান। দু কামরার ছোট্ট ফ্ল্যাট, ছোট্ট রেফ্রিজারেটর, বাড়িতে সদস্য সংখ্যাও পাঁচ। কী করবেন অত খাবার নিয়ে… অগত্যা ডাস্টবিনের দিকে পা বাড়িয়েছিলেন চন্দ্রশেখরবাবু। আর সেখান থেকেই শুরু ‘ফুড ম্যান’ চন্দ্রশেখর কুণ্ডুর যাত্রা। ডাস্টবিনে বাড়তি খাবারগুলো ফেলে দিয়ে তিনি উল্টোদিকের এটিএম কাউন্টারে ঢুকেছিলেন। এটিএম কাউন্টার থেকে টাকা তুলে বেরতেই তাঁর চোখ আটকায় সেই নোংরা ডাস্টবিনের দিকে। চন্দ্রশেখর দেখেন একটা বাচ্চা কারও ফেলে যাওয়া উচ্ছিষ্ট বিরিয়ানি খুঁটে খাচ্ছে, সেইসঙ্গে মাংসের টুকরোগুলো একটা প্লাস্টিকের প্যাকেটে ভরছে বাড়ি নিয়ে যাবে বলে। তার পাশে দাঁড়িয়ে অন্য একটা বাচ্চা পাহারার কাজে। ছেলের জন্মদিনে দুই শিশুকে ওই অবস্থায় দেখে জোর ধাক্কা খান চন্দ্রশেখর। বাচ্চাদুটোকে সঙ্গে নিয়ে সোজা হাঁটা দেন বাড়ির দিকে। স্ত্রীকে বলেন ওদের কিছু খাবার করে দিতে। কিন্তু সেদিন তো বাড়িতে রান্নাই হয়নি। কয়েকটা ডিম ছিল। সেগুলি দিয়ে অমলেট বানিয়ে দেন চন্দ্রশেখরের স্ত্রী। তার সঙ্গে ছেলের জন্মদিনে পাওয়া চকোলেট, মিষ্টি এসব প্যাকেটে ভরে বাচ্চাদুটোকে বাড়ি পাঠান তিনি।

কিন্তু ছেলের জন্মদিনে এই ঘটনার ধাক্কা এমনই ছিল যে সারা রাত দু’চোখের পাতা এক করতে পারেননি চন্দ্রশেখর। চোখ বুজলেই ভেসে উঠেছে বাচ্চা দুটোর মুখ। পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই কম্পিউটারে বসে পড়েন। গুগলে সার্চ করেন কত খাবার নষ্ট হয় তার একটা পরিসংখ্যান জানতে। সেখানে চন্দ্রশেখরের জন্য অপেক্ষা করছিল আর একটা চমক। সার্চ রেজাল্টে দেখায়, আমরা ৮৮ হাজার কোটি টাকার খাবার স্রেফ উচ্ছিষ্ট হিসেবে ফেলে দিই। চন্দ্রশেখর কুণ্ডুর কথায়, যে অর্থের ১০ শতাংশ বরাদ্দ হয় আমাদের দেশের মিড ডে মিল প্রকল্পের জন্য! তিনি ভাবতে থাকেন অন্তত এই বাড়তি খাবারের কিছুটাও যদি বাঁচাতে পারেন সেখান থেকেই ভরপেট খাবার জুটবে গত রাতে দেখা পাওয়া এমন প্রচুর শিশুর। এভাবেই শুরু হয় সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘ফুড ম্যান’ হিসেবে পরিচিত চন্দ্রশেখর কুণ্ডুর সমাজসেবার কাজ।

নিজের কলেজ ক্যান্টিনে বেঁচে যাওয়া খাবার নিয়ে পৌঁছে যেতেন অভুক্ত পথশিশুদের কাছে। তারপর কয়েকটি অফিস, সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ হয় তাঁর। চন্দ্রশেখরের উদ্যোগে সাড়া দিতে এগিয়ে আসেন তাঁর বন্ধুবান্ধব ও পরিচিত মানুষরা। সবাই মিলে তৈরি করেন কমিউনিটি কিচেন। এখন তিন জায়গা থেকে চলা সেই কমিউনিটি কিচেনে প্রতিদিন দেড়শো শিশু পেটভরে খায়। প্রায় তিন লক্ষ খাবারের প্লেট বানিয়ে দান করেছেন ইতিমধ্যে। তাছাড়া পুরনো জামা-কাপড় জোগাড় করে সেগুলো গরিবদের মধ্যে ভাগ করে দেন। এভাবে পুরুলিয়া, বাঁকুড়ার বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন সমাজসেবামূলক কাজে যুক্ত চন্দ্রশেখরবাবু। একই সঙ্গে অভাবের সংসারে স্কুলছুট শিশুদের ফের স্কুলে যাওয়ার ব্যবস্থা করে চলেছেন তিনি। সঙ্গে রয়েছে যৌন কর্মীদের নিয়েও নিরলস কাজ। আসানসোল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের সঙ্গে যুক্ত থাকা চন্দ্রশেখর প্রায় দু’মাস ছিলেন ঘূর্ণিঝড় আমফান পরবর্তী সুন্দরবনে। সেখানে গরিব, অসহায় মানুষদের মুখে তুলে দিয়েছেন খাবার, তৈরি করে দিয়েছেন ঘর। নোনা জল ঢুকে যাওয়া পুকুর সংস্কারের কাজে সহায়তা করেছেন। চন্দ্রশেখর বাবুর কথায়, শিশুদের মধ্যে অপুষ্টি কমানোই তাঁর লক্ষ্য। ২০১৫ সালে এ নিয়ে একটি আরটিআই করেছিলেন। জানতে পারেন, ফুড কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া থেকে ২২ হাজার মেট্রিক টন খাদ্য শস্য গুদামে পচে নষ্ট হয়। যা দিয়ে এক কোটি শিশুকে একমাস মিড ডে মিল খাওয়ানো যায়। এ নিয়ে সরকারি দফতরে বেশ কিছুদিন চিঠিচাপাটিও চালান। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। তাই কি এবার রাজনীতিতে?

চন্দ্রশেখর কুণ্ডুর কথায়,”দেশের পলিসি মেকিং কোনও শিক্ষক বা চিকিৎসক করেন না, করেন রাজনীতিকরা। তাই রাজনীতিতে না এলে আমি এই পলিসি মেকিংয়ের অংশ হতে পারব না।” ‘ফুড ম্যান’ আরও বলেন, সক্রিয় রাজনীতিতে না এলে খাবার অপচয় বন্ধ করা, অপুষ্টি কমানোর মতো এ দেশের পুরনো সমস্যা সমাধানের কাজেও অংশ নিতে পারব না। যেহেতু তৃণমূলের প্রধান কার্যালয় এ রাজ্যেই তাই বাইরের কোনও রাজনৈতিক দল নয়, মমতা ব্যানার্জির দলকে বেছে নিয়েছি। তাছাড়া রাজ্যের শাসক দলের জনমুখী প্রকল্প ও উদ্যোগেরও প্রশংসা চন্দ্রশেখর কুণ্ডুর গলায়। তিনি বলেন, অন্যান্য ক্ষেত্রের মানুষ আজকাল রাজনীতিতে যোগ দিতে ভয় পান। এই অমূলক ভয়টাকে কাটানো দরকার। চন্দ্রশেখর বাবু জানান, অনেক প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিত্ব তাঁর রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন। আগামী দিনে আরও বেশি মানুষের কাছে পৌঁছনো, নিরন্তর সমাজসেবাই আমার লক্ষ্য, বলেন সদ্য তৃণমূলে যোগ দেওয়া ফুডম্যান চন্দ্রশেখর কুণ্ডু।

Comments are closed.