কেন থমাস পিকেটিকে আজকের মার্ক্স বলছেন অর্থনীতিবিদরা? বৈষম্য নিয়ে এই ফরাসি অর্থনীতিবিদের তত্ত্বে কেন তোলপাড় দুনিয়া?
বৈষম্য কোনও দুর্ঘটনা নয়, বরং তা পুঁজিবাদের অন্যতম বৈশিষ্ট। এই পরিস্থিতির বদল হতে পারে একমাত্র রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের মাধ্যমে। বর্তমান চেহারার পুঁজিবাদের আমূল সংস্কার না হলে তার কুপ্রভাব এসে পড়বে গণতন্ত্রের উপর।
উপরের কথাগুলো ফরাসি অর্থনীতিবিদ থমাস পিকেটির ‘ক্যাপিটাল ইন দ্য টোয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি’ বইয়ের নির্যাস বলতে পারেন। যা নিয়ে কার্যত তোলপাড় পড়ে গিয়েছে দুনিয়ার রাজনৈতিক মহলে। অষ্টাদশ শতাব্দীর ইউরোপ ও আমেরিকা বইয়ের প্রতিপাদ্য হলেও বৈষম্যের চেহারা যে পৃথিবী জুড়েই এক। তাই অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইউরোপ-আমেরিকায় দেখানো বৈষম্যের প্রেক্ষাপটের সঙ্গে হুবহু মিলে যায় বর্তমান দুনিয়ার বৈষম্যের হাল হকিকত।
আরও জানতে ক্লিক করুন, ভারতের ৯ বিলিওনিয়ারের সম্পদ ৫০% জনসংখ্যার সম্পদের সমান, কী বলেছিল অক্সফাম রিপোর্ট?
নিউ ইয়র্ক টাইমসের বেস্ট সেলার লিস্টে কার্যত স্থায়ী জায়গা করে নেওয়া থেকে দ্য ইকনমিস্টে পিকেটির মতামতের পূর্ণাঙ্গ বিশ্লেষণ, হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি প্রেসের ইতিহাসে সর্বকালের সর্বাধিক বিক্রি হওয়া বইয়ের তকমা, ফরাসি অর্থনীতিবিদ থমাস পিকেটিকে দিয়েছে গ্লোবাল পরিচিতি। ইদানীং লন্ডন স্কুল অফ ইকনমিক্সের প্রাক্তনীকে ডাকা হচ্ছে নয়া মার্ক্স রূপে। কিন্তু কার্ল মার্ক্সের সঙ্গে থমাস পিকেটির তুলনা হচ্ছে কেন?
ক্যাপিটাল নামে বই লিখেছেন বলেই কি কিংবদন্তি জার্মান দার্শনিকের সঙ্গে তুলনা? পিকেটিতে বুঁদ অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মোটেও তা নয়। পিকেটি আসলে মার্ক্স বর্ণিত পুঁজির চলনের সমসাময়িক পটচিত্র এঁকেছেন। যা মার্ক্সের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে এক নতুন চোখে বিশ্ব দর্শন।
বর্তমান বিশ্বে পুঁজিবাদের রমরমা থমকে গিয়েছে। কিন্তু আচমকা তৈরি হওয়া স্থবিরতা থেকে মুক্তির পথ খুঁজে পাচ্ছে না বিশ্ব অর্থনীতি। লাভের রসদ তলা অবধি তো পৌঁছচ্ছেই না, উল্টে তা আরও বেশি করে পুঞ্জীভূত হচ্ছে সমাজের একেবারে উপর তলায়। যার অবশ্যম্ভাবী ফল, বৈষম্য বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। প্রথম বিশ্বের ইংল্যান্ডে যা চিত্র, একই চিত্র তৃতীয় বিশ্বের ভারত বা ব্রাজিলেও। পিকেটির মুন্সিয়ানা হল বৈষম্যের নেপথ্য কারণগুলোকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ায়।
২০১৩ সালের অগাস্টে Capital in the Twenty-First Century বই প্রকাশিত হয় ফরাসি ভাষায়। তাতে অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইউরোপ ও আমেরিকায় সম্পদ ও আয়ের বৈষম্য নিয়ে নিজের মতামত জানিয়েছেন থমাস পিকেটি। বই প্রকাশ হতেই তোলপাড় পড়ে যায় ফ্রান্সে। ২০১৪ সালের এপ্রিলে বাজারে আসে মূল বইয়ের ইংরেজি অনুবাদ। অনুবাদ করেন আর্থার গোল্ডহামার।
কী আছে বইয়ে?
বইয়ের মূল বক্তব্য হল, দীর্ঘ মেয়াদে পুঁজির রেট অফ রিটার্নের হার অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হারের চেয়ে বেশি হলে সম্পদের পুঞ্জীভবন হয়। আর সম্পদের এই অসম বণ্টন সরাসরি ইন্ধন যোগায় সামাজিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতায়। বইয়ে পিকেটি প্রগতিশীল সম্পদ কর বা প্রোগ্রেসিভ ওয়েলথ ট্যাক্সকে এই অসাম্য বা বৈষম্য দূর করতে অন্যতম হাতিয়ার বলেছেন। এর ফলে বিপুল পরিমাণ সম্পদ এক ব্যক্তি বা সংস্থার কাছেই গচ্ছিত হওয়ার প্রবণতা কমানো সম্ভব বলেও দাবি থমাস পিকেটির।
বইয়ে দেওয়া অর্থনৈতিক যুক্তির ভিন্নমতও রয়েছে। কিন্তু একটা বিষয় নিয়ে বাদী-বিবাদী কোনও পক্ষেরই আপত্তি নেই তা হল, বর্তমান বিশ্বে হু-হু করে বেড়ে চলা বৈষম্য। যে বৈষম্য ডেকে আনছে বিশ্বজুড়ে অস্থিরতা। ব্রিটেনের ভোটে লেবার পার্টি পর্যুদস্ত হলেও, থমাস পিকেটির মতামতের সোচ্চার সমর্থক ব্রিটিশ জনসাধারণও।
শুধুই কি প্রথম বিশ্ব?
থমাস পিকেটি বর্ণিত বৈষম্যের চক্রব্যূহতে ধরা পড়েছে ভারতের মতো উন্নয়নশীল অর্থনীতিও। বিভিন্ন সমীক্ষায় বারবার ধরা পড়েছে ভারতের সামগ্রিক বৃদ্ধিকে বলে বলে দশ গোল দিচ্ছে কতিপয় সুপার রিচের সম্পদ বৃদ্ধি। অথচ গরিব আরও গরিব হচ্ছে। বাড়ছে গণ অসন্তোষ। তাই পিকেটির দাবি, ভয়াবহ পরিস্থিতি নিরাময়ে এখনই রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ একান্ত প্রয়োজনীয়। কারণ, এই বেড়ে চলা অসন্তোষের পথ ধরেই অশান্তির অনুপ্রবেশ পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলবে বলাই বাহুল্য।