বনেদি বাড়িগুলোর শিকড় খুঁজেছেন এক প্রাচীন পরিবারের সদস্য; নিজের প্রথম বই নিয়ে কথা বললেন ইতিহাস গবেষক শুভদীপ 

বাংলার প্রাচীন বনেদি পরিবার সাবর্ণ রায় চৌধুরী বংশের বর্তমান সদস্য। পড়াশোনাও করেছেন ইতিহাস নিয়ে। আর সেই ইতিহাস প্রেম থেকেই কলকাতার প্রাচীন বনেদি পরিবারের এবং তাদের দূর্গা পুজোর অতীত নিয়ে খানা তল্লাশি চালিয়েছেন শুভদীপ রায় চৌধুরী। দীর্ঘ চার বছরের গবেষণায় লিখেছেন ‘বনেদি কলকাতার দুর্গোৎসব।’ সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবারের মেজ বাড়িতে ১৭ সেপ্টেম্বর বইটি অনুষ্ঠানিক ভাবে প্রকাশিত হতে চলেছে। নিজের প্রথম বই নিয়ে TheBengalStory-এর সঙ্গে কথা বললেন লেখক। 

শোভাবাজার দেব পরিবার, সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবার, বাগবাজার হালদার পরিবার, হাটখোলার দত্ত পরিবার, সার্দান এভিনিউয়ের ঘোষ রায় পরিবার, কলুটোলার মতিলাল শীল পরিবার এবং ভবানীপুরের মিত্র পরিবার। ‘বনেদি কলকাতার দুর্গোৎসব’ বইটিতে মূলত কলকাতার এই সাতটি বনেদি পরিবারের কথা লিখেছেন শুভদীপ। কলকাতায় তো অনেকগুলো বনেদি পরিবার রয়েছে, তাহলে শুধু  এই সাতটিই কেন? “দেখুন এই সাতটি পরিবারকে বেছে নেওয়ার কারণ, দূর্গা পুজো নিয়ে আমার বই হলেও শুধু পুজোর মধ্যে এই পরিবারগুলোকে আবদ্ধ রাখতে চাইনি। প্রেত্যেকটি পরিবারের শিকড়টা খোঁজার চেষ্টা করেছি। প্রথম তাঁরা কোথায় ছিলেন, কেন তাঁরা পুজো শুরু করেছেন? বাঙালির সমাজ সংস্কৃতিতে সেই পরিবারের কিছু উল্লেখযোগ্য মানুষের অবদান বিস্তারিতভাবে লেখার চেষ্টা করেছি। এক কথায় পাঠক শুধু পুজোর ইতিহাস নয়, বইটি পড়ে বনেদি বাড়িগুলোর ইতিহাসের একটি দলিল পাবেন। ইচ্ছে আছে, দ্বিতীয় খণ্ডে বাকি কিছু পরিবার নিয়ে লিখব।” 

শুভদীপের কথায়, ছোট থেকেই ইতিহাস বিষয়টি তাঁকে খুব টানত। বিদ্যাসাগর ইউনিভার্সিটিতে স্নাতকোত্তর পড়াশোনার সময় স্পেশাল পেপার ছিল মুর্শিদাবাদ নিয়ে। পরে রাজ্যের প্রত্নতত্ব গবেষণা কেন্দ্র থেকে কলকাতার কালীঘাট অঞ্চল নিয়ে গবেষণা করেছিলেন। সেই সময় বনেদি বাড়ির ইতিহাস নিয়ে কাজ করার পরিকল্পনা মাথায় আসে। আপনি নিজে একজন প্রাচীন বনেদি পরিবারের সদস্য। সেক্ষেত্রে বইটি লিখতে গিয়ে বাড়তি কোনও সুবিধা বা অসুবিধা অনুভব করেছেন? “দেখুন সাবর্ণদের বাড়ির ছেলে বলে যে বিশেষ সুবিধা পেয়েছি তেমন নয়। তবে ওই সাতটি পরিবারের সদস্যরাই আমায় খুবই সহযোগিতা করেছেন। আমি ঘন্টার পর ঘন্টার ওঁদের সঙ্গে কথা বলেছি। পরিবারের বিভিন্ন তথ্য, দলিল দস্তাবেজ দেখেছি। পুজোর দিনগুলোতে নিজে গিয়ে পুজোর প্রথাগুলো দেখেছি।” শুভদীপ জানালেন, দীর্ঘ চার বছরের গবেষণার ফসল ‘বনেদি কলকাতার দুর্গোৎসব’।’’ 

 

কথায় কথায় শুভদীপ জানালেন, তথ্য তল্লাশি করতে গিয়ে বনেদি বাড়ির পুজো নিয়ে বেশ কিছু চমকপ্রদ তথ্য পেয়েছেন। পাশাপাশি  বনেদি বাড়ির পুজো নিয়ে লেখা অনেক ইতিহাসকেই নিজের বইতে নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছেন। বললেন, “সাধারণত মা দূর্গার গায়ের রং হলুদ হয়। কিন্তু দক্ষিণ কলকাতার সার্দান এভিনিউয়ের একটি বাড়ি রয়েছে। ওই বাড়ির পুজোয় মায়ের গাত্রবর্ণ শ্যামা। এরকমটা আমি আগে দেখিনি”।  সেই সঙ্গে উত্তর কলকাতার বিখ্যাত শোভাবাজার রাজবাড়ীর পুজো নিয়ে কথা বলতে গিয়ে শুভদীপ বলনে, “দেখুন পুজো যে একটা উৎসব হতে পারে সেটা প্রথম দেখিয়েছিল শোভাবাজার রাজবাড়ি। সেই সময় পুজোর যে বৈভব, যে জৌলুস তা আজও কলকাতার মানুষ ভাবতে পারবে না।” তাঁর কথায়, “আমরা ছোটবেলা থেকে জেনে এসেছি পলাশী যুদ্ধের জয় উপলক্ষ্যেই ১৭৫৭ সালে নবকৃষ্ণ দেব পুজোর সূচনা করেছিলেন। কিন্তু আমার তা মনে হয়না। রাজা নবকৃষ্ণ দেবের হিন্দু ধর্মের প্রতি অনেক অবদান ছিল। আমার মনে হয়, উনি এমন একটি পুজো করতে চেয়েছিলেন যেটি আক্ষরিক অর্থেই মিলন উৎসব হয়। উনি মুসলিম, খ্রিষ্টানদের পুজোয় আমন্ত্রণ করেছিলেন। সেই সঙ্গে সাধারণ প্রজাদেরও পুজোতে সামিল করেছিলেন। উনি পুজোর মধ্যে দিয়ে যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন, যা নিয়ে আমার বইতে বিস্তারিত লিখেছি।” 

 

কলকাতার প্রথম পুজো সাবর্ণদের নাকি শোভাবাজার রাজবাড়ির তা নিয়ে একটা অলিখিত দ্বন্দ চলেই, এ নিয়ে কিছু বলবেন? দেখুন, “দ্বন্দ ঠিক নয়। তবে এটি নিয়ে একটা চর্চা হয়। কিন্তু আমি বিষয়টিকে অন্যভাবে দেখেছি। আমাদের বাড়ির পুজো শোভাবাজারের দেবদের থেকে অনেক পুরোনো। কিন্তু কলকাতা, গোবিন্দপুর, সুতানটি তিনটে গ্রাম নিয়ে যখন কলকাতা গড়ে উঠছে। তখন কিন্তু বরিশা অর্থাৎ আমাদের পরিবারের বাসস্থান। সেটি অনেক উন্নত গ্রাম। এবং বরিশা তখনও কলকাতার অংশ নয়। সে দিক থেকে দেখলে কলকাতার প্রথম পুজো শোভাবাজার রাজ্ বাড়িরই পুজো”।   

 

শুধু কলকাতার বনেদি বাড়ির পুজোই নয়, দুর্গাপুজো কবে থেকে শুরু, তারও শিকড় সন্ধান করেছেন শুভদীপ। বইতে সে নিয়ে একটি পৃথক চ্যাপ্টারও রেখেছেন। সেই সঙ্গে ইতিহাস বিমুখতা নিয়েও ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন তরুণ গবেষক। “খুব দুঃখের সঙ্গেই বলছি, কলকাতার মানুষ একদমই ইতিহাস সচেতন নন। ইতিহাস সচেতন হলে কোনও দিনও জব চার্ণককে কলকাতার জনক বলতেন না। এটি নিয়ে কোর্টের রায়ও রয়েছে”। লেখকের আবেদন, “কলকাতার দূর্গা পূজাকে উপলব্ধি করতে হলে অবশ্যই বনেদি বাড়ির পুজোগুলো ঘুরে দেখতে হবে। বনেদি বাড়ির যে অতীত, ঐতিহ্য, সাবেকিয়ানা তা আর কোথাও পাবেন না। একজন কলকাতা প্রেমী হিসাবে বলব, পুজোতে শুধু বারোয়ারী প্যান্ডেলে গিয়েই সেলফি নয়, সঙ্গে নিজের প্রিয় শহরের প্রাচীন ইতিহাস জানুন। শতাব্দী পুরোনো বনেদি বাড়িগুলোর ঠাকুরদালানে গিয়ে প্রাচীনত্বকে অনুভব করুন। একটু অন্যরকম পুজো কাটান”  

   

 

 
  

 

Comments are closed.