ধনতেরাস-দীপাবলীতে ২৪ ঘন্টায় দেশে বিক্রি ৬০০ মার্সিডিজ, ৩০ টন সোনা! মন্দার ভারতে প্রকট আর্থিক বৈষম্য

অর্থনীতিতে প্রবল মন্দা। বস্ত্র থেকে বিস্কুট, অন্তর্বাস থেকে গাড়ি কিংবা গয়না, বিক্রি হচ্ছে না কিছুই। সদ্য নোবেলজয়ী অভিজিৎ বিনায়ক ব্যানার্জির মুখেও উঠে এসেছে মন্দা আক্রান্ত ভারতীয় অর্থনীতি নিয়ে উদ্বেগের কথা। এর মধ্যেই ফোর্বসের ধনী ভারতীয়ের তালিকায় চমকপ্রদ উত্থান হয়েছে গৌতম আদানির। বিপুল সম্পত্তি বেড়েছে মুকেশ আম্বানী সহ সমস্ত সুপার রিচ ভারতীয়রই। কিন্তু প্রদীপের তলায় অন্ধকারের মতোই, এ বছরও হাঙ্গার ইনডেক্সে ভারতের স্থান তলানিতে। দেশে একদিকে বাড়ছে দারিদ্র, অন্যদিকে ধনীরা হচ্ছেন আরও ধনী। ঠিক যে বৈষম্যের কথা বারবার বলছেন প্রভাত পট্টনায়কের মতো অর্থনীতিবিদরা। আইএমএফের মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা গীতা গোপীনাথ এই বৈষম্য দূরীকরণে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে সরকারি ব্যয় বরাদ্দ বাড়ানোর পক্ষে সওয়াল করেছেন। এই প্রেক্ষিতে সামনে এল বৈষম্যের আরও এক ছবি।
ধনতেরাস এবং আলোর উৎসব দীপাবলিতে উপহার দেওয়া এবং নতুন জিনিস কেনাটাই দস্তুর। কিন্তু মন্দার প্রভাবে যেভাবে বিক্রি কমছে, তাতে ব্যবসায়ীদের মনে সন্দেহ ছিল, এ বছর সেই দস্তুর না ভেঙে যায়। কিন্তু চমকপ্রদ ব্যাপার হল, ধনতেরাস এবং দীপাবলি উপলক্ষ্যে মাত্র ২৪ ঘণ্টায় দেশে বিক্রি হয়ে গেল ৬০০ টি বহুমূল্য মার্সেডিজ বেঞ্জ এবং ৩০ টন সোনা। যে দেশের অর্থনীতি মন্দায় আক্রান্ত, যে দেশ ক্ষুধা তালিকার তলানিতে, সেখানে মাত্র ১ দিনের মধ্যে এমন বহুমূল্য গাড়ি এবং কাড়ি-কাড়ি সোনা বিক্রি হয় কী করে! আর এই সোনা, বহুমূল্য গাড়ি বিক্রির হিসেব দেখেই অর্থনীতিবিদদের একাংশ বলছেন, এই বৈষম্যের কথাই তাঁরা বলছিলেন এতদিন ধরে।
কেবলমাত্র ধনতেরাসের দিন দেশে ৬০০ টি বহুমূল্য মার্সেডিজ-বেঞ্জ বিক্রি হয়েছে। ভারতে এই জার্মান লাক্সারি কার নির্মাণ সংস্থার গাড়ির সর্বনিম্ন মূল্য ৩০ লক্ষ টাকা। দিল্লি, মুম্বই, কলকাতা, পুণে, গুজরাত এবং পাঞ্জাবে এই গাড়িগুলো বিক্রি হয়েছে বলে মার্সেডিজ-বেঞ্জ সূত্রে খবর। কেবলমাত্র দিল্লিতে ২৫০ টি মার্সেডিজ-বেঞ্জ বিক্রি হয়েছে। শুধু কি ধনতেরাস, দশেরার দিনও মুম্বই ও গুজরাতে মার্সেডিজ-বেঞ্জ বিক্রি হয়েছে ২০০ টি। ফলে চলতি উৎসবের মরসুমেই মার্সেডিজ-বেঞ্জ ৮০০ টি বহুমূল্য গাড়ি বিক্রি করে ফেলেছে। যা সংস্থার কাছে রেকর্ড।
শুধু মার্সেডিজ-বেঞ্জই নয়, সদ্য এদেশে ব্যবসা শুরু করা ব্রিটিশ গাড়ি নির্মাণ সংস্থা এমজি হেক্টর ধনতেরাসের দিন একাই বিক্রি করেছে ৭০০ এসইউভি। তার মধ্যে ২৫০ এসইউভি ডেলিভারি করা হয়েছে শুধুমাত্র দিল্লি-এনসিআরে। ভারতে এমজি হেক্টরের প্রারম্ভিক দাম ১৩ লক্ষ টাকা।
এতো গেল গাড়ির কথা, এবার আসুন সোনায়। বেশ কয়েকদিন হয়ে গেল, সোনার দাম আকাশ ছুঁয়েছে। কিন্তু তাতে সুপার রিচ ভারতীয়দের কীই বা আসে যায়! ইন্ডিয়ান বুলিয়ন অ্যান্ড জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশন (আইবিজেএ) জানাচ্ছে, ধনতেরাসের ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই দেশে বিক্রি হয়ে গিয়েছে ৩০ টন সোনা। অথচ গতবার ধনতেরাসের দিন সোনার যা দাম ছিল, এবার দাম অনেকটা বেশি। দাম আকাশ ছোঁয়ার কারণে স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা ভেবেছিলেন, এবার হয়ত বিক্রি কমবে। কিন্তু কোথায় কী! আইবিজেএর সাধারণ সম্পাদক সুরেন্দ্র মেহতা জানাচ্ছেন, দিনভর তাঁরা বিক্রি করেছেন ৩০ টন সোনা। ধনতেরাসের দিন ভারতে প্রতি ১০ গ্রাম সোনার দাম ছিল ৩৮,২৭৫ টাকা। এবার হিসেব করুন ৩০ টনের দাম কত।
তাহলে এটাই কি ভারতের সামগ্রিক চিত্র? অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মোটেও না। তাঁদের দাবি, এই চিত্র আসলে ভারতের আকাশ ছোঁয়া বৈষম্যের কথাকেই মান্যতা দেয়। দেশের ক্রমবর্ধমান দারিদ্রের সঙ্গে ব্যস্তানুপাতিক প্রতিযোগিতা চলছে কতিপয় ভারতীয়র ধনবৃদ্ধির, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বহুমূল্য ভোগ্যপণ্যের এমন ঢালাও বিক্রি, সেই সত্যিকেই প্রতিষ্ঠিত করল।

Comments are closed.