শাবল, লাঙল হয়ে উঠছে রাজদণ্ড
ধূসর সোনাতেই সাজানো হবে শৃঙ্গার
থমকে শুনি সময় রথের ঘরঘর ধ্বনি
সিংহাসন খালি কর জনতা আসছে।
(কবি রামধারি সিং দিনকর)
একের পর এক হলুদ গাঁদার মালা এসে জমছে কানহাইয়া কুমারের গলায়। শ-দুয়েক তরুণ তরতাজা যুবকের স্লোগানে নবাব চক চৌমাথা মুখরিত। পাশের গলিতে সব ক’টি বাড়ির ছাদে, সিঁড়িতে, জানলায় মহিলারা জড়ো হয়েছেন। ইনকিলাব জিন্দাবাদ স্লোগানের কোরাসের মাঝে তখন কথা বলাই দায়। দেশ কি নেতা ক্যায়সি হো/কানহাইয়া কুমার জ্যায়সি হো। ভাই প্রিন্স শুধু হাতের ইশারায় বললেন, এগোন। এগোব কী ! দুশো ততক্ষণে দু’হাজারি হয়ে উঠেছে। মিছিলই আমায় ঠেলে নিয়ে চলল ডাক্তার গলির দিকে।
দেশের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া ২৫০ জেলার মধ্যে একটি এই বেগুসরাই। স্টেশনেই আলাপ মহম্মদ ইনামের সঙ্গে। ১৮ বছরের ছিপছিপে যুবক ইনাম বললেন, গ্রামে যাবেন না? বিহারের লেনিনগ্রাদে! ওর পরিবার রাষ্ট্রীয় জনতা দলের সমর্থক। বললে, বাবা যা করেন করবেন, জীবনের প্রথম ভোটটা আমি কানহাইয়াকেই দেব। বুঝলাম, এমন অনেক অনেক ইনাম এসে জড়ো হচ্ছে কানহাইয়ার মিছিলে। তাই এত মানুষকে সঙ্গে নিয়ে মনোনয়ন দিতে পারে জেএনইউ–র এই ছাত্রনেতা। ইনামের মোটরসাইকেলে চেপে চললাম লেনিনগ্রাদ, মসনদপুর তোলা। কাছেই বিহট গ্রাম। নিটোল দারিদ্র্যে মোড়া খাপড়ার চাল, ইটের দেওয়াল। সামনের বারান্দার থামগুলোয় লাল কালিতে লেখা ‘মাদার ইন্ডিয়া লাল সেলাম।’ চারিদিকে লাল তারার ছবি। লড়কে লেঙ্গে আজাদি... দেওয়াল জুড়ে লেখা কানহাইয়ার সেই বিখ্যাত স্লোগানগুলো দেখে যেন সেই ‘এআইএসএফ’ আঁকা ডাফলিটা বেজে উঠল। এটাই কানহাইয়ার গ্রাম, বাড়ি, বিহারের লেনিনগ্রাদ। বাবা কিছুদিন আগে মারা গেছেন। দাদা এখন কর্মহীন। ভাই প্রিন্স কুমার তো দাদার সর্বক্ষণের সঙ্গী। বাড়ির সামনে কিছুটা গেলেই শহিদবেদি। উল্টোদিকে প্রয়াত কমিউনিস্ট সাংসদ চন্দ্রশেখর সিংয়ের বাড়ি। আর ওই যে দূরে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র, ওখানেই কাজ করেন মীনা দেবী, কানহাইয়ার মা। মাসে ৩০০০ টাকা পান, তিন মাস বকেয়া।
দরিদ্রদের নিয়ে ভোটের লড়াইতে নামা দরিদ্র কমিউনিস্ট পরিবারের কানহাইয়া এখন শুধু বেগুসরাই বা বিহারে নন, গোটা দেশেই স্টার। তাঁর বিপক্ষে বিজেপি–র হেভিওয়েট মন্ত্রী গিরিরাজ সিং।
বেগুসরাই স্টেশনের পাশেই একটি তিনতারা হোটেলে এখন বাসা বেঁধেছেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, বিজেপি সাংসদ গিরিরাজ সিং। একটু দূরে তাঁর নানির বাড়ি। নিজের বাড়ি নেই এখানে, স্থানীয়রা তাই বলে বাহারিয়া। নওয়াদা থেকে বিজেবি তাঁকে নিয়ে এসেছে কানহাইয়াকে হারাতে। বেগুসরাইয়ের রবিঠাকুর রামধারী সিং দিনকরের কবিতায় কানহাইয়ার উক্তি, ‘বান্ধনে মুঝে তু আয়া/জঞ্জির বড়ি ক্যা লায়া?’ নানি বাড়িতে সকালে যেদিন গিরিরাজের সঙ্গে দেখা করতে যাই, বাইরে তখন শ’দেড়েক বিজেপি কর্মী। সবার পরনে গেরুয়া পাঞ্জাবি, পায়ে দামি স্নিকার। সামনে দাঁড়িয়ে ১৫টা দামি গাড়ি, ৫০টা মোটরসাইকেল। সবার কপালে তো বটেই গাড়ি, মোটরসাইকেলগুলোর কপালেও গেরুয়া তিলক। হাজার তল্লাশির পর বসতে চেয়ার দিলেন। পুজোপাঠ শেষে ১৫ মিনিট পর নামলেন গিরিরাজ। লম্বা–চওড়া চেহারা। কপালে তিলক, গলায়, হাতে রুদ্রাক্ষ। বললেন, কী চাই? পরিচয় দিতেই পাল্টা প্রশ্ন, কবে এসেছেন? ‘এই তো! এসেই আপনার কাছে চলে এলাম।’ না, খুশি হননি মন্ত্রীমশাই। ডানহাতে নাকের সামনে ওড়া মাছি উড়িয়ে বললেন, আগে এলাকা ঘুরে আসুন। তারপর তো আসবেন। বললাম, কয়েকটা কথা আপনার কাছে জেনে নিই। তারপর যাব গ্রামের দিকে। নওয়াদা থেকে বেগুসরাইতে আসতে তার ঘোর আপত্তি ছিল। কিন্তু বাধ্য হয়েছেন দলের চাপে। বার বার ঘড়ি দেখছেন গিরিরাজ। একের পর এক কর্মী– সমর্থক ‘কার আগে কে যাবে’ করে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করছে। তিনি ত্রিকালজ্ঞ সিদ্ধপুরুষের মতো শুধু আশীর্বাদ করে যাচ্ছেন। স্থানীয় দুজন সাংবাদিকও প্রণাম করল। আমার তো ও সবের বালাই নেই, তাই কি রুষ্ট? কর্কশ স্বরেই বললেন, কী বলবেন বলুন, সময় নেই বেশি। সময় কম বুঝে এক ঝটকায় সব প্রশ্ন উপুড়। বললাম, কেন্দ্র বদল করতে হল কেন? নওয়াদা কি সেফ নয়? আপনি তো কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অথচ কানহাইয়ার পপুলারিটি তো বেড়েই চলেছে। জয় নিয়ে কতটা আশাবাদী? তরুণ প্রজন্ম কতটা আপনার পাশে থাকবে? ভূমিহার ভোটের সবটা কি আপনি পাবেন?
পেছনের গেরুয়া বাহিনী আমার ঠিক পেছনে। বেগতিক বুঝে স্থানীয় সাংবাদিক, বন্ধু জীতেন্দ্র এগিয়ে এসেছে আমার ঠিক পাশে। গুরুজি দেখলাম হাতের মুদ্রায় পিছিয়ে দিলেন তাঁর বাহিনীকে। গিরিরাজের হুঙ্কার, এখানে আমিই আমার প্রতিপক্ষ। শুধু নরেন্দ্র মোদিকেই চিনি। তাঁর নামেই ভোট হবে। কিন্তু বেকারের চাকরি? সুর চড়িয়ে গিরিরাজ, এই লাল ঝান্ডাই সব কারখানা বন্ধ করে দিয়েছে। আমরা খুলতে চাই। এরা পাকিস্তান বানাতে চাইছে বিহারকে। ‘দেশদ্রোহী’ কানহাইয়া সম্পর্কে কিছু বলতে নারাজ তিনি। আরজেডি? কংগ্রেস? গুরুজি হঠাৎই কাঁচাপাকা অগোছালো দাড়িতে মোড়া চোয়াল শক্ত করে, স্বর নামিয়ে, দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, ‘সুবে সুবে অ্যাজেন্ডা লেকে খাড়া হো গায়ে ইধার, ক্যা? মেরা ইতনা টাইম নেহি। আইয়ে।’ বলেই উঠে পড়লেন প্রায় ৬ ফুট উচ্চতার কেন্দ্রীয় মন্ত্রী গিরিরাজ সিং। আর সঙ্গে সঙ্গে গেরুয়া বাহিনী আমাদের অত্যন্ত মর্যাদা সহকারে, আদরের সঙ্গে বাড়ির বাইরে করে দিলেন।
বুঝলাম, বিহারের জাতপাতের অঙ্ক এই কেন্দ্রে ভেঙে চুরমার করে দিতে পেরেছে কানহাইয়া আর দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা স্বেচ্ছাশ্রমী বাহিনী। কানহাইয়ার গলায় শোনা কবি দিনকরের আরও একটা চরণ বার বার মনে আসছে। প্রায় প্রত্যেক সভাতেই নরেন্দ্র মোদিকে লাগাতার আক্রমণের পর কানহাইয়া বলছেন,
‘যব নাশ মনীষ পর ছাতা হ্যায়/
পহ্লে বিবেক মর যাতা হ্যায়।’
নুরপুরে শাহি জামা মসজিদে তখনও নমাজ পড়েনি, মীনাদেবী সাতসকালেই উঠে পড়েছেন। মাটির উনুনে লকড়ি জ্বেলে নাস্তা তৈরি করতে বসে পড়েছেন, পড়শী মায়েদের নিয়ে। উঠোনে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে যুবক–যুবতীরা সংখ্যায় শ’খানেক তো বটেই। নাস্তা–চা খেয়ে বেরিয়ে পড়বেন প্রচারে। আশপাশের বিভিন্ন গ্রামে গ্রামে চলে যাবে ১০টি দল। কথা বলবেন মানুষের সঙ্গে। কথায়, গানে, নাটকে, স্লোগানে— যেখানে যা দরকার। আর কানহাইয়া, প্রিন্স, মন্টুরা বেরিয়ে যাবেন অন্য প্রান্তে। সবে মাত্র সাড়ে ৬টা, এখনই! প্রিন্সকে প্রশ্ন করতেই কানহাইয়ার উত্তর, ‘বচ্না নেহি আব রণ হোগা/জীবন যায় ইয়া কি মরণ হোগা’। বাড়ি ফিরতে ফিরতে সেই রাত ১০টা। এভাবেই চলছে, জানালেন প্রিন্স।
এমন নির্বাচন গোটা ভারতে কোথাও কেউ দেখেছে কিনা সন্দেহ। সেই পুজোর সময় থেকে কানহাইয়া তাঁর জেএনইউয়ের বন্ধুদের নিয়ে প্রায় ২৭২ পঞ্চায়েতে ঘুরছেন। সিপিআইয়ের সদস্যপদ পাওয়ার পর এলাকায় ১০০ সভা করেছেন। জিগনেশ মেবানি ১৯ দিন ধরে স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে গেছেন। জাভেদ আখতার, শাবানা আজমি, স্বরা ভাস্কর, প্রকাশ রাজ–কে নেই। প্রয়াত শহিদ রোহিত ভেমুলা, নিখোঁজ নাজিমের মা আশীর্বাদ করেছেন। আবার দিল্লি, মুম্বই থেকে চলে এসেছেন গ্রুপ থিয়েটারের কর্মীরা। পাটনার গৃহবধূ শেহজাদি বেগম ঘরবাড়ি ফেলে কানহাইয়ার পাশে রোজ। দিল্লি থেকে নিজে গাড়ি চালিয়ে চলে এসেছেন সস্ত্রীক সঞ্জয় শর্মা, কল সেন্টারের চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে এসেছেন রাজগীরের গৌরব শর্মা। পাঞ্জাবের ভাতিন্ডা থেকে খেতি ফেলে রেখে বেগুসরাইতে পড়ে আছেন জবরজং সিং। কোমরে কৃপাণ, হাতে সুদৃশ্য লাঠি নিয়ে খালি পায়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন গ্রামে গ্রামে। বোঝাচ্ছেন, দাঙ্গা হলে মসজিদও পুড়বে, মন্দিরও পুড়বে। কানহাইয়ার সঙ্গে এসো। প্রিন্সের কথায় সংখ্যাটা ২০০ থেকে ২৫০ হবে। এদের কোনও চাহিদা নেই। নিজেরাই এসে বলছেন, বলুন কী করতে হবে? কানহাইয়াকে জিততেই হবে। সারাদিন ঘুরছেন, যা পাচ্ছেন তাই খেয়ে শুয়ে পড়ছেন এখানে–সেখানে। এলাকার মানুষের সঙ্গে মিশে বোঝাচ্ছেন, এটা ভোটের লড়াই নয়, দেশ বাঁচানোর লড়াই। দেশের সম্প্রীতি আর ধর্মনিরপেক্ষতা রক্ষার লড়াই। এ লড়াই জিততেই হবে। এবার ভোটের খরচ ধরা হয়েছে ৭০ লক্ষ টাকা, পুরোটাই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অনুদানে।
বেগুসরাইয়ে কমিউনিস্টদের দীর্ঘ অতীত থাকলেও, জেতার মতো অবস্থায় ছিল না। অবস্থা বদলে গেছে কানহাইয়াকে ঘিরে। ২০১৪ সালে বিজেপি এখানে জিতেছে। রাষ্ট্রীয় জনতা দলের প্রার্থী তনবির হাসান এখানে হেরেছিলেন মাত্র ৫৮ হাজার ভোটে। সিপিআই পেয়েছিল প্রায় ২ লক্ষ ভোট।
এবার কানহাইয়া কি পারবে ২ লক্ষের খাতাকে এক নম্বরে টেনে নিয়ে যেতে। উন্মাদনার বিচারে কানহাইয়া ইতিমধ্যেই শীর্ষে সন্দেহ নেই। কিন্তু ভোটের অঙ্কে? গতবার বিজেপি পেয়েছিল ৩৯.৭৩% ভোট। আরজেডি-৩৪.৩২% আর বাকি- ৬২.৪৬%। এর মধ্যে সিপিআই- ১৮%। কিন্তু এই অঙ্কের মধ্যে রয়েছে কিছু চোরা হিসেব। আরজেডি–র ভোটের মধ্যে রয়েছে কংগ্রেসের ভোট, যার বেশিরভাগটা মিলবে কানহাইয়ার। সঙ্গে আছে দেশের সমস্ত বামপন্থী দল। আর একটা হিসেবে: সাড়ে চার লাখ ভোটারের মধ্যে মুসলমান আড়াই লাখ, দলিত ১ লাখ আর যাদব ৮০ হাজার। বিহারের বিখ্যাত জাতপাতের অঙ্কে হলেও, ভূমিহার দলিতদের ভোট সবটা পাবেন না গিরিরাজ। কারণ কানহাইয়াও একজন ভূমিহার। যাদবদের কোনও জাতি প্রার্থী নেই। আর আরজেডি প্রার্থী তানবির বোধহয় গতবারের মতো মুসলিম ভোট পাবেন না। কারণ জাতপাতের অঙ্ক ভেঙে কানহাইয়া ইতিমধ্যেই মোদি–বিরোধিতায় নিজেকে শীর্ষে নিয়ে গেছেন। এবার তাকিয়ে থাকবে এই একটি কেন্দ্রের দিকে। যেখানে লড়াই গিরিরাজের সঙ্গে নয়, তানবিরের সঙ্গেও নয়, ৩২ বছরের এক ‘দেশদ্রোহী’ ছাত্র সোচ্চারে গলা তুলেছে ‘চৌকিদার’-এর বিরুদ্ধে। জেএনইউ–তে যাকে দেশদ্রোহের তকমা দিয়ে তিহার জেলে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন মোদি। কিন্তু আজও চার্জশিট দিতে পারেনি পুলিস। মহল্লায়–মহল্লায় গিয়ে বেগুসরাইয়ের ঠেঁট ভাষায় ছেলেটা বুঝিয়ে চলেছে দলসে নেহি, দিলসে ভোট দিজিয়ে, জাতপে নেহি ভাত পে ভোট দিজিয়ে। জাতপাতের বেড়া ভেঙে দিয়ে কানহাইয়ার মিছিলে মিলছে হিন্দু–মুসলিম, দলিত–ভূমিহার সবাই। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম পুরোটাই। না হলে বেগুসরাই পুরসভার সামনে কপালে কাস্তে হাতুড়ি আঁকা লাল ফেট্টি বেঁধে রিকশা চালাতে চালাতে গাইতে পারে, ‘কানহাইয়া তো জিতেঙ্গে, ঠিক হ্যায়...’।
(এই লেখাটি আজকাল পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। অনুমতিক্রমে তা হুবহু thebengalstory.com এ প্রকাশ করা হল)
Comments are closed.