২০১৬ সালের জুন মাসে অভীক সরকারের ইস্তফার পর আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদক হন অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়। প্রায় চার বছরের মাথায় ৩১ মে ২০২০, অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায় সম্পাদকের পদ থেকে ইস্তফা দিলেন। আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হলেন ঈশানী দত্ত রায়।
কিন্তু অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায় কেন বাংলার সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক থেকে আচমকা ইস্তফা দিলেন, তা নিয়ে রবিবার দুপুরের পর সরগরম বাংলার সংবাদমাধ্যম জগৎ। যদিও আনন্দবাজার পত্রিকার লো প্রোফাইল সম্পাদক অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে মে মাসের শেষ তিন-চার দিন রাজ্যের সোশ্যাল মিডিয়ায় নানা গুজব ছড়িয়েছে। যে গুজবের সূত্রপাত ২৮ মে রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়ের একটি ট্যুইট থেকে। কলকাতা পুলিশ কেন আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদককে সমন করেছে, তা রাজ্যের স্বরাষ্ট্র সচিবের কাছে জানতে চান তিনি।
এই ট্যুইটের পর থেকেই রাজ্যজুড়ে জল্পনা শুরু হয়, অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়কে হেয়ার স্ট্রিট থানায় ছ’ঘণ্টা বসিয়ে রেখেছে পুলিশ। ৩০ মে সিপিএম রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্রর একটি ট্যুইট এই জল্পনায় নতুন মাত্রা যোগ করে। সূর্যকান্ত মিশ্র ট্যুইট করে আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদকের গ্রেফতারির প্রসঙ্গ এনে প্রশ্ন করেন মুখ্যমন্ত্রীকে।
শনিবার সিপিএম রাজ্য সম্পাদকের এই ট্যুইটের পর থেকে গুজব ছড়াতে শুরু করে, অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়কে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এই জল্পনার মাঝেই ৩১ মে, আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদকের পদ থেকে ইস্তফা দিলেন অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়। কিন্তু কেন? অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়ের ইস্তফার দুটি সম্ভাব্য কারণ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। এক, সংস্থায় ব্যাপক ছাঁটাই। দুই, পুলিশের সমন।
সংস্থায় ছাঁটাই রুখতে না পারা
কোভিড পরিস্থিতির পর গোটা দেশের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে বেতন কমানো এবং ছাঁটাইয়ের খবর প্রকাশ্যে এলেও, আনন্দবাজার পত্রিকাও যে একই অবস্থান নিয়েছে তা গত দু’মাসে সেভাবে আলোচিত হয়নি। অথচ ওয়াকিবহাল মহল জানেন, আনন্দবাজার পত্রিকা কর্তৃপক্ষ এপ্রিল মাসের শুরুতেই জানিয়ে দিয়েছিল, এ বছর কোনও ইনক্রিমেন্ট, প্রমোশন হবে না। তারপর কর্মীদের বেতন কমানোর সিদ্ধান্ত নেয় তারা। ১৫ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত বেতন কেটে নেওয়া হয় কর্মীদের একাংশের। এপ্রিলে এই জোড়া ধাক্কার পরও আনন্দবাজার গোষ্ঠীর কর্মীদের সামনে কী অপেক্ষা করছে তা মে মাসের শুরুতেও বোঝা যায়নি। মে মাসের ১৯-২০ তারিখ থেকে আনন্দবাজার গোষ্ঠীতে শুরু হয় ব্যাপক কর্মী ছাঁটাই। বন্ধ করা হয় দ্য টেলিগ্রাফের উত্তর-পূর্ব ও ঝাড়খণ্ড সংস্করণ। বিভিন্ন সূত্র মারফত যা হিসেব, তাতে মে মাসের শেষে ২৫০ থেকে ৩০০ জনকে ছাঁটাই করেছে আনন্দবাজার গোষ্ঠী। কিন্তু সেটাই শেষ নয়। এবার ছাঁটাইয়ের আশঙ্কা আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগে। আনন্দবাজার পত্রিকা সূত্রের খবর, এই ছাঁটাইয়ের ইস্যুতে সম্পাদক অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে সংঘাতের শুরু কর্তৃপক্ষের।
সূত্রের খবর, মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহে আনন্দবাজার গোষ্ঠীর বোর্ড অফ ডিরেক্টরদের মিটিংয়ে এই ছাঁটাইয়ের বিরোধিতা করেছিলেন অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়। কিন্তু সেই বিরোধিতায় কর্তৃপক্ষ কান দেননি। বরং তার দু’দিন পর থেকেই ছাঁটাই শুরু হয়। এরই মধ্যে আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগে অন্তত ৪০-৪৫ জনকে কমাতে হবে বলে নির্দেশ দেয় কর্তৃপক্ষ। সূত্রের খবর, তাঁর হাত দিয়ে এত সাংবাদিককে ছাঁটাই করা হবে, তা মানতে পারেননি সম্পাদক। আনন্দবাজার পত্রিকা সূত্রে জানা গিয়েছে, চলতি সপ্তাহেই সম্পাদকীয় বিভাগে অন্তত ১৫-১৮ জনের চাকরি যেতে পারে। সূত্রের খবর, কর্তৃপক্ষ এই সিদ্ধান্ত কার্যকর করার আগেই সম্পাদকের পদ থেকে ইস্তফা দিলেন অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়।
কেন পুলিশের সমন, সত্যিই কী ঘটেছে
সূত্রের খবর, এপ্রিল মাসের শুরুতে আনন্দবাজার পত্রিকায় একটি খবর প্রকাশিত হয়, সেই প্রতিবেদনে লেখা হয়েছিল, বাঙুর হাসপাতালে চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্য কর্মীদের যথেষ্ট পরিমাণে পিপিই দেওয়া হয়নি। এই খবর ঠিক নয় বলে স্বরাষ্ট্র দফতরকে জানায় রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর। এরপর নির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে ৫ এপ্রিল আনন্দবাজার পত্রিকার বিরুদ্ধে হেয়ার স্ট্রিট থানায় ভারতীয় দণ্ডবিধির ১৫৩/১৮২/৫০৪/৫০৫(১)/ ৫০৫(২) ধারায় মামলা দায়ের করা হয়। এই মামলার সূত্র ধরে প্রায় ৫০ দিন পর ২৫ মে হেয়ার স্ট্রিট থানা আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদককে ডেকে পাঠায়। তিন দিনের মধ্যে তাঁকে হাজিরা দিতে বলা হয় থানায়।
কিন্তু নির্দিষ্ট তিন দিনের মধ্যে অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায় থানায় হাজিরা দেননি। তাঁকে থানায় বসিয়ে জেরা করা হয়েছে বা গ্রেফতার করা হয়েছে বলে যে জল্পনা, গুজব ছড়াতে শুরু করে, তা ঠিক নয়। ২৯ মে অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায় হেয়ার স্ট্রিট থানার ওসিকে একটি চিঠি দেন। তাতে লেখেন, তিনি হাইকোর্টে আগাম জামিনের আবেদন করেছেন। তাছাড়া তিনি সিনিয়র সিটিজেন, তাঁর ৬২ বছর বয়স এবং চিকিৎসক পরামর্শ দিয়েছেন, এই কোভিড পরিস্থিতির মধ্যে তাঁকে পাবলিক প্লেসে না যেতে।
চিঠির সঙ্গে চিকিৎসকের সার্টিফিকেটও দেন তিনি। চিকিৎসক লেখেন, অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়ের হাইপারটেনশন রয়েছে, ১৫ বছর ধরে তিনি চিকিৎসাধীন।
ভিত্তিহীন খবরের অভিযোগে আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদককে থানায় ডেকে পাঠানো, হাজির না হয়ে তাঁর হাইকোর্টে আবেদন করা, চিঠি দিয়ে থানায় যেতে না পারার কারণ জানানোর গোটা প্রক্রিয়ায় পুলিশ আর তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেনি।
কিন্তু প্রশ্ন, হঠাৎ কেন ইস্তফা দিলেন আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদক? সংস্থায় ছাঁটাই রুখতে না পারা, না পুলিশের সমন? না অন্য কোনও কারণ, তা স্পষ্ট নয়। কিন্তু এটা বলাই যায়, অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়ের মতো প্রায় লোকচক্ষুর আড়ালে থাকা সম্পাদককে নিয়ে গত কয়েকদিন ধরে রাজ্যের সংবাদমাধ্যম থেকে রাজ্যপাল এবং রাজনৈতিক মহলে যে চর্চা হয়েছে, তা নজিরবিহীন।
Comments are closed.