Bangla Bhadu Gaan – রাঢ় বাংলার ভাদু

বাংলার একটি প্রাচীন ও জনপ্রিয় লোকগান হল ভাদু।পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, বীরভূম, পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা ও বর্ধমান এমনকি ঝাড়খণ্ড রাজ্যের রাঁচি ও হাজারিবাগ জেলার লৌকিক উৎসব, Bhadu festival এই লোকগান পরিবেশিত হয়।

ভাদ্র মাসের সংক্রান্তির দিনে Bhadu Puja হয়ে থাকে। ব্রতের ক্ষেত্রে ভাদ্র মাসের প্রারম্ভেই শুরু হয় মহিলাদের ব্রত। বাংলার বর্ধমান, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, বীরভূম, পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা, বিহার, ঝাড়খণ্ডের দু-একটা জেলার মানুষ প্রধানত মেতে ওঠেন ভাদু উৎসবে। এছাড়া আদিবাসী, সাঁওতালদের মধ্যে করম গান ও উৎসব পালন করার রীতি রয়েছে বর্ষাকালে। সেটাও বিশেষ ভাবে ভাদ্র মাসে।

 

ভাদু গান, রাঢ় বাংলার চিরায়ত ঐতিহ্য (Culture, Symphony of Bhadu Festival)

bangla Bhadu Gaan

 

Bangla Bhadu Gaan -এর বিশেষত্ব হল এখানে টুসু বা ঝুমুর গানের মতো প্রেম বা রাজনৈতিক কথা বর্জন করা হয়। সাধারণ গৃহস্থ ও গৃহিনীদের জীবন কাহিনী, সুখ, দুঃখ ও বেদনা এই গানগুলির মূল উপজীব্য। এছাড়া পৌরাণিক ও সামাজিক ভাদু গান বিভিন্ন পাঁচালির সুরে গাওয়ার রীতি আছে। চার লাইনের ছড়া বা চুটকি জাতীয় ভাদু গানগুলিতে সমাজ জীবনের বিভিন্ন অসঙ্গতির চিত্র সরস ভঙ্গিতে ফুটিয়ে তোলেন ভাদু শিল্পীরা।

 

কেন উৎসবের নাম ভাদু?

bhadu festival

 

গান-কেন্দ্রিক এই লোক-উৎসবের শেকড় খুঁজতে গিয়ে বিভিন্ন গবেষক, লেখক, ভাদু শিল্পী নানা তথ্য দিয়েছেন।

প্রথমেই যেটা প্রশ্ন ওঠে, কে এই Bhadu? এ নিয়েও নানা মুনির নানা মত। যেমন কেউ কেউ বলেন ‘ভাদ্র’ মাস থেকে ভাদু শব্দের উৎপত্তি। আবার কারও মতে, ভাদু মানে লক্ষ্মী। দেবী লক্ষ্মী বিভিন্ন সময়ই পূজিত হন, তবে ভাদ্র মাসে লক্ষ্মীকে পৃথক ভাবে চিহ্নিত করার জন্য ভাদু পুজোর প্রচলন হয়। মতান্তরে পুরুলিয়ার কাশিপুরের পঞ্চকোটের রাজা নীলমনি সিংহদেবের কন্যার নাম ছিল ভাদ্রেশ্বরী। তা থেকেই রসেছে ভাদু নামটি। লোক মুখে প্রচলিত গল্পটা খানিকটা এমন-  কাশীপুরের রাজকন্যা ভদ্রেশ্বরীর সেদিন ছিল বিবাহ অনুষ্ঠান। কিন্তু রাজকন্যার বিবাহ উৎসব পণ্ড হয়ে যায় এক দুর্ঘটনায়। বর বিয়ে করতে আসার পথে ডাকাতদের কবলে পড়ে মারা যান। আর সেই শোক ও আঘাত সহ্য করতে পারেননি ভাদু। আত্মঘাতী হন তিনি। সেই রাজকন্যা ভাদুর স্মৃতিতেই কাশিপুরের রাজার পৃষ্ঠপোষকতায় শুরু হয় ভাদুগানের উৎসব। আবার কেউ বলেন, ভাদ্রমাসে পঞ্চকোট ও ছাতনার রাজার মধ্যে যুদ্ধে পঞ্চকোটের রাজা বিজয়ী হন। সেই স্মৃতিতেই এই গান ও উৎসবের সূত্রপাত।

পঞ্চকোট রাজপরিবারের সক্রিয় পৃষ্ঠপোষকতায় রাজদরবারে হারমোনিয়াম, পাখোয়াজ, তবলা, সানাই সহযোগে মার্গধর্মী উচ্চ সাহিত্য গুণ নির্ভর এক ধরনের ভাদু গাওয়া হত। এই পরিবারের ধ্রুবেশ্বরলাল সিংদেও, প্রকৃতীশ্বরলাল সিংদেও এবং রাজেন্দ্রনারায়ণ সিংদেও দরবারী ভাদু নামক এই ঘরানার সৃষ্টিকর্তা। কিন্তু অন্যান্য সকল ভাদু গীত লৌকিক সঙ্গীত হিসেবেই জনপ্রিয় হয়েছে। লিখিত সাহিত্য না হওয়ায় এই গান লোকমুখেই প্রচারিত হয়ে এসেছে এতকাল। আবার অনেকের মতে, সাঁজপুজুনি, পুণ্যিপুকুরের মতো না হলেও এয়োস্ত্রী মহিলাদের শাঁখা-সিঁদুর নিয়ে সংসার জীবনে সুস্থ থাকার জন্য ভাদু হল একটি ধর্মীয় ব্রত। কেউ কেউ বলেন, ভাদু বীরভূমের সন্তান। তাই বীরভূমে Bhadu Puja -এর এত প্রসার।

আবার বর্ধমানের সঙ্গে ভাদুর যোগ খুঁজে পান কেউ কেউ। অবিভক্ত বর্ধমানের খনি অঞ্চলে ‘ভাদা গান’ বলে একটি লোক-সংস্কৃতি প্রচলিত ছিল। এখনও কিছু কিছু জায়গায় তার প্রচলন রয়েছে। তার নামে ভাদু পুজো। এরকমই নানা কাহিনি ও লোককথা জড়িয়ে আছে ভাদুগান ও উৎসবকে জড়িয়ে। তবে এক কথায় বললে, ভাদু আদতে লোকজীবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা মেয়েদের গান। শুধু তাই নয়, ভাদু আসলে লোকউৎসবও। যে গান, যে উৎসবের গড়ন, রীতি ঐ রাজপরিবারের দরবার ছাড়িয়ে নেমে এসেছে মাটিতে। যদিও অনেক বিশেষজ্ঞ প্রশ্ন তোলেন এ কেমন করে সম্ভব? রাজপরিবারের দরবারের গান কীভাবে লোকগান হয়! ভাদু নিম্নবর্গের নাকি রাজরক্তের এ আলোচনা অব্যাহত। সময়ের সঙ্গে ভাদুর সঙ্গে জুড়েছে আধুনিকতার ছোঁয়া।

ইতিহাস যাই হোক, ভাদ্র মাসের শেষ দিনটিতে প্রাচীন এই লোক-উৎসবের জন্য এখনও অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকেন রাঢ় বাংলার মানুষ৷ আর একটা জিনিস হল ভাদু উৎসবে খাওয়া-দাওয়া।

পঞ্চকোট ইতিহাস গবেষক দিলীপ গোস্বামী এক লেখায় জানাচ্ছেন, ভাদু কোনও উপবাস করার পরব নয়। এই উৎসব উচ্ছ্বাস ও উল্লাসের। তাই ভাদুকে ঘিরে রয়েছে বিভিন্ন মিষ্টান্ন তৈরির প্রথা। যার মধ্যে প্রধান মিষ্টি বলা যায় জিলিপিকে। ভাদুর মিষ্টির সেই জৌলুস এখন না থাকলেও ঐতিহ্য কিন্তু রয়েই গিয়েছে। বছর ফিরলেই আসে Bhadu Festival, বাঁধা হয় গান। মেতে ওঠে লাল মাটির দেশ।

Comments are closed.