ডোকালাম কাণ্ডের পর থেকেই ভারত নিয়ে মনোভাব বদলাচ্ছে চিন! কিন্তু কেন? বিশ্লেষণ অধ্যাপকের

চিনে বন্ধ ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের সম্প্রচার। পাল্টা ভারতেও চিনের সংবাদমাধ্যম এবং পণ্য বন্ধ করার দাবি উঠছে। ভারত-চিন সম্পর্ক কোন দিকে গড়ায়, তার দিকে তাকিয়ে আন্তর্জাতিক মহল। এই পরিস্থিতিতে সমসাময়িক ঘটনা প্রবাহের নিরিখে ভারত চিন দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের সমীকরণ বিশ্লেষণ করলেন চিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক হেমন্ত আদলাখা। বললেন, ডোকলামের পর থেকেই চিনের ভারত-কৌশল নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য হয় জিনপিং সরকার। তারই ফলশ্রুতি গালওয়ান ভ্যালির ঘটনা।

শনিবার দ্য হিন্দু সংবাদপত্রে LAC face-off: Doklam was a game-changer for Chinese thought on India: JNU professor Hemant Adlakha শীর্ষক প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়। সেখানে সাংবাদিক সুহাসিনি হায়দারকে জেএনইউয়ের সেন্টার ফর চাইনিজ অ্যান্ড সাউথ ইস্ট এশিয়ান স্টাডিজের অধ্যাপক হেমন্ত আদলাখা জানিয়েছেন, চিনের মানুষ কী ভাবছেন তা জানার একমাত্র উপায় হল সেখানকার সংবাদমাধ্যম। কিন্তু ভারতে ম্যান্ডারিন ভাষা জানা লোকের সংখ্যা নগণ্য। এর ফলে একমাত্র গ্লোবাল টাইমসের উপরই ভরসা করতে হচ্ছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, গ্লোবাল টাইমস চিনের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তির ধারক ও বাহক। ফলে আন্তর্জাতিক কোনও ইস্যুতে সেখানে যথেষ্ট পরিমাণে ‘টোন ডাউন’ করে খবর পরিবেশিত হয়। যা হয়ত সবসময় সাধারণ মনোভাবের প্রতিফলন নয়। এই পরিস্থিতিতে চিনের স্থানীয় সংবাদমাধ্যম কী বলছে সেটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। অধ্যাপক আদলাখা বলছেন, গালওয়ানের ঘটনার পর চিনের স্থানীয় সংবাদমাধ্যমেও জাতীয়তাবাদের ঢেউ উঠেছে। ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের একাংশ গোটা ঘটনার জন্য চিনকে দোষারোপ করছে, ঠিক তেমনই চিনের স্থানীয় সংবাদপত্র বা চ্যানেলেও ভারতকে কাঠগড়ায় তোলার প্রয়াস। জনমানসে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে, ভারত এটা করছে কেন?

কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল, অধ্যাপক আদলাখা বলছেন, ভারতের প্রতি চিনের পরিবর্তনশীল মনোভাবেরই প্রতিফলন হয়েছে লাদাখে। কীভাবে? সাংবাদিক সুহাসিনি হায়দারকে অধ্যাপক আদলাখা জানিয়েছেন, ডোকলামের ঘটনার পর চিনের মধ্যেই একটা অবিশ্বাসের বাতাবরণ তৈরি হয়েছিল। সেই অবিশ্বাসটা ছিল চিনের কূটনৈতিক ব্যর্থতা এবং সামরিক গড়িমসির বিরুদ্ধে।

 

আরও জানতে ক্লিক করুন: ভুটানের সঙ্গে সীমান্ত বিবাদের নেপথ্যে চিনের পরিকল্পনা কী? 

 

চিনের কমিউনিস্ট কর্তারা এরপরই ভারত পলিসিতে বদল আনার কথা ভাবতে শুরু করেন। ডোকলামের পর রাতারাতি চিনের কাছে ভারতের সামরিক এবং রাজনৈতিক শক্তির গুরুত্ব বেড়ে যায় বহুগুণ। ভারত যে ক্রমশ চিনের ক্ষেত্রে বড় আশঙ্কা হয়ে উঠছে, তা তখন বেজিংয়ের কাছে সাফ। ফলে এই অগ্রগতির মোকাবিলা করতে ভারত নীতির আমূল বদলের প্রয়োজনীয়তা বোধ করে শি জিনপিং সরকার। উদাহরণ হিসেবে অধ্যাপক আদলাখা বলছেন, ডোকলামের হাতাহাতির ঘটনাকে চিনের স্থানীয় মিডিয়া Crisis বা সংকটমুহূর্ত হিসেবে অভিহিত করেছে সেখানে গালওয়ানের ঘটনা নিয়ে চিনা মিডিয়া খোলাখুলি ব্যবহার করছে Clash বা সংঘর্ষ অথবা Confrontation মুখোমুখি সংঘর্ষের মতো শব্দ।

অধ্যাপক আদলাখা Crisis থেকে Clash এ পৌঁছনোর রাস্তাটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন। তাঁর মতে, চিনের ভারত নীতি বদলানোর এটাই অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সূচক। আর তাই, দুই দেশের দুই রাজনৈতিক প্রধান বারবার হাসিমুখে হাত মেলালেও বাস্তবে সম্পর্ক খারাপ থেকে খারাপতর হওয়ার পথে। এই পরিস্থিতিতে যখন চিন ভারত নীতি বদলানোর পথে যাচ্ছে, তখন ডোকলামের পুনরাবৃত্তি (গালওয়ান ভ্যালি) আরও হবে বলে মনে করছেন অধ্যাপক। কারণ এতে জড়িয়ে আছে চিনের দ্বিমুখী পরিকল্পনা।

প্রথমত দীর্ঘকালীন পরিকল্পনা অনুযায়ী পশ্চিম সীমান্তে নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা। প্রকৃত রেখার এ পারে ভারত যেন পরিকাঠামো উন্নয়নের কাজ করতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে চায় চিন। অর্থাৎ যে রাস্তা ঘিরে চিনের আপত্তি, ভারত যেন ভবিষ্যতে তেমন কোনও কাজ করতে না পারে। নেপালের সঙ্গে রেল যোগাযোগের কাজ দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। তবে এক্ষেত্রে চিন যুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্যে যাবে না। তেমন পরিস্থিতি তৈরি হলে কূটনৈতিক, রাজনৈতিক স্তরে আলোচনা করে উত্তেজনা কমানোর পথে যাবে জিনপিং সরকার। কারণ আসল উদ্দেশ্য ভারত মহাসাগরে নৌ সেনা এবং সামরিক দখলদারি কায়েম করা।

 

আরও জানতে ক্লিক করুন: পিএলএ জওয়ানদের পরিবারের ক্ষোভ সামাল দিতে নাজেহাল চিন? 

 

আর লাদাখ নিয়ে চিনের স্বল্পকালীন পরিকল্পনার অন্তর্গত যে কোনও উত্তেজনা এড়িয়ে পণ্য পরিবহণ এবং বাণিজ্য অক্ষুণ্ন রাখা। ফলে এক্ষেত্রে চিনের মন্ত্র হল ধৈর্য। সামরিক কার্যকলাপের জেরে যদি বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে চিনা শাসকদের ঘরের চাপ সামলানো কঠিন হবে। ফলে যুদ্ধের দামামা নয় বরং এই মুহূর্তে দেখেশুনে পদক্ষেপের কথাই ভাবছে চিনের বাম নেতৃত্ব।

শাসক এ কথা ভাবছেন ঠিকই কিন্তু স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে উল্টো সুর। সেখানে ভারতকেই কাঠগড়ায় তোলার চেষ্টা হচ্ছে অনবরত। জাতীয়তাবাদী প্রচার চলছে চিনজুড়ে।

অধ্যাপক আদলাখা বলছেন, এটাও চিনের ভারত নীতির বদলে যাওয়া সমীকরণের প্রভাব। সরকার যুদ্ধ যাবে না। কিন্তু দেশবাসীকে ছদ্ম যুদ্ধের আবহ দিয়ে ক্ষোভ প্রশমনের একটা জায়গা করে দেবে।

Comments are closed.