তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের নির্গত জলীয় বাষ্প থেকে পুনর্ব্যবহারযোগ্য জল তৈরিতে সাফল্য যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের।

তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে নির্গত জলীয় বাস্পকে সংরক্ষণ করে তাকে পুনর্ব্যবহারযোগ্য জলে রূপান্তরিত করার নতুন পথ দেখাচ্ছে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়। সাধারণত তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলি থেকে যে কুয়াশা নির্গত হয়, তাতে প্রচুর পরিমাণ জলীয় বাষ্পের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। প্রায় ৯০ শতাংশ শিল্প ক্ষেত্র থেকে অপসারিত জল পুনর্ব্যবহারযোগ্য থাকে না। বিশ্বে জল সংকটের ক্ষেত্রে এটি একটি অন্যতম কারণ বলে ইউনেস্কোর সাম্প্রতিক রিপোর্টেও দাবি করা হয়েছে।
জলের এই বিপুল অপচয় রোধে এবং তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে অপসারিত জলকে পুনরায় বিশুদ্ধ ও ব্যবহারযোগ্য করে তুলতে কাজ করে চলেছেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাওয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক রঞ্জন গাঙ্গুলী এবং তাঁর সহকারী গবেষণারত ছাত্র ঋত্বিক ঘোষ, স্নাতক স্তরের ছাত্রী প্রিয়া সিংহ এবং চন্দ্রিমা পাত্র। এই গবেষক দলটি তাঁদের প্রকল্পটির নাম দিয়েছেন ‘কুলিং টাওয়ার ফগ হারভেষ্টিং ইন পাওয়ার প্লান্ট’।
thebengalstory.com কে অধ্যাপক রঞ্জন গাঙ্গুলী জানান, ‘বিভিন্ন তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের টার্বাইনকে ঠান্ডা করতে কুলিং টাওয়ার ব্যবহৃত হয়, কিন্তু এই প্রক্রিয়াতে প্রচুর পরিমাণ জলীয় বাষ্প কুয়াশা রূপে এর ওপর দিয়ে বাইরে বেরিয়ে যায়। এতে প্রচুর পরিমাণ জলের অপচয় হয়ে থাকে। এই অপচয় কমানোর লক্ষ্যে এক বিশেষ পদ্ধতিতে কাজ করা হচ্ছে, যেখানে কুয়াশা বা জলীয় বাষ্প বিন্দুকে ধরে রেখে তা থেকে জল সংরক্ষণ করা যাবে। পরবর্তীকালে সেই জলকেই প্লান্টের অন্যান্য অংশের কাজে ব্যবহার করা যাবে, এমনকী জনসাধারণের জন্য পানীয় জল হিসেবেও প্রস্তুত করা যাবে। এর ফলে যেমন একদিকে কমবে পানীয় জলের সমস্যা, তেমনিই নদীর জলের ওপর শিল্পের অতিরিক্ত নির্ভরতাও হ্রাস পাবে’।

অধ্যাপক রঞ্জন গাঙ্গুলী

এই গোটা প্রক্রিয়াটির জন্য কিছু বিশেষ তার জালিকা তৈরি করেছেন গবেষকরা। এই তার জালিকাগুলিকে পাওয়ার প্লান্টের কুলিং টাওয়ারের মধ্যে বসালে প্ল্যান্ট থেকে নির্গত কুয়াশার জলীয় বাষ্প বিন্দুগুলি জালিকার গায়ে এসে বসবে। এভাবে জলবিন্দু সংরক্ষণ করে রাখতে পারবে জালিকাগুলি। তার জালিকার গায়ে লেগে থাকা জল বিন্দু একটি নির্দিষ্ট পাত্রে জমা করা যাবে, যা পরে প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে পুনর্ব্যবহারযোগ্য করে তোলা হবে। এই তারজালিকাগুলি মূলত দু-ধরনের বলে জানা গিয়েছে। সুপার হাইড্রোফোবিক এবং সুপার হাইড্রোফিলিক। হাইড্রোফোবিক জলিকাগুলি জল ধরে রাখতে চায় না। এর ফলে অনেক সময়ই জল কুয়াশা রূপে বেরিয়ে যায়। অন্যদিকে, হাইড্রোফিলিক জালিকাগুলি জল সংরক্ষণ করতে পারে। কিন্তু উন্নততর সংরক্ষণের জন্য এই দুই ধরনের জালিকা ব্যবহারের কিছু বিজ্ঞানসন্মত পদ্ধতি রয়েছে, যেটা নিয়েই অধ্যাপক গাঙ্গুলী অ্যাডভান্স মেটিরিয়াল রিসার্চ অ্যান্ড অ্যাপ্লিকেশন ল্যাবরেটরিতে গবেষণা করে চলেছেন। আগামী দিনে প্রকল্পটিকে আরও উন্নততর করে তুলতে তাঁর সহকারী ঋত্বিক ঘোষ কানাডার ম্যাকমাস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘শাস্ত্রী ফেলোশিপ’ নিয়ে পড়াশোনা করছেন।
২০১৫ সালে ফরাক্কা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে প্রথম পরীক্ষামূলকভাবে প্রকল্পটির প্রয়োগ করা হয়েছিল বলে বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানানো হয়েছে। তারপর এই প্রকল্পের ফলাফলে উৎসাহিত হয়েই টেকনিকাল এডুকেশন কোয়ালিটি ইম্প্রুভমেন্ট প্রোগ্রাম বা ‘টেক্যুপ’ এগিয়ে আসে প্রকল্পটিতে আর্থিক সহায়তার জন্য। অধ্যাপক গাঙ্গুলী আরও জানান, কোলাঘাট তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র ২১০ মেগাওয়াট শক্তি উৎপন্ন করে, তাতে প্রতি ঘন্টায় ২৭ হাজার টন জল সার্কুলেট করাতে হয় প্লান্টকে ঠান্ডা করতে। এই ২৭ হাজার টন জলের তিন শতাংশ জল পুরোপুরি অপচয় হয়। আমাদের উদ্দেশ্য, এই তিন শতাংশ জলকে পুনর্ব্যবহারযোগ্য করে তোলা’। ইতিমধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, চিলি, বাংলাদেশ প্রভৃতি দেশ থেকে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অভিনব মডেলটির প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করা হয়েছে। অধ্যাপক গাঙ্গুলীর আশা, আগামী দিনে আরও বিভিন্ন সংস্থা প্রকল্পটির প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করবে। চেন্নাইয়ের ইন্টারন্যাশনাল সায়েন্স সোর্স শোতে এই মডেলটি যথেষ্টই প্রসংশা কুড়িয়েছে বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।

Leave A Reply

Your email address will not be published.