আত্মসমর্পণ করে নয়, লড়াইয়ের ময়দানে থেকেই আজও প্রাসঙ্গিক সিপিএম।

সুখেন আগে পার্টি অফিসে আসতো। টেবিলে রাখা গণশক্তিটা পড়ত। দু-একবার হয়ত মিছিলেও গিয়েছিলো। এখন আর আসে না। মিছিলেও যায় না। শুনেছি তে-মাথার মোড়ে, ব্যস্ত বাস-স্ট্যান্ডের ধারে, কালো কাঁচের দরজা, দেওয়ালে টাঙানো এল.ই.ডি টিভি, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কেবিন, ল্যাপটপ খচিত ঝাঁ চকচকে নতুন অফিস খুলে জমিয়ে ‘বিজনেস’ করছে সুখেন। গাড়িতে ঘোরে। প্রচুর টাকার লেনদেন। পার্টনার, জেল ফেরত তৃণমূলের লোকাল কচিনেতা।
আটের দশকে শহরের রাজপথে আগুন ঝরানো ভাষণ শুনত প্রিয়ব্রত। বলিভিয়া-কিউবা-গুয়েতেমালা হয়ে শ্রমিক নেতা যখন জ্যোতিবাবু’তে থামল, প্রিয়ব্রত তখন কলেজের দোর্দণ্ডপ্রতাপ জি.এস। তারপর যুব ফেডারেশন করতে করতেই, সাদামাটা একটা কন্ট্রাক্টচুয়াল চাকরি, বউ-বাচ্চা, লোকাল-জোনাল ঘুরে পঞ্চায়েতে আবার একটা নির্বাচনী হার। চিঠি দিয়ে সংগঠনের কাজের থেকে অব্যাহতি চাওয়া বিব্রত প্রিয়ব্রত এখন পাড়ার ঘাস-ফুলের নেতাদের দেখলে ‘হাই-হ্যালো’ করে। পার্টির গোপন খবর ওই শিবিরে পোঁছে দেওয়ার ঠিকাদারি করে। পাড়ার চায়ের দোকানের আড্ডায় মুচকি হেসে প্রিয়ব্রত বলেছে, “পার্টিটা করে আর লাভ নেই। সাইনবোর্ড হয়ে যাওয়া অবধি অপেক্ষা করি। তারপর কেটে পড়বো।” অবশ্য কেটে’ই তো পড়েছে কেউ কেউ। কেউ হয়ত যাবে বলে পা বাড়িয়েছে। কেউ একটু ভয় পেয়ে মুখ লুকিয়েছে। কেউ কেউ আবার ২১’শে জুলাইয়ের ‘উন্নয়নের যজ্ঞে’ শামিল হতে রাজনীতির হাটে-বাজারে নিজের মেরুদণ্ড’টাই নিলাম করেছে।
এরাও সিপিএম!
আরামবাগের প্রকাশ্য রাস্তায়, আপনার মায়ের বয়সী সিপিএম সদস্যা রাখি রায়ের আঁচল ধরে টান মারছে আট জন বীরপুঙ্গব। শরীরজুড়ে অবাধ ঘোরাফেরা করছে সন্তানসম ছেলেদের হাত। লজ্জায় ক্যামেরা নামিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছেন চিত্র সাংবাদিকরাও। অশ্রাব্য গালিগালাজের সাথে হুমকির সুরে তৃণমূলের ডাকসাইটে নেত্রীর নির্দেশ, ‘ছাড়বি না। আমাদের এগেইনিস্টে নমিনেশন দিতে গিয়েছিল, শাড়ি খুলে নিয়ে চল শালিকে।’
আর গত সাড়ে সাত বছরে পাঁচবার হামলা হয়েছে যাঁর বাড়িতে সেই রাখি রায় বলছেন, ‘মনের জোর না থাকলে কমিউনিস্ট পার্টি করা যায়? গ্রামের মেয়েদের নিয়ে মিছিল করেই ডিএম অফিস যাবো। দেখি কে আটকায়’।
নওগাঁ-২নম্বর গ্রাম পঞ্চায়েতের হরিপুরা গ্রাম। রাত তখন ১টা। সশস্ত্র তৃণমূলী দুষ্কৃতীরা চড়াও হল সুভাষ ঘোষের বাড়িতে। দরজা ভেঙেই ভেতরে ঢুকল লুম্পেন বাহিনী। সুভাষ ঘোষের দাদা ও ভাইয়ের কপালে বন্দুক ঠেকিয়ে শুরু হল ভাঙচুর। মেরে, হাত-পা বেঁধে, দুই ভাইয়ের মুখে কাপড় গুঁজে, টেনে হিঁচড়ে বের করে আনল সুভাষ ঘোষকে। সন্তানকে বাঁচাতে এসে নিস্তার পেলেন না ৭৪ বছরের অসুস্থ বাবা আর ৬৮ বছরের বৃদ্ধা মা। মধ্যরাতের নৃশংসতার দু-ঘণ্টা পর, অবচেতন অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হল পরিবারের সকলকে।
হাত-পা ভাঙ্গা। টাঙির কোপে রক্ত ঝরছে কপাল থেকে। হাসপাতালে ভর্তি গোটা পরিবার। অবিশ্বাস্য দৃঢ়তায় সুভাষ ঘোষ বলছেন, ‘মরে গেলেও মনোনয়ন প্রত্যাহার করবো না’!
নববর্ষে আপনার হেঁশেল যেদিন সর্ষে ইলিশের খুশবুতে মাতোয়ারা ঠিক সেদিনই মনোনয়নপত্র জমা দিতে এসে তৃণমূলের ‘বাইক বাহিনী’র হাতে অপহৃত হলেন হিরু লেট। রামপুরহাট পঞ্চায়েত সমিতির অফিস সংলগ্ন তামাটে নিরেট রাস্তায় পড়ে থাকা হিরু লেটকে যখন উদ্ধার করা গেল, তখন তাঁর পরনের চেক লুঙ্গি আর হাফ হাতা সাদা গেঞ্জিতে জমাট বাঁধা রক্তের ছোপ ছোপ দাগ। মুখের ডান দিকটা খাবলানো। মাথাটা থ্যাঁতলানো। আর পাশে পড়ে থাকা লাল পতাকাটাও রক্তে ভিজে ক্লান্ত। ‘ক্ষমতা’ চাইলে সরকারি হাসপাতালে কুকুরের ডায়ালিসিস হয়, ‘ক্ষমতা’ চাইলে, ঠগবাজ মন্ত্রীর উডবার্ন ওয়ার্ডের ঠাণ্ডা ঘরে ঘাপটি মারার জায়গা হয়। কিন্তু সিউড়ি থেকে কলকাতা, সরকারি হাসপাতালে হিরু লেটদের চিকিৎসা হয় না।
চোখে ব্যান্ডেজ। মুখে প্লাস্টিক সার্জারি। ঠোঁটে সেলাই। হাসপাতালে শুয়ে হিরু লেট বলছেন, ‘৪৫ বছর, কোনও ভোটে হারেনি হরিদাসপুর। এবছরও হারব না’।
সিপিএম। হ্যাঁ, এরাও সিপিএম। কালও ছিল। আজও আছে। ভবিষ্যতেও থাকবে।

‘সাইনবোর্ড’ হতে চলা পার্টি’টার হৃতগৌরব পুনরুদ্ধারে “কী করিতে হইবে” সে বিষয়ে প্রতিদিন হোয়াটস-অ্যাপে দু-মুঠো উপদেশ দেওয়া টেক্সাসের প্রগতিশীল টেকনোক্র্যাট, ফেসবুকে পার্টি-লাইনের অন্তঃসার শূন্যতার গবেষক লন্ডনের চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট, সিপিএমের এই অভূতপূর্ব দিশাহীনতায় মাথায় হাত রাখা সাংবাদিক, ‘গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার ব্যাধি’ নিরাময়ের ১০৮ প্রকার ওষুধ নিয়ে হাজির। সিপিএমের থেকে আর একটু বেশি লেনিন জানা, আর একটু বেশি মার্ক্স বোঝা তাত্ত্বিক, সংশোধনবাদী সিপিএমকে ‘প্রকৃত বিপ্লবের’ শত্রু হিসাবে দাগিয়ে দেওয়া অতি বাম -এদের সামনে দাঁড়িয়েই পথ চলছে সিপিএম। অভাব-অভিযোগ-কুৎসা-অপপ্রচার-আলোচনা-সমালোচনার বিষমসত্ত্বতা নিয়েই সিপিএম। সাংগঠনিক সাফল্য কিংবা ব্যর্থতা, নির্বাচনী জয় কিংবা পরাজয়, আদর্শ বোধের বিচ্ছুরণ কিংবা বিচ্যুতি এই সব কিছুর বৈপরীত্য নিয়েই সিপিএম। ইতিহাসে দীর্ঘ পথচলায় রাজনৈতিক ও মতাদর্শগত এই আক্রমণের আগুনে জ্বলে পুড়েই ইস্পাত কাঠিন্যে বলীয়ান আজ সিপিএম। রাশিয়ান দার্শনিক নিকোলাই চেরনিশেভেস্কিকে উদ্ধৃত করে লেনিন বলতেন “কমিউনিজমের পথটা সেন্ট পিটার্সবার্গের সবচেয়ে লম্বা এবং সুসজ্জিত নেভস্কি প্রস্পেক্টর রাস্তার মত সহজ, সরল আর প্রশস্ত নয়। বরং কণ্টকাকীর্ণ”। ঐ কণ্টকাকীর্ণ পথেরই পথিক সিপিএম।
খবরের কাগজে পাতা জোড়া বিজ্ঞাপনে প্রধানমন্ত্রী আর মুখ্যমন্ত্রী টেক্কা দিচ্ছেন ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডরদের মার্কেট ভ্যালুকে। আর জীবন বাজি রেখে, রক্তস্নাত হয়ে হিরু লেট-সুভাষ ঘোষ-রাখি রায়’রা লড়ছেন। বামপন্থীরা লড়ছে। গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য লড়ছে। সাধারণ মানুষের ভোটাধিকারের জন্য লড়ছে। বিরোধী দল করার অপরাধে জুয়াড়ি শিক্ষক নেতা আপনার বাড়ি বয়ে যাতে শাসিয়ে যেতে না পারে তার জন্য লড়ছে। আপনার বেকার ছেলে’র মুখে রক্ত ওঠা পরিশ্রমের পরেও যাতে তৃণমূল নেতার বউ-শালা’দের স্রেফ ঘুষের বিনিময়ে চাকরি না হয়, তার জন্য লড়ছে। আপনার বকেয়া মহার্ঘ্য ভাতায় যাতে ক্লাবে-ক্লাবে ২ লাখ টাকা অনুদান দিয়ে গুণ্ডা পোষা না হয় তার জন্য লড়ছে। ঋণের দায়ে আত্মঘাতী ১৭৬ জন কৃষকের লাশে সওয়ার হয়ে যাতে সরকারি মোচ্ছবে কোটি টাকা ব্যয় না হয়, তার জন্য লড়ছে। বন্ধ চা-বাগানের শ্রমিক’দের অনাহারের বিনিময়ে যাতে ইমাম ভাতা আর পুরোহিত যজ্ঞে সাম্প্রদায়িকতার সলতে পাকানো না হয় তার জন্য লড়ছে।
কারণ লড়াইয়ের জন্যই সিপিএম। দেশজোড়া ধর্মঘটে সরকার রায়বাহাদুরকে চমকে দিয়ে শ্রমিকদের নূন্যতম মজুরি আদায় করতে সিপিএম। লাল শালু বিছিয়ে রাস্তায় রাস্তায়, মানুষের কাছে হাত পেতে, বন্ধ চা বাগানের খেতে না পাওয়া পরিবারগুলোর ত্রাণের ব্যবস্থা করে দিতে সিপিএম। নিজেদের পার্টি অফিসের জ্বলা আগুন বুকে নিয়ে কৃষকের দাবি সনদ কড়ায়-গণ্ডায় বুঝে নিতে নবান্ন অভিযানের সিপিএম। সংসদের লাল কার্পেটে গেরুয়া আস্ফালনের সামনে বুক চিতিয়ে আখলাখ’দের কথা বলতে সিপিএম। ফুটপাতের মেয়েটার স্বপ্নাতুর ঘুম নিশ্চিত করতে সিপিএম। আর শোষণহীন নতুন একটা ভোরের স্বপ্ন দেখতে সিপিএম।

(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)

Leave A Reply

Your email address will not be published.