বহু বছর বাদে দিল্লিতে ফেলুদা, করিমসে খেয়ে তোপসে আর জটায়ুকে নিয়ে গেলেন লাল কেল্লা দেখতে। তারপর…

এ তো প্রায় একই ভাড়া পড়ে গেল! আপনি কেন যে ট্রেনে আসতে জেদ করলেন কে জানে! ফ্লাইটে তো দিব্যি দু ঘন্টায় পৌঁছে যেতাম। এদিক ওদিক যাওয়ার সুযোগ থাকতো। আমার আবার ট্রেনে ইয়েটা হয় না। বললেন লালমোহনবাবু।
এমনিতে আলিগড়ে ট্রেন দাঁড়ায় না। কিন্তু এখন দাঁড়িয়ে আছে প্রায় ১০ মিনিট হল। দাদরিতে নাকি অবরোধ হয়েছে।  ফেলুদা বললো, দেশের রাজধানীতে রাজধানী এক্সপ্রেসে চেপে আসার মজাই আলাদা। এই যে বেশ ২০ ঘন্টার ছুটি পাওয়া গেল সেটা বেশ এনজয় করছি। আর ট্রেনকে অবহেলা করবেন না। ট্রেনে না উঠলে আপনার সঙ্গে আমাদের আলাপই তো হত না! লালমোহনাবু এবার হেসে ফেললেন, মোক্ষম বলেছেন মশাই! তবে সেই তুফান এক্সপ্রেসের ব্রেড অমলেট আজও যেন অমৃত। এতবার রাজধানী, দুরন্ততে চাপলুম। কেটারিং-এর সেই টেস্ট আর পেলাম না। কী বলো ভাই তপেশ!
ফেলুদা খুব ভোরে উঠে আপার টায়ারেই যোগাসন করে নিয়েছে সেটা আমি আড়চোখে দেখে নিয়েছি। আপাতত ফেলুদার হাতে কোনও তদন্তের কাজ নেই। সিবিআই এর এক কর্তার সঙ্গে নাকি একটা জরুরি মিটিং আছে। কলকাতায় আমাদের পাড়ার কাছেই থাকেন রাজা রায়চৌধুরী। ভদ্রলোকের একটি পা খোঁড়া। ক্রাচ নিয়ে হাঁটেন। কিন্তু অসম্ভব মনের জোর। আগে দেশ-বিদেশে প্রচুর অভিযান করতেন। আজকাল কেন কে জানে তিনি ঘরবন্দী। কোনও অভিযান নাকি আর করবেন না, ঘোষণা করেছেন বেশ কয়েক বছর হয়ে গেল। তাঁর সঙ্গে সিবিআই কর্তাদের ঘনিষ্ঠতা ছিল। কী একটা ব্যাপারে তাঁকে হেল্প করতে বলায় তিনিই সিবিআইকে বলেছেন, আমি আর কাজ করি না। একটা নম্বর দিচ্ছি ওঁকে বলুন। আমার থেকে ও ভালো কাজটা করবে। ইয়াং ছেলে! ইনটেলিজেন্ট! সেই নম্বরটি আসলে ফেলুদার। রাজা রায়চৌধুরীকে সকলে কাকাবাবু বলেন। কয়েকবার রবীন্দ্রসরোবর লেকে দেখেছি হাঁটতে। সেই ব্যাপারেই আমরা তিনজন দিল্লি যাচ্ছি। আমি আর ফেলুদা আপারে। লালমোহনবাবু লোয়ারে। চতুর্থজন দিল্লিনিবাসী এক বাঙালি। হুইলার পাবলিকশেন নামে একটা প্রকাশন সংস্থা চালান। ইতিমধ্যেই লালমোহনবাবু তাঁর সাম্প্রতিক গ্রন্থ ‘কম্পিত কারাকোরাম’ হাতে ধরিয়ে দিয়েছেন। তবে ভদ্রলোক বাংলা বই ছাপেন না শুনে লালমোহনবাবু হতাশ। ভদ্রলোক বলেছিলেন, আজকাল মাইথোলজি থ্রিলার খুব চলছে। আপনার পেননেম কিন্তু আইডিয়াল ওই ধরণের লেখায়। জটায়ু! রাতে টয়লেটের করিডরে লালমোহনবাবু আমাকে বলেছেন, প্রস্তাবটা তোমার কেমন লাগছে? জটায়ু শেষ পর্যন্ত পুরাণ লিখবে? ব্র্যান্ডটা নষ্ট হয়ে যাবে না তো? তোমার দাদা কী বলে দেখি!
দিল্লিতে থাকার ব্যবস্থা হয়েছে বঙ্গভবনে। জায়গাটা শহরের কেন্দ্রস্থলে। সবথেকে বড় সুবিধা হল বাঙালি খানা। আর হেঁটেই মোটামুটি ইন্ডিয়া গেট, কনট প্লেস ঘোরা হয়ে যায়। ফেলুদা সকালেই বেরিয়ে গিয়েছে। গাড়ি এসেছিল নিতে। যাবে লোদি রোডে সিজিও কমপ্লেক্সে। সিবিআই হেডকোয়ার্টারে। বলে গেল, দুপুরে মিট করছি জামা মসজিদের সামনে। জামা মসজিদ পর্যন্ত উবেরে এলাম বটে। তবে দিল্লি যে প্রচুর পালটে গিয়েছে তা দেখে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। মেট্রো আর ফ্লাইওভারের ঝকঝকে শহর। ফেলুদা এসেই বললো, চল আগে খেয়ে নেওয়া যাক। কোথায় খাবো? জামা মসজিদের উলটোদিকের গলিতে ঢুকলো ফেলুদা। এগোতেই বাঁদিকে একটা এন্ট্রি। ঢুকতেই অন্য জগৎ। এরকম একটা মোগলাই খানার রেস্তরাঁ আছে তা বাইরে থেকে বোঝাই যায়নি। করিমস নামটাই নাকি বিরিয়ানির জন্য বিখ্যাত। বিরিয়ানি আর কষা মাংস। একটা তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে লালমোহনবাবু বললেন, ফিরনি পাওয়া যাবে না? ফেলুদা বেশ তারিফ করার গলায় বলে উঠলো মার্ভেলাস! এবার আপনি মোক্ষম বলেছেন! ফিরনি খাওয়া হল বাইরে এসে। এবার লালকেল্লা। এমনিতে দর্শনীয় ঐতিহাসিক স্থানে বেড়াতে এলে ফেলুদার মুখচোখ প্রফুল্ল হয়ে ওঠে। আচমকা দেখলাম কাউন্টারের সামনে গিয়েই ফেলুদার মুখ থমথমে। কী হল? লালমোহনবাবু টিকিট কেটে এনে বেশ গজগজ করতে করতে বললেন কান্ডটা দেখছেন মশায়!  শাহজাহানের লালকেল্লায় ঢোকার আগে কিনা শুনতে হচ্ছে ডালমিয়া ওয়েলকামস ইউ। একি ফাইভস্টার হোটেল নাকি? ফেলুদা চাপা স্বরে শুধু বললো, ওড়িশায় পাহাড় বিক্রি করে দিয়েছে। বস্তারে নদী বিক্রি করে দিচ্ছে। এবার এসবও শুরু হয়েছে। মা বাবার সঙ্গে এসেছিলাম এর আগে একবার। যখন মীনাবাজারের জায়গাটা বেশ এলোমেলো ছিল। তবু মনে হয়েছিল যেন সেই পুরানো দিনের একটা টাচ আছে। এই হয়তো জাহানারা, রোশনারা বেরিয়ে আসবেন জাংক জুয়েলারি কিনতে এরকম এক গা ছমছমে ব্যাপার ছিল। কিন্তু এটা কেমন? ওই যে ভিজিটরস সেন্টার করা হয়েছে ওটা তো দেখছি একটা সেলফি তোলার স্পট। একগাদা স্যুভেনির শপ খোলা হয়েছে। ঠিক যেন পালিকাবাজারে ঢুকেছি। অডিও ভিস্যুয়াল প্রেজেন্টেশন চলছে। বাতাসে ভাসছে ওয়াই ফাই। কাফেটেরিয়া থেকে অনর্গল হাস্যকোলাহল। এ কেমন লালকেল্লা? ফেলুদার মুখ আরও গম্ভীর! কারণ সেই লাল রঙের স্যান্ডস্টোনের আবহে বাদশাহি মেজাজটাই যে আর পাওয়া যাচ্ছে না। বললো, ভালো লাগছে না রে তোপসে! ভালো লাগছে না! লালমোহনবাবুকে ম্লান হেসে ফেলুদা বললো, এই লালকেল্লা প্রথম লুঠ করে নাদির শাহ । সেই ১৭৪৭ সালে। এরপর ব্রিটিশ সেনা। ১৮৫৭ সালে। আধুনিক ভারতের ঐতিহ্যের নতুন লুটেরা হল এই কর্পোরেটমহল। প্রখর রুদ্রকে বলুন এদের বিরুদ্ধে অভিযান করতে। পারবে? যাই হোক আপনি কি লাইট অ্যান্ড সাউন্ড দেখবেন? জটায়ু মুখ গোমড়া করে বললেন, সেই শো চলার মাঝখানে হয়তো আবার হবে বিজ্ঞাপনের বিরতি!
রক্ষে করুন মশায়..!!

Leave A Reply

Your email address will not be published.