গত ১৫ বছরে ১৭৩৮ জন পরিবেশবিদ এবং আদিবাসী খুন হয়েছেন বনভূমি রক্ষার আন্দোলন করতে গিয়ে! বাঁচবে পরিবেশ, প্রশ্ন

সাম্প্রতিক বিশ্বে সবচেয়ে চর্চিত বিষয় হল পরিবেশ। গ্লোবাল ওয়ার্মিং থেকে শুরু করে পানীয় জলের সঙ্কট, প্রতিটি বিপদের মূল কারণ হিসেবে উঠে আসছে নির্বিচারে সবুজ নিধনের কথা। এই প্রেক্ষিতে বিশ্বের বনভূমি রক্ষায় নতুন করে শপথ নিতে হবে বলে বারবার জানাচ্ছেন প্রথম বিশ্বের নেতারা। কিন্তু তাতে কাজ হচ্ছে কি? অনিয়ন্ত্রিত নগরায়ন এবং আকাশ ছোঁয়া মুনাফার আকাঙ্খা রোধ করতে না পারলে, তা যে স্রেফ কথার কথা হয়েই থেকে যাবে, তা আজ দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। প্রথম সারির প্রচার গোষ্ঠী গ্লোবাল উইটনেস সম্প্রতি একটি রিপোর্ট প্রকাশ করছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, বিশ্বের ৫০ টি দেশে ২০০২ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে বনভূমি রক্ষা করতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন ১,৭৩৮ জন মানুষ। জঙ্গল রক্ষা করতে গিয়ে মৃত মানুষদের মধ্যে বেশিরভাগই আদিবাসী। রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, কয়েকটি ক্ষেত্রে পুলিশের গুলিচালনার কারণে মৃত্যু হয়েছে অরণ্যের রক্ষকদের। রিপোর্টে প্রকাশ, অরণ্য রক্ষা করতে গিয়ে প্রতি সপ্তাহে গড়ে ৩ জন মানুষ প্রাণ হারাচ্ছেন।
এখানেই প্রশ্ন, যে এত মানুষ প্রাণ হারাচ্ছেন কেন? রিপোর্টে প্রকাশ, কেবল উচ্ছেদ নয়, মৃত্যু মিছিলের নেপথ্যে বড় ভূমিকা রয়েছে বনভূমি দখলের প্রবণতার। গ্লোবাল উইটনেস তার রিপোর্টে দেখিয়েছে, বিশ্বজুড়ে কীভাবে বনভূমি দখল করে কখনও খনি আবার কখনও বনজ সম্পদ লুঠের অভিযান চলছে। বাধা পেলেই চলছে গুলি। যাতে মৃত্যু হচ্ছে আদিবাসী অরণ্যবাসীদের, আবার কখনও গুলির মুখে প্রাণ হারাচ্ছেন পরিবেশ নিয়ে কাজ করা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্মীরা, সাংবাদিকরা কিংবা বন অধিকারের দাবিতে কাজ করা আইনজীবীরা।
১৯৮৮ সালে ব্রাজিলের পরিবেশবিদ তথা ট্রেড ইউনিয়ন নেতা চিকো মেন্ডেসকে গুলি করে করে খুন করে দুষ্কৃতীরা। চিকো অ্যামাজন এবং অরণ্যবাসীদের অধিকার আদায়ের লড়াই করতেন। অরণ্যপ্রেমীরা মনে করেন, সেই শুরু। তারপর থেকে ক্রমেই লাগামছাড়া আকার ধারণ করেছে বন রক্ষকদের মেরে ফেলার ঘটনা। ২০১১ সালে ব্রাজিলে একই কারণে খুন হতে হয় পরিবেশবিদ জোস ক্লদিও রিবেরো এবং মারিয়া ডু এসপিরিতো। পরিবেশবিদরা বলছেন, ১৯৮৮ থেকে ২০১১, সময় অনেকটাই পেরিয়েছে কিন্তু পরিস্থিতির বিন্দুমাত্র বদল হয়নি। একইভাবে ২০১২ সালে কাম্বোডিয়াতে জঙ্গল মাফিয়াদের হাতে খুন হতে হয় ন্যাচরাল রিসোর্স প্রোটেকশন গ্রুপের ডিরেক্টর চুট উট্টিকে। অর্থাৎ, স্থান বদলালেও, অরণ্য রক্ষকদের বিরুদ্ধে সারা বিশ্বেই খড়গহস্ত জঙ্গল মাফিয়ারা। বিভিন্ন ক্ষেত্রের মাফিয়াদের পিছনে সরকারি মদতেরও অভিযোগ রয়েছে। তবে সবচেয়ে বড় কথা, পুলিশের গুলিতেও অরণ্য রক্ষকদের মৃত্যুর ঘটনা ক্রমেই বাড়ছে বিশ্বজুড়ে। এমনটাই মনে করছে গ্লোবাল উইটনেস।
অনেকটা একই পরিস্থিতি ভারতেও। সম্প্রতি আদিবাসী ও অরণ্যবাসীদের বন থেকে উচ্ছেদ করার দাবি নিয়ে মামলা চলছে সুপ্রিম কোর্টে। আদালত নির্দেশ দিলে যুগ যুগ ধরে অরণ্যে বসবাসকারী লক্ষ লক্ষ মানুষকে উচ্ছেদ হতে হবে। অরণ্যবাসীদের অরণ্যের অধিকার সুনিশ্চিত করতে পথে নেমেছে একাধিক রাজনৈতিক দল, পরিবেশ সংগঠন এবং স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। এখন সব নজর, শীর্ষ আদালত কী নির্দেশ দেয় তার উপর। এদিকে ভারতেও বনভূমি দখলের ঘটনা ঘটে চলেছে। কখনও বহুজাতিক সংস্থার হাত ধরে আবার কখনও স্থানীয় দুষ্কৃতীদের দখলদারির জেরে অরণ্যবাসী এবং তাদের অধিকার রক্ষা সংগঠনগুলোর সঙ্গে মতভেদ বাড়ছে সরকার কিংবা বেসরকারি সংস্থার। অভিযোগ, অরণ্যবাসীদের উচ্ছেদ করে বনভূমি বহুজাতিক সংস্থার হাতে তুলে দেওয়ার নীতি নিয়েছে সরকার। যদিও সরকারের তরফে এই অভিযোগ উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

Comments are closed.