কলকাতায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বেতনভুক স্কটিশ ভাষাবিদ এ দেশে হিন্দির প্রচারক, তা কখনই ভারতের জাতীয় ভাষা হতে পারে না

‘যদি উদ্ভবগত দিক থেকে অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের ম্যাকাউলিস চিলড্রেন বলে অভিহিত করা হয়, তাহলে হিন্দিভাষীদের গিলক্রিস্টের সন্তান হিসেবে অভিহিত করা যেতে পারে’

 

আমার প্রয়াত দিদা ছেলেবেলায় আমাকে বলেছিলেন, আধুনিক হিন্দি ভাষার জন্মস্থান কলকাতা এবং ব্রিটিশরা এই ভাষার প্রসার ঘটিয়েছিল কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে। আমার দিদা ১৯৪০ সালের কলকাতায় দর্শন এবং জীববিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করেছিলেন।
সম্প্রতি সংবাদপত্রে হিন্দি দিবসের কথা জানতে পেরে সর্বপ্রথম আমার মাথায় আসে দিদার বলা ওই কথাগুলো। যেখানে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ হিন্দিকে জাতীয় ভাষা হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন। এবং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই মন্তব্যই আমাকে বাধ্য করে, দিদার বলা কথাগুলোর সত্যতা খুঁজে দেখতে। আমি জানতে চেয়েছিলাম, গোপনে থেকে যাওয়া সেই সত্য ঘটনার কাহিনী, বুঝতে চেয়েছিলাম হিন্দি ভাষার গুপ্ত ইতিহাস। এবার আমি আপনাদের কাছে তুলে ধরতে চাই, গবেষণায় খুঁজে পাওয়া কিছু তথ্য।

 

ভারতে ভাষার বৈচিত্র

মাত্র ৭০ লক্ষ জনসংখ্যার পাপুয়া নিউগিনিতে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি ভাষার সংখ্যা লক্ষ্য করা গিয়েছে। পাপুয়া নিউগিনিতে মোট ভাষার সংখ্যা ৮৫২ টি (তার মধ্যে ৮৪০ টি ভাষা এখনও বলা হয়, ১২ টি ভাষার বর্তমানে ব্যবহার নেই)। ২০০৯ সালে প্রকাশিত ইউনেসকোর লিঙ্গুইস্টিক ডাইভার্সিটি ইনডেক্সে পাপুয়া নিউগিনির স্কোর ০.৯৯০, যেখানে নবম স্থানে থাকা ভারতের স্কোর ০.৯৩০।
কিন্তু জনসংখ্যার নিরিখে যদি আমরা ভাষার বৈচিত্রের তুলনামূলক হিসেবে যাই, তাহলে দেখব ১৩০ কোটির ভারত (জনসংখ্যায় বিশ্বে দ্বিতীয়) বাকিদের চেয়ে বহু যোজন এগিয়ে। স্রেফ এই কারণেই ভারতকে সবচেয়ে বেশি জনসংখ্যা বিশিষ্ট ভাষাগত বৈচিত্রের দেশ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।
২০০১ সালের জনগণনা অনুযায়ী, ভারতে ১২২ টি প্রধান ভাষা এবং ১,৫৯৯ টি অন্যান্য ভাষা রয়েছে। পাশাপাশি, এ দেশে অন্তত ৩০ টি এমন ভাষা আছে, যা ১০ লক্ষের বেশি মানুষ প্রাথমিক ভাষা হিসেবে ব্যবহার করেন এবং ১২২ টি ভাষা রয়েছে, যে ভাষায় কথা বলেন দেশের ১০ হাজারের বেশি মানুষ। ভারতে মোট ২২ টি তফসিলভুক্ত ভাষা রয়েছে এবং কেন্দ্রীয় সরকারের কাজে ব্যবহারের স্বীকৃতি পাওয়া (সরকারি বা রাজ ভাষা) দুটি ভাষা হল হিন্দি এবং ইংরেজি।
এর পাশাপাশি ভারত সরকার ক্লাসিকাল ল্যাঙ্গোয়েজ বা চিরায়ত ভাষার স্বীকৃতি দিয়েছে ৬ টি ভাষাকে। যে ভাষার নিজস্ব ঐতিহ্য এবং স্বাধীন উদ্ভব রয়েছে। এই ভাষাগুলো হল কন্নড়, মালয়ালম, ওড়িয়া, সংস্কৃত, তামিল এবং তেলেগু।
তামিল ভাষাকে বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন ভাষা হিসেবে জানা যায়। এই দ্রাবিড়িয় ভাষা সংস্কৃতের চেয়েও প্রাচীন বলে মনে করেন ভাষা ইতিহাসের পণ্ডিতরা।
এই তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে বলা যায়, হিন্দি কখনওই ভারতের জাতীয় ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি এবং ভারতের কোনও জাতীয় ভাষা নেই।
২০১১ সালের জনগণনা থেকে জানা যাচ্ছে, দেশের মাত্র ২৬.৬ শতাংশ মানুষ হিন্দিকে নিজেদের মাতৃ ভাষা হিসেবে চিহ্নিত করছেন।

 

হিন্দি ভাষা

আধুনিক হিন্দি ভারতের অন্যতম নবীন ভাষাগুলোর মধ্যে অন্যতম। এই ভাষার উদ্ভব খারিবোলি ডায়লেক্ট (দিল্লি এবং সংলগ্ন এলাকার স্থানীয় ভাষা) থেকে। অষ্টাদশ শতকের শেষ নাগাদ এই ভাষায় সাহিত্য সৃষ্টির প্রক্রিয়া আরম্ভ হয়।
এদিকে খারিবোলি ডায়লেক্ট আবার আওয়াধি ডায়লেক্টের জায়গা নেয়। সপ্তদশ শতাব্দীর একেবারে গোড়ায় এই আওয়াধিতেই তুলসিদাস রামচরিতমানস লিখেছিলেন। আওয়াধিতে লেখা ভক্তি কবিতাই উত্তর ভারতে রামকে জনপ্রিয়তা দেয়। যে রামের নামে আধুনিক ভারতের রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে।
১৮০০ সাল নাগাদ হিন্দির বিবর্তন শুরু হয়, আরেকটি হিন্দুস্তানি ভাষা উর্দু পারস্যের প্রভাবে আসার পর। এবং এর ফলে উর্দুর ভাষাগত প্রতিপত্তি বেড়েছিল বৈকি। আঠারোশো শতাব্দীর শেষ থেকে উনবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির তত্ত্বাবধানে হিন্দুস্তানি দুটি পৃথক ভাষাকে মানোপযোগী করে তোলা হয়। এই দুটি ভাষা ছিল হিন্দি এবং উর্দু।
সম্ভবত এমনটা করা হয়েছিল, ব্রিটিশদের বিখ্যাত ডিভাইড অ্যান্ড রুল নীতির চূড়ান্ত সাফল্যের দিকে তাকিয়ে। যেখানে হিন্দিকে হিন্দুর এবং উর্দুকে মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের ভাষা হিসেবে চিহ্নিত করে দেওয়ার ইংরেজ মানসিকতা স্পষ্ট।
কিন্তু ভাষা বিভাজনের মাধ্যমে শাসনের ব্রিটিশ নীতি সফল হতো না, যদি না ইতিহাস বিস্মৃত এক ব্যক্তি তা প্রসার ও প্রচারের ভার নিতেন, তাঁকে সহজেই আধুনিক হিন্দুস্তানি ভাষার জনক হিসেবে অভিহিত করা যায়। তিনি জন গিলক্রিস্ট।

 

আধুনিক হিন্দুস্তানি ভাষার জনক জন গিলক্রিস্ট

আদতে স্কটল্যান্ডের বাসিন্দা জন গিলক্রিস্ট হিন্দুস্তানি ভাষা শিক্ষার জন্য নিজের যৌবনে ভারতে ছিলেন। ১৭৮২ নাগাদ গিলক্রিস্ট রয়েল নেভির এক ডাক্তারের শাগরেদ হয়ে বম্বেতে আসেন। ভারতে এসে তিনি যোগ দেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে এবং চিকিৎসক হিসেবে কাজ শুরু করেন। ভারতে কিছুদিন কাটানোর পরই গিলক্রিস্ট হিন্দুস্তানি ভাষা শেখার আগ্রহ প্রকাশ করেন। ১৭৮৫ সালে তিনি কোম্পানির কাছে এক বছরের ছুটির আবেদন করেন। ছুটি নিয়ে ভাষা গবেষণার ইচ্ছে ছিল তাঁর। ১৭৮৭ সালে গিলক্রিস্টের এক বছরের ছুটি মঞ্জুর করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। সেই শেষ, গিলক্রিস্ট আর চিকিৎসা ক্ষেত্রে ফেরেননি।
১৭৮৭ থেকে ১৭৯০ এর মধ্যে প্রকাশিত হয় গিলক্রিস্টের A Dictionary: English and Hindoostanee, Calcutta: Stuart and Cooper। ভারতে ব্রিটিশ প্রশাসন চালাতে হিন্দুস্তানি হিন্দিকে জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন জন গিলক্রিস্ট। ইংরেজদের জন্য রাজ্য শাসনকে আরও সহজ করে তুলতে গভর্নর জেনারেলের কাছে হিন্দুস্তানি হিন্দির বহুল ব্যবহারের আবেদনও জানিয়েছিলেন তিনি। একই সঙ্গে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে কলকাতায় এই নির্দিষ্ট ভাষা শিক্ষার জন্য একটি প্রতিষ্ঠান খোলারও আবেদন জানান গিলক্রিস্ট। যাত্রা শুরু হয় ওরিয়েন্টাল সেমিনারি ওরফে গিলক্রিস্টের মাদ্রাসার। বছরখানেকের মধ্যেই ১৮০০ সালে তার নাম বদলে হয় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ। বর্তমান ফোর্ট উইলিয়ামই ছিল তার ঠিকানা। ১৮০৪ পর্যন্ত এই কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেছেন গিলক্রিস্ট সাহেব। একই সঙ্গে ভাষাতত্ত্ব নিয়ে একাধিক বইও প্রকাশ করেন এডিনবরার আদত বাসিন্দা জন গিলক্রিস্ট।
প্রিন্সিপাল থাকাকালীন গিলক্রিস্ট ভারতীয় লেখকদের কলেজে এনে হিন্দিতে লেখার জন্য উৎসাহ দেওয়ার পাশাপাশি, তাঁদের উৎসাহভাতা দেওয়ার কথাও ঘোষণা করেন। এর মাধ্যমে অত্যন্ত দ্রুত এগিয়ে যেতে থাকে হিন্দি। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ থেকে তৈরি হতে থাকে একের পর এক হিন্দি সাহিত্য। লালুলাল লেখেন প্রেমসাগর। ১৮১৮ সালের মধ্যে বাইবেলের হিন্দি সংস্করণ প্রকাশ পায়। ১৮২৬ সালে এই কলকাতা থেকেই প্রকাশিত হয় প্রথম হিন্দি সংবাদপত্র উদান্ত মার্তণ্ড। ইংরেজ প্রশাসনের ভারত শাসনের সুবিধার জন্য আধুনিক হিন্দি কলকাতার গঙ্গা পাড় থেকে দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে।
এ নিয়ে বিভিন্ন নথি এবং বই প্রকাশিত হয়েছে। যেখানে আধুনিক হিন্দির জন্মস্থান হিসেবে কলকাতার নাম করা হয়েছে। এই প্রসঙ্গেই বুঝতে পারি, দিদা আমার ছেলেবেলায় যে কথাগুলো বলেছিলেন, তা সর্বৈব সত্য। জন গিলক্রিস্টের প্রত্যক্ষ সহায়তায় কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামই আধুনিক হিন্দির আঁতুড়ঘর।
তাই এক্ষেত্রে অন্তত বলাই যায়, যদি উদ্ভবগত দিক থেকে অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের ম্যাকাউলিস চিলড্রেন বলে অভিহিত করা হয়, তাহলে হিন্দিভাষীদের গিলক্রিস্টের সন্তান হিসেবে অভিহিত করা যেতেই পারে।
পরিশেষে বলা যায়, ভারতীয় সভ্যতার বয়স ৮ হাজার বছরেরও বেশি আর সেই আধুনিক ভারতের জাতীয় ভাষা হিসেবে যাকে তুলে ধরার চেষ্টা করা হচ্ছে, তার বয়স কম বেশি ২০০ বছর। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে চাকরি করা এক আপাত সাধারণ স্কটিশ মানুষের হাত দিয়ে যে ভাষার বিস্তার এবং প্রসার, তাকে কীভাবে দেশের জাতীয় ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া সম্ভব?
আসলে হিন্দি দিবসের দিন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের মন্তব্য কোনও নির্দিষ্ট ভাষার স্বীকৃতির পরিচায়ক নয়, বরং বৃহত্তর হিন্দুত্বের অ্যাজেন্ডারই প্রতিফলন। তিনি সংস্কৃতকে দেশের মাতৃভাষা এবং হিন্দিকে জাতীয় ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রচেষ্টায় রত। কিন্তু সংস্কৃত মোটেও ভারতের মাতৃভাষা নয়। এমন কোনও একটি ভাষাকে ভারতের মাতৃভাষা হিসেবে চিহ্নিত করাও যায় না।
যে সমস্ত ভারতীয় হিন্দি-হিন্দুস্তানি গো বলয়ের নন, তাঁরা সহজেই বুঝতে পারছেন, একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য পূরণের উদ্দেশে বহুমাত্রিক হিন্দু সমাজকে একমাত্রিক হিন্দুত্বে রূপান্তরিত করার প্রয়াস চলছে। কোনও একটি ভাষাকে জাতীয় ভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেওয়া সংবিধানসম্মত নয়। কিন্তু জোর করে তা করার চেষ্টা হলে তা ব্যুমেরাং হয়ে ফিরে আসতে পারে এই মতের প্রচারকদের কাছেই। ভারত যে আসলে এক ভাষার ঐক্য চায় না, বরং বিপুল বৈচিত্রের ঐক্য সাধন এদেশেই কেবল সম্ভব।
আবার অন্যদিকে, বিজেপি-আরএসএস হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্থানের লক্ষ্যে যে হিন্দিকে জাতীয় ভাষার স্বীকৃতি দিতে মরিয়া প্রয়াস চালাচ্ছে, সেই ভাষার নামকরণ করেছিল পারস্য এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তথা ব্রিটিশ রাজের প্রত্যক্ষ সহায়তায় সাধারণের কথ্য ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিল। অথচ মুসলিম এবং ক্রিশ্চানদের ভারত আক্রমণকারী হিসেবেই এতদিন মনে করেছে আরএসএস। তাহলে সব মিলিয়ে যা দাঁড়াচ্ছে, যে ভাষার জন্য সর্বশক্তি প্রয়োগ করছে সঙ্ঘ পরিবার তথা বিজেপি, সেই ভাষা আসলে মুসলিম এবং ক্রিশ্চানদের আমাদের দেওয়া উপহার। এর চেয়ে বড় পরিহাস আর কী হতে পারে!

(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)

 

মূল লেখাটি ২৪ শে সেপ্টেম্বর https://thebengalstory.com/english/ এ প্রকাশিত হয়।

বাংলায় অনুবাদ করেছেন অনির্বাণ দাশ

Comments are closed.