বিশ্বজয়ী কলকাতার রসগোল্লার সুলুক সন্ধান

বিয়ের অনুষ্ঠান হোক বা জন্মদিন। বাঙালির শেষ পাতে একটু মিষ্টি না হলে ঠিক জমে না। হরেক রকম সেই মিষ্টির ভিড়ে যদি রসগোল্লা থাকে তো কথাই নেই।

 

রসগোল্লা ও বাঙালির এই সম্পর্ক কিন্তু আজকের নয়। তার হিসেব খুঁজতে গেলে যেতে হবে সেই ১৮৬৮ সালে। বাগবাজারের নবীন ময়রা তখন সবে মিষ্টি বানানোয় হাত পাকাচ্ছেন। একদিন ছানার গোল্লা পাকিয়ে চিনির শিরায় ফেলে তৈরি করে ফেললেন এক অপূর্ব বস্তু। আর বাঙালি পাতে পেল রসগোল্লা। সেই থেকে বাঙালির রসনা তৃপ্তিতে এক অটুট বন্ধনে বাঁধা পড়ে গেল রসগোল্লা। সেই রসগোল্লার কদর আজ গোটা পৃথিবীজুড়ে।

 

নবীন চন্দ্র দাসের হাতে তৈরি এই রসের গোল্লা যখন ধীরে ধীরে বাংলার ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়ল, তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হল চারিদিক। সমস্ত আচার-অনুষ্ঠানে অতিথি অভ্যাগতদের পাতে পড়তে লাগল এই মিষ্টি। দেশ-বিদেশেও এর চাহিদা বাড়তে থাকল।

 

সেই চাহিদার কথা মাথায় রেখে ১৯৩০ সালে নবীনের একমাত্র পুত্র কৃষ্ণ চন্দ্র দাস মহাশয়ের হাত ধরে শুরু হল রসগোল্লার প্রক্রিয়াকরণের প্রস্তুতি। অভিনব পদ্ধতিতে টিনের কৌটোর মধ্যে ভরা হতে থাকল রসগোল্লা। যাতে তাদের আয়ু বাড়ানো যায় ও খুব সহজেই সেই সব টিনের ক্যান রপ্তানি করা যায়। এক কথায় ‘ক্যানড রসগোল্লা’। আজ যে রসগোল্লার এত জনপ্রিয়তা, তার অন্যতম কাণ্ডারি ছিলেন এই কৃষ্ণ চন্দ্র দাস বা কে সি দাস। পরবর্তী সময়ে কেসি দাসের নামের ব্র্যান্ডিং এবং তাঁর বংশধরদের তৈরি করা মিষ্টি শুধু ভারতে নয়, গোটা পৃথিবীতেই সুনাম অর্জন করেছে।

 

গ্রাহকদের চাহিদার কথা মাথায় রেখে বেঙ্গালুরু ও চেন্নাইতেও খোলা হয়েছে এই অভিজাত মিষ্টান্ন প্রতিষ্ঠানের ব্রাঞ্চ। রয়েছেন ৫০০-এর কাছাকাছি কর্মী। এছাড়াও ইউরোপ ও আমেরিকা থেকে রসগোল্লার অর্ডার তো রয়েছেই।

 

নলেন গুড়ের রসগোল্লা
Picture Courtesy: MySahar

 

তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রসগোল্লায় এসেছে বিস্তর পরিবর্তন। আজ আর শুধুমাত্র এই ধবধবে সাদা রসগোল্লা বাঙালির মেনুতে স্থান পাচ্ছে, এমনটা নয়। শীতকাল চিনির শিরার বদলে গুড়ের শিরায় তৈরি হয় নলেন গুড়ের রসগোল্লা। এছাড়া গরমকালের জন্য রয়েছে আম রসগোল্লা আর নতুন সংযোজন বেকড রসগোল্লা। এই বেকড রসগোল্লার জনপ্রিয়তা এখন তুঙ্গে। যার মূলে রয়েছে আর এক বিখ্যাত মিষ্টি প্রস্তুতকারক সংস্থা বলরাম মল্লিক ও রাধারমণ মল্লিক। এই সংস্থার কর্ণধার সুদীপ মল্লিক বলেন, ২০০১ সালে প্রথম যখন এই পারিবারিক ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হই, তখন নতুন কিছু করতে উদ্যোগী ছিলাম। প্রথমে আম রসগোল্লা ও পরবর্তীকালে ছানা দিয়ে রসগোল্লা বেক করে তৈরি করি এই বেকড রসগোল্লা। প্রথম প্রথম কেমন ছিল এই বেকড রসগোল্লার গ্রহণযোগ্যতা? সুদীপ বলেন, প্রথম প্রথম এটিকে কিছু লোকে পোড়া রসগোল্লা বলে বিদ্রূপ করলেও, পরবর্তীকালে এর জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। আজ কলকাতার অনেক নামি মিষ্টি প্রস্তুতকারী সংস্থাও তৈরি করছে এই বেকড রসগোল্লা। তেমনি বাড়ছে চাহিদাও। কলকাতার বাইরে, আজ সারা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়ছে বলরাম মল্লিক ও রাধারমণ মল্লিক-এর ম্যানুফ্যাকচারিং ইউনিটে তৈরি হওয়া এই মিষ্টি। মানুষ পছন্দও করছেন।

 

বেকড রসগোল্লা
Picture Courtesy: Am2PmFood – Youtube

 

এছাড়াও কলকাতার বুকে এই রসগোল্লা নিয়ে বিস্তর পরীক্ষানিরীক্ষা হয়েছে। তবে এই একবিংশ শতাব্দীর ব্যাস্ততায় মানুষ আজ অনেকটাই স্বাস্থ্য সচেতন। আগেকার মতো বিয়ে বাড়ি বা অনুষ্ঠানে ১০-১৫টা রসগোল্লা কেউ সচরাচর খান না। বড়জোর একটা কিংবা দুটো। কিন্তু তাতে ব্যবসা বা চাহিদায় কোনও ঘাটতি এসেছে? জবাবে কে সি দাস সংস্থার কর্ণধার ধীমান দাসের সাফ বক্তব্য, না আসেনি, উল্টে বেড়েছে। সুদীপ বলেন, আজ একজন হয়ত খুব বেশি রসগোল্লা একবারে খান না, কিন্তু আগের তুলনায় এখন অনেক বেশি মানুষ রসগোল্লা খাচ্ছেন।

 

পাল্টেছে সময়, পাল্টেছে শতক। এর মাঝে গঙ্গা দিয়ে বয়ে গেছে অনেক জল। কিন্তু বাঙালির পাতে আজও রসগোল্লার কোনও বিকল্প নেই।

 

মাঝখানে রসগোল্লার পেটেন্ট কার, বাংলা না ওড়িশার, তা নিয়ে অনেক বিতর্ক হয়েছে, মামলা হয়েছে। সেই বিতর্কে জয় হয়েছে বাংলার। এই পেটেন্টের অধিকারী বাংলাই।

Comments are closed.