হেলথ ইনস্যুরেন্সের টাকা পাওয়ার জন্য হাসপাতালে প্ল্যানড এবং আনপ্ল্যানড চিকিৎসার সব নিয়ম জানেন তো?

এর আগের পর্বে আমরা আলোচনা করেছি, সাধারণ মানুষ যখন কোন হেলথ ইনস্যুরেন্স পলিসি কিনতে যাবেন, তখন কোন কোন বিষয় মাথায় রাখবেন। আজ হেলথ ইনসুরেন্সের এই পর্বে আমরা আলোচনা করব, কীভাবে আপনার ইনস্যুরেন্স কোম্পানির কাছে থেকে কোন অসুখের সময় আপনি টাকা ক্লেম করবেন।
শুরুতেই বলে রাখি, দুই ধরনের রোগের চিকিৎসা করাতে পারেন আপনার হেলথ ইনস্যুরেন্সের মাধ্যমে। এক প্ল্যানড ও অন্যটি আনপ্ল্যানড বা ইমারজেন্সি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, আমাদের এই আনপ্ল্যানড পদ্ধতিতেই হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। কিন্তু তাহলে প্ল্যানড পদ্ধতি বলতে কী বোঝানো হয়েছে? ধরুন, আপনি ডাক্তারের কাছে গেলেন পেটে ব্যাথা নিয়ে। ডাক্তার আপনাকে বললেন বেশ কয়েকটি টেস্ট করাতে। আপনি সেগুলি করালেন। এরপর ডাক্তার বললেন অপারেশন করাতে। অপারেশনের দিনক্ষণ স্থির হল এবং আপনি হাসপাতালে ভর্তি হলেন। এই পদ্ধতিতে যদি আপনি হাসপাতালে ভর্তি হন, তাহলে সেটি প্ল্যানড ক্লেমস-এর আওতায় পড়বে।

কিন্তু যদি ধরুন হঠাৎ আপনার বুকে ব্যথা শুরু হল এবং আপনাকে তৎক্ষণাৎ হাসপাতালে ভর্তি হতে হল। বা কোন দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে আপনাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হল। সেক্ষেত্রে আপনার ক্লেম কিন্তু আনপ্ল্যানড বা ইমারজেন্সি ক্যাটেগরিতে পড়বে। যদি আপনি প্ল্যানড মাধ্যমে হাসপাতালে ভর্তি হন, সে ক্ষেত্রে আপনার ইনস্যুরেন্স কোম্পানিকে কিন্তু আগে থেকে জানিয়ে যা ক্লেম হবে তা প্রি-স্যাংশন্ড করিয়ে নেওয়াই উচিত। সে ক্ষেত্রে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার ৩০ দিন আগে থেকে হাসপাতাল ছাড়ার ৬০ দিন পর্যন্ত আপনার যা যা খরচা হবে, সব আপনি পেয়ে যাবেন ইনস্যুরেন্স কোম্পানি থেকে।
অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, পলিসিতে প্ল্যানড ক্লেমস-এর ক্ষেত্রে আগে থেকেই টাকার পরিমাণ বেঁধে দেওয়া রয়েছে। সেটা অনেক গ্রাহকই জানেন না বা তাঁদের জানানো হয় না। যেমন ধরুন, চোখের ছানির অপারেশনের ক্ষেত্রে যদি পলিসিতে ২০ হাজার টাকা লেখা থাকে, সে ক্ষেত্রে কিন্তু আপনার ছানি অপারেশন করার ক্ষেত্রে যত টাকাই খরচ হোক না কেন, আপনি ওই টাকাই পাবেন। অতিরিক্ত খরচ আপনাকে কিন্তু নিজের পকেট থেকে দিতে হবে। তাই পলিসি কেনার সময় এই বিষয়গুলি অবশ্যই নজরে রাখবেন।
অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় যে কোন একটি রোগের ক্ষেত্রে একবার অপারেশনে কাজ হয় না। সে ক্ষেত্রে দু’বার বা তিনবার অপারেশন করার দরকার পড়ে। সে ক্ষেত্রে অনেকের মনে সংশয় থেকে যায়, যদি সেরকম কোনও পরিস্থিতির উৎপত্তি হয়, সে ক্ষেত্রেও কিন্তু আপনি প্রত্যেক অপারেশনের টাকা পাবেন।
এক্ষেত্রে, দুটি টার্মের সঙ্গে আপনাদের পরিচিত হওয়া খুব দরকার। এক রিস্টোর আর রিচার্জ। রিচার্জের ক্ষেত্রে আপনার যতবারই টাকা কমে আসবে, সেক্ষেত্রে কোম্পানি আপনাকে আপনার পলিসিতে সেই পরিমাণ টাকা ভরে দেবে। ধরুন আপনি ৫ লাখ টাকার পলিসির উপর আরও ৫ লাখ টাকার রিচার্জ নিলেন। আপনি হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর আপনার বিল এসে দাঁড়াল ৫ লক্ষ টাকা। সেক্ষেত্রে আপনার পলিসিতে অটোমেটিক আরও ৫ লক্ষ টাকা এসে যাবে পরবর্তীকালে আবার কোনও খরচের জন্য। অনেক কোম্পানির ক্ষেত্রে একটা রিচার্জ পলিসির সঙ্গেই দেওয়া হয়, আবার অনেক ক্ষেত্রে আপনাকে রিচার্জ কিছু এক্সট্রা প্রিমিয়াম দিয়ে কিনতে হয়।
রিস্টোরের ক্ষেত্রে পদ্ধতিটা আবার কিছুটা অন্যরকম। আপনি ধরুন ৫ লক্ষ টাকার পলিসি কিনলেন। সেক্ষেত্রে যতক্ষণ না আপনার ৫ লক্ষ টাকা শেষ হচ্ছে ততক্ষণ আপনার পলিসিতে আর কোনও টাকা ঢুকবে না। ৫ লাখ টাকা শেষ হয়ে যাওয়ার পরেই আপনি আরও ৫ লাখ টাকা পাবেন। এখানে একটা কথা মাথায় রাখা দরকার। রিচার্জের ক্ষেত্রে অনেক মানুষ চাইলে আনলিমিটেড রিচার্জের পলিসি কিনতে পারেন। রিচার্জের ক্ষেত্রে কিন্তু এক বছর একটি রোগের জন্য একবারই ক্লেম করতে পারবেন আপনি। অবশ্য বেস অ্যামাউন্টটা আপনি ব্যবহার করতেই পারেন। ধরুন আপনার ৫ লাখ টাকার ডিডাক্টেবেল পলিসি রয়েছে। আপনি ৩ লাখ টাকা খরচ করে গল ব্ল্যাডারে অপারেশন করলেন। তিন মাস পরে আবার আপনার অপারেশন হল। তখনও খরচ হল ৩ লাখ টাকা। সেখত্রে কিন্তু ১ লাখ টাকা আপনাকে পকেট থেকে দিতে হবে। সেই বছর গল ব্ল্যাডার ছাড়া অন্য রোগের ক্ষেত্রে আপনি রিচার্জের টাকা ব্যবহার করতে পারবেন।

কিন্তু রিস্টোর-এর ক্ষেত্রে সেরকম হয় না। সেক্ষেত্রে যিনি চিকিৎসা করালেন সেই বছরে একমাত্র তিনিই সেই সংক্রান্ত রোগের উপরে ক্লেম করতে পারবেন। ধরুন হার্টের সমস্যা নিয়ে বছরে তিনবার আপনাকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হল, সে ক্ষেত্রে তিনবারই আপনি টাকা পাবেন, যদি আপনার বিল ৫ লাখের উপরে চলে যায়। কিন্তু সেক্ষেত্রেও আপনার পুরো টাকা শেষ না হওয়া পর্যন্ত রিস্টোর হবে না। যদি ধরুন আপনার প্রথমবারের বিল হল ৩ লাখ এবং দ্বিতীয়বারের বিলও ৩ লাখ, সেক্ষেত্রে কিন্তু ১ লাখ টাকা আপনাকে আপনার পকেট থেকে দিতে হবে।
এক্ষেত্রে বলে রাখা উচিত, প্রত্যেকটি পলিসির মেয়াদ কিন্তু এক বছরের। বছর শেষে আপনাকে পলিসি রিনিউ করাতে হবে। সেসময় চাইলে আপনি অন্য কোথাও আপনার পলিসি পোর্ট করাতেই পারেন। তাই পলিসি কেনার সময় অবশ্যই দেখে নেবেন আপনার পলিসিটি লাইফ টাইম রিনিউয়েবেল কিনা।
এখানে আরও একটি বিষয় মাথায় রাখা দরকার। কেউ টপ-আপ প্ল্যান কিনবেন না। যদি আপনার ৫ লাখ টাকার ডিডাক্টেবেল পলিসির উপর আপনি ৫ লাখ টাকার টপ-আপ প্ল্যান নেন, সেক্ষেত্রে প্রতিবার হাসপাতালের বিল ৫ লাখ টাকা অতিক্রম করলেই আপনি টপ আপের সুবিধে পাবেন, নচেৎ নয়। যদি নেন সেক্ষেত্রে অবশ্যই সুপার টপআপ প্ল্যান নেবেন। সেক্ষেত্রে প্রতিবার হাসপাতালের বিল ৫ লাখ টাকা না পেরোলেও চলবে। সব মিলিয়ে ৫ লাখ টাকা পেরোলেই আপনি সুপার টপ আপ থেকে টাকা পেয়ে যাবেন। যদি আপনার বেস প্ল্যান ও টপ-আপ পলিসি দুটো আলাদা কোম্পানিতে থাকে, সেক্ষেত্রে বেস পলিসি ক্যাশলেস হবে, টপ-আপ পলিসি কিন্তু রিইমবার্সমেন্ট হবে।

(লেখক বিশিষ্ট ফিনান্সিয়াল প্ল্যানার। ইনস্যুরেন্স বা বিনিয়োগ সংক্রান্ত যে পরামর্শের জন্য যোগাযোগ করুন: 9836374487/ 9836566559, email: [email protected])

Comments are closed.