আত্মনির্ভর ভারত: বিরোধিতা উড়িয়ে মধ্য ভারতের প্রাচীন অরণ্যে ৪০ টি কয়লা খনি বেসরকারিকরণের অনুমতি, বরাত পেতে এগিয়ে আদানি গোষ্ঠী

চিনের সঙ্গে সাম্প্রতিক সীমান্ত উত্তেজনার নিরিখে আত্মনির্ভর হওয়ার ডাক দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। উৎপাদনের ক্ষেত্রে আমদানির উপর নির্ভরতা কমিয়ে দেশীয় পণ্যের উপর জোর দেওয়ার কথা বলেছেন। আর এই লক্ষ্যেই ৪০ টি নতুন কয়লা খনি তৈরিতে সবুজ সঙ্কেত দিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। যার প্রতিটি পড়ছে মধ্য ভারতের বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদ সম্পন্ন ঘন বনভূমি এলাকায়। আর সমস্যার সূত্রপাত সেখানেই। অভিযোগ, আত্মনির্ভর ভারত স্লোগানের মধ্যে দিয়ে আসলে আদিবাসী উচ্ছেদ করে, নির্বিচার সবুজ নিধনের মাধ্যমে ভূপ্রাকৃতিকভাবে ভারতের সবচেয়ে স্পর্শকাতর অরণ্যভূমিকে কর্পোরেটের হাতে তুলে দেওয়ার পরিকল্পনা করছে মোদী সরকার। দ্য গার্ডিয়ান সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে এমনই এক প্রতিবেদন।

কোভিড পরিস্থিতিতে দেশের বিপর্যস্ত অর্থনীতিকে ঘুরে দাঁড় করাতে আত্মনির্ভর ভারত ক্যাম্পেনের উপর জোর দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। সেই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে দেশের পরিবেশগতভাবে অত্যন্ত স্পর্শকাতর ঘন অরণ্যে ৪০ টি নতুন কয়লা ব্লকের বাণিজ্যিক খননের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। যার মধ্যে পড়ছে ছত্তিসগঢ়ের হাসদেও আরান্ড বনাঞ্চলের প্রায় ৪ লক্ষ ২০ হাজার একর জমিতে ৪ টি কোল ব্লক। প্রায় ৫ বিলিয়ন টন কয়লা ভাণ্ডারের উপর বসে থাকা হাসদেও আরান্ড জঙ্গলে খনি তৈরি করতে পরিবেশ মন্ত্রকের ছাড়পত্রও পেয়েছে আদানি গোষ্ঠী।

দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই পদক্ষেপ অত্যন্ত স্পর্শকাতর। ভারতের কয়লা খনি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন হলেও এই ৪০ টি কয়লা খনির নিলাম প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে খনির বেসরকারিকরণ ও বাণিজ্যকরণ শুরু হল। এমনই দাবি করা হয়েছে প্রতিবেদনে।

কোল ব্লক নিলামে অংশ নিয়েছেন ভারতের তাবড় ব্যবসায়ীরা। যাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য নাম শিল্পপতি গৌতম আদানির। দেশের বৃহত্তম তাপ বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী আদানি গোষ্ঠী। কিন্তু যে অঞ্চলগুলিতে বাণিজ্যিকভাবে কয়লা উত্তোলনের ছাড়পত্র দিচ্ছে মোদী সরকার, তার বেশিরভাগ জুড়ে রয়েছে আদিম অরণ্য। যা দশকের পর দশক বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য ধরে রেখেছে। সেই আদিম অরণ্যগুলি আজ বুলডোজারের দানবীয় শব্দে কাঁপছে। ইতিমধ্যেই কয়েকটি কয়লাখনির নিলাম নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে আঞ্চলিক ও রাজনৈতিক স্তরে। দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে দাবি, অন্তত সাতটি কোল ব্লক নিয়ে ইতিমধ্যেই বাধা এসেছে। ওই অঞ্চলগুলির পরিবেশগত মূল্যই এর বড় কারণ। তাছাড়া এই কোল ব্লকগুলির ৮০ শতাংশ অঞ্চল জুড়ে বসবাস করেন আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ। অরণ্য নিধন করে কয়লা খনি তৈরি করলে তাঁদের বসবাস, রুজি রোজগারের কী হবে, সে প্রশ্নও তোলা হয়েছে দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে।

পশ্চিমবঙ্গ, মহারাষ্ট্র, ঝাড়খণ্ড ও ছত্তিশগড় সরকার পৃথকভাবে এই কয়লাখনি নিলাম প্রক্রিয়ার বিরোধিতা করে কেন্দ্রকে চিঠি দিয়েছে। মহারাষ্ট্রের তাদোবা টাইগার রিজার্ভ এই পদক্ষেপের ফলে বিপর্যয়ের মুখে পড়তে পারে। চিঠি দিয়ে বিরোধিতা করেছে নানা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাও। হাসদেও আরান্ড বনভূমি অঞ্চলের আদিবাসী সম্প্রদায়ের তরফেও এই কয়লাখনির বিরোধিতা করে প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি পাঠানো হয়েছে।

দ্য গার্ডিয়ান এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই কয়লাখনির কাজ হলে অন্তত পাঁচটি গ্রামের ৬ হাজার আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ আশ্র‍য় হারাবেন। তাছাড়া কয়েক হাজার হেক্টর জমিজুড়ে পুরনো গাছগাছালি ধ্বংস করে দিতে হবে খনির জন্য। ইতিমধ্যেই কয়লাখনির জন্য কাটা পড়েছে প্রচুর প্রাচীন গাছ। যদি কয়লাখনি আরও সম্প্রসারণ করা হয় তাতে প্রাকৃতিক ভারসাম্য সমূহ বিপদের মুখে পড়বে।

এদিকে কোভিড পরবর্তী পরিস্থিতিতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশকে সবুজায়নের উপর জোর দিতে বলছে রাষ্ট্রসঙ্ঘ। বলা হচ্ছে আপাতত কয়লা শক্তির উপর নির্ভরতা কমাতে হবে। অথচ প্রধানমন্ত্রী মোদী এই কয়লাখনি প্রোজেক্টের নিলাম প্রক্রিয়া ঘোষণার সময় মন্তব্য করেছিলেন, কেন বিশ্বের বৃহত্তম কয়লা রফতানিকারী দেশ হিসেবে উঠে আসবে না ভারত?

দ্য গার্ডিয়ান এর প্রতিবেদনে দাবি, এই ধরনের কয়লার বিশ্ববাজারে চাহিদা কম। তাছাড়া ভারতের শিল্পের চাহিদাও এই মানের কয়লায় পূরণ হবে না। বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ কয়লা আমদানি করা ভারত এই খাতে বছরে প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলার খরচ করে। কোভিড পরবর্তী পরিস্থিতিতে ভারতে বিদ্যুতের চাহিদা ১৫ শতাংশ পর্যন্ত কমে যাওয়ার পূর্বাভাস দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। সাম্প্রতিক এক রিপোর্টে জানা গিয়েছে, ২০৩০ সাল পর্যন্ত প্রয়োজনীয় কয়লা জ্বালানির চেয়ে ২০ শতাংশ বেশি কয়লা উৎপাদন করতে পারে ভারত। কিন্তু কেন্দ্র বলছে কয়লা উৎপাদনের মাধ্যমেই বিশাল আয় হতে পারে, হবে বিপুল কর্মসংস্থান। আঞ্চলিক ও আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষের জীবনের মানোন্নয়ন হবে। কিন্তু পরিবেশের কী হবে? সে প্রশ্ন থেকেই যায়।

এই পরিস্থিতিতে উন্নয়নের ধাক্কা সামলাতে থরহরি কম্প প্রাকৃতিকভাবে দেশের সবচেয়ে সমৃদ্ধ বনভূমি। হাজার হাজার আদিবাসী, বনজ সম্পদ তথা অরণ্যপ্রাণ ধ্বংসের মুখে। পরিবেশ রক্ষার জন্য আন্দোলনকারীরা সরকারকে সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করার আবেদন করেছেন। চিঠি লিখে আপত্তি জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকারগুলো। জমি না ছাড়ার দাবিতে অনড় স্থানীয়রা। প্রয়োজনে প্রাণ দিতেও রাজি, জানাচ্ছেন আদিবাসী নেতৃত্ব। অন্যদিকে মধ্য ভারতের বিপুল বনভূমি এলাকায় খনির কাজ চালাতে ক্রমেই সরকারের উপর চাপ বাড়াচ্ছে বিভিন্ন শিল্প সংস্থা। যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য আদানি গোষ্ঠী। এই পরিস্থিতিতে মোদী সরকার কি পরিবেশ ও অরণ্যবাসীদের কথা বিবেচনা করে পিছিয়ে আসবে? সেটাই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।

Comments are closed.