১ জুন থেকে আনলক পর্ব: ভারত কি স্টেজ ৩ এ প্রবেশ করছে? গত ৭ দিনে হু-হু করে বৃদ্ধি পাচ্ছে সংক্রমণ! কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা

চার পর্বের লকডাউনের পর আনলক পর্বের শুরু দেশে। এবার লকডাউন শুধু কনটেইনমেন্ট জোনে। বাকি জায়গায় আস্তে আস্তে শুরু হবে কাজকর্ম। স্বাভাবিকতা ফেরানোর পথে প্রথম ধাপ। কিন্তু চার পর্বের লকডাউনের কী লাভ পেল দেশ? আর অবশ্যম্ভাবী হিসেবে চলে আসছে আরও একটি প্রশ্ন, তা হল ভারত কি গোষ্ঠী সংক্রমণ বা থার্ড স্টেজে ঢুকে পড়েছে?
এই প্রশ্ন জোরালো হচ্ছে, কারণ, গত ৭-১০ দিন ধরে ট্রেনে শ্রমিক যাতায়াত শুরু হওয়ার পর দেশে হু-হু করে বৃদ্ধি পাচ্ছে সংক্রমিতের সংখ্যা।
ভারতে করোনা পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করতে হবে মূলত দুটি বিষয়কে মাথায় রেখে। প্রথমত, সংখ্যাতত্ত্ব এবং দ্বিতীয়ত কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা?
সংখ্যাতত্ত্বের হিসেব দেখতে গেলে, প্রথমেই যে বিষয়টি নজরে আসবে তা হল, করোনাভাইরাস সীমাবদ্ধ ছিল একান্তভাবেই শিল্প-বাণিজ্য প্রধান শহুরে এলাকায়, তা ক্রমশ ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে। এই মুহূর্তের হিসেবে (৩১ মে পর্যন্ত) ভারতের ৭০০ টিরও বেশি জেলায় করোনা সংক্রমিতের সন্ধান মিলেছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রকের পরিসংখ্যান থেকেই তা পরিষ্কার। লকডাউন পর্বে মুখ্যমন্ত্রীদের সঙ্গে ভিডিও বৈঠকে নরেন্দ্র মোদী গ্রামীণ ভারতকে ভাইরাসের হাত থেকে বাঁচানোর কথা জোর দিয়ে বলেছিলেন। লকডাউন যখন ওঠার পথে, গ্রামীণ ভারত কতটা বাঁচতে পেরেছে?
কেন্দ্রের পরিসংখ্যান বলছে, ৩০ মে শনিবার দেশে একদিনে সর্বোচ্চ সংক্রমণ ধরা পড়েছে। ২৪ ঘণ্টায় ৮,৩৮০ জন সংক্রমিত হয়েছেন। মৃত্যু হয়েছে ১৯৩ জনের। এই প্রথম একদিনে ৮ হাজারেরও বেশি মানুষের দেহে সংক্রমণ ধরা পড়ল। শনিবার দেশে মোট সংক্রমিতের সংখ্যা বেড়ে হল প্রায় ১ লক্ষ ৮২ হাজার। সব মিলিয়ে মৃত্যু ছাড়িয়েছে ৫ হাজারের গণ্ডি।
ঠিক তার আগের দিন, ২৯ মে ৭,৯৬৪ জনের সংক্রমণ ধরা পড়েছিল। মৃত্যু হয়েছিল ২৬৫ জনের।
২৭ মে অর্থাৎ বুধবার, ৬,৫৬৬ জন সংক্রমিত হন, মৃতের সংখ্যা ছিল ১৯৪। এই দিনটি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এই নিয়ে টানা সপ্তম দিন দৈনিক ৬ হাজারের বেশি মানুষ সংক্রমিত হন।
আরও একটু পিছিয়ে গেলে দেখা যাবে ১৮ মে সোমবার, দেশে ৪,৯৭০ জনের করোনা ধরা পড়েছিল। মৃত্যু হয়েছিল ১৩৪ জনের। ১৮ তারিখ, অর্থাৎ লকডাউনের অষ্টম সপ্তাহে ভারতে সংক্রমিতের সংখ্যা ১ লক্ষ পেরোয়।
অর্থাৎ একটা বিষয় পরিষ্কার, লকডাউন যখন পর্যায়ক্রমে তুলে নেওয়া হচ্ছে, তখন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে সংক্রমিতের সংখ্যা। আর এখানেই উঠছে সেই অমোঘ প্রশ্ন, ভারত কি তাহলে করোনাভাইরাসের থার্ড স্টেজ বা কমিউনিটি ট্রান্সমিশন পর্যায়ে ঢুকে পড়ল?
চেন্নাইয়ের ইন্সস্টিটিউট অফ ম্যাথেমেটিক্যাল সায়েন্সেস ও সোনেপথের অশোকা ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক তথা ম্যাথেমেটিক্যাল ডিজিস মডেলিংয়ের কিংবদন্তি প্রোফেসর গৌতম মেনন তথ্য ও পরিসংখ্যান দিয়ে দাবি করছেন, ভারত আড়াই মাস আগেই থার্ড স্টেজে ঢুকে পড়েছে।
কিন্তু কীসের ভিত্তিতে এমন কথা বলছেন প্রোফেসর মেনন? যেখানে কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে এখনও তা স্বীকার করা হচ্ছে না? প্রোফেসর মেননের মতে, আজ নয় ১৮ মার্চ নাগাদই ভারত করোনাভাইরাসের থার্ড স্টেজ বা কমিউনিটি ট্রান্সমিশনের স্তরে ঢুকে পড়েছে।
কেন ১৮ মার্চ?
সেদিন দিল্লি থেকে ট্রেনে করে চেন্নাই যাওয়া এক ব্যক্তির করোনা পজিটিভ ধরা পড়ে। সেদিনই বোঝা গিয়েছিল, সংক্রমণ এবার তৃতীয় স্তরে প্রবেশ করে ফেলেছে। এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে প্রোফেসর মেনন বলছেন, মহামারির সময় থার্ড স্টেজ নির্ধারণের উপায় হল, যখন কোনও সংক্রমিতের সংক্রমণের উৎস ধরা যায় না। অর্থাৎ, ওই ব্যক্তি বিদেশ যাননি, বিদেশ থেকে ফেরা কারও সংস্পর্শেও আসেননি, তবুও তিনি সংক্রমিত হলেন। এর অর্থ হল, সংক্রমণ এখন স্থানীয় স্তরে ছড়ানো শুরু হয়ে গিয়েছে।
দেশের অন্যতম ভাইরোলজিস্ট তথা বিজ্ঞানী এবং ভেলোরের ক্রিশ্চান মেডিক্যাল কলেজের অবসরপ্রাপ্ত ডাক্তার টি জেকব জনেরও বক্তব্য ঠিক তাই। অর্থাৎ, আজ থেকে প্রায় আড়াই মাস আগে, মার্চের মাঝামাঝি সময়েই ভারত কমিউনিটি ট্রান্সমিশন বা গোষ্ঠী সংক্রমণের স্তরে পৌঁছে গিয়েছে। এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হল সরকার তা স্বীকার করেছে না কেন? এই প্রেক্ষিতেই প্রশ্ন উঠছে, তাহলে কি ভারত সরকার গোষ্ঠী সংক্রমণের নতুন কোনও সংজ্ঞায় বিশ্বাস রাখছে, নাকি সর্বব্যাপী আতঙ্ক ছড়াতে পারে এই আশঙ্কায় মুখ বুজে রয়েছে?
প্রোফেসর মেনন বলছেন, তাঁদের তৈরি করা পরিসংখ্যান সারণি অনুযায়ী এই মুহূর্তে ভারতে ১ কোটি করোনা সংক্রমিত রয়েছেন। কিন্তু ভারতের করোনাভাইরাস সংক্রমণ শীর্ষে বা পিকে পৌঁছবে কবে? তারও উত্তর দিয়েছেন প্রোফেসর গৌতম মেনন। তাঁর মতে, জুলাইয়ের মাঝামাঝি থেকে অগাস্টের শেষ পর্যন্ত সময়ে ভারত পিকে পৌঁছবে।

গ্রামীণ ভারতে যদি সংক্রমণ একবার ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে কি তা আরও ভয়াবহ চেহারা নেবে? এই প্রসঙ্গে অবশ্য ভিন্নমত প্রোফেসর মেননের। তাঁর মতে, সংক্রমণের মূল কথা হল গা ঘেষাঘেষি করে থাকা। গ্রামীণ ভারত মুম্বই কিংবা কলকাতার মতো ঘিঞ্জি নয়। পাশাপাশি, এতদিন সংক্রমণ পর্ব চলায় মানুষের মধ্যে সচেতনতাও বেড়েছে। ফলে তা এতটা ভয়াবহ আকার নাও নিতে পারে। আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তিনি মনে করিয়ে দিচ্ছেন, তা হল ভারতীয়দের গড় আয়ু, যা ইউরোপ-আমেরিকার চেয়ে অনেকটাই কম। তাই তরুণ ভারতে করোনার প্রকোপ সেই দেশগুলোর চেয়ে কম হচ্ছে বলেই এখনও পর্যন্ত লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

Comments are closed.