কিষেণজি মৃত্যু রহস্য #১৪

আগের পর্ব যেখানে শেষ হয়েছিল: ২০০৯ লোকসভা ভোটের আগের দিন রামজীবন মুর্মুর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে শুনলাম, তাঁর ছেলেকে দু’বার ধরেছে পুলিশ….

 

১০ নভেম্বর, ২০০৮  

১০ নভেম্বর বলতে আমি বুঝি নন্দীগ্রাম, ২০০৭। পশ্চিম মেদিনীপুরের গড়বেতা, চন্দ্রকোণার সিপিআইএম বাহিনীর নন্দীগ্রাম দখল এবং সেখানে কয়েকদিন ধরে চলা ভয়ানক পরিস্থিতি। সিপিআইএমের ভাষায় নন্দীগ্রামে সূর্যোদয়, যা শুরু হয়েছিল ২০০৭ সালের ৫-৬ নভেম্বরে। শেষ পর্যন্ত সিপিআইএম নন্দীগ্রাম দখল করল ১০ নভেম্বর। পরের বছর, ২০০৮ সালে একই দিনে নন্দীগ্রামে মিটিং ডাকল সিপিআইএম। নন্দীগ্রাম দখলের বর্ষপূর্তির সমাবেশ। বিস্ময়কর এমন অগণতান্ত্রিক ঔদ্ধত্য!
কয়েক মাস আগের পঞ্চায়েত ভোটে ভরাডুবি হয়েছে, স্থানীয় মানুষের সমর্থন নেই, কিন্তু কিছুতেই কিছু এসে যায় না। কারণ, পরের বছর লোকসভা ভোট। ২০০৮ সালের ১০ নভেম্বর নন্দীগ্রামের সীতানন্দ কলেজ মাঠে সিপিআইএমের ওই মিটিংয়ে দুই প্রধান বক্তা তমলুকের তৎকালীন সাংসদ লক্ষ্মণ শেঠ এবং রাজ্যের পরিবহণমন্ত্রী সুভাষ চক্রবর্তী।
সিপিআইএমের এই সমাবেশ ফের একবার নন্দীগ্রাম যাওয়ার সুযোগ করে দিল। আবার অ্যাসাইনমেন্টে নন্দীগ্রাম, সঙ্গে ক্যামেরাম্যান এবিপি আনন্দের উজ্জ্বল ঘোষ। বিকেল পাঁচটা নাগাদ সমাবেশ শেষ হল। সেদিন নন্দীগ্রাম যাওয়ার পথে ফোনে কথা হয়েছিল খেজুরির সিপিআইএম নেতা হিমাংশু দাসের সঙ্গে। হিমাংশুদা বলেছিলেন, নন্দীগ্রামের মিটিং হয়ে গেলে ফেরার পথে হেঁড়িয়া পার্টি অফিস ঘুরে যেতে। নন্দীগ্রামের সমাবেশ শেষ করে রওনা দিলাম হেঁড়িয়ার দিকে, তেখালি ব্রিজ পেরিয়ে খেজুরি হয়ে। কয়েক মাস বাদেই লোকসভা ভোট। জানতাম, লোকসভা ভোটকে কেন্দ্র করে আবার যে কোনও মুহূর্তে উত্তেজনা, সংঘর্ষ শুরু হবে নন্দীগ্রাম, খেজুরিতে। সিপিআইএমের নন্দীগ্রাম অপারেশনের সমস্ত প্ল্যানিং তখন এক্সিকিউট হয় খেজুরি থেকে। ভাবলাম, খেজুরিটা একবার ঘুরেই যাই। পঞ্চায়েত নির্বাচন পরবর্তী নন্দীগ্রাম নিয়ে কী প্ল্যান শাসক দলের, কিছুও যদি আঁচ পাওয়া যায়!
খেজুরিতে সবে ঢুকেছি, সন্ধে নেমেছে। অফিস থেকে ফোন। ‘এখনই লালগড় যেতে হবে। গণ্ডগোল শুরু হয়েছে। স্থানীয় লোকজন রাস্তা কাটতে শুরু করেছে।’
২০০৭ সালের গোড়া থেকেই রাজ্যের যা পরিস্থিতি, আমার মতো সাধারণ বাস্তববোধ সম্পন্ন সাংবাদিকও জানত, অ্যাসাইনমেন্টে তিন ঘণ্টার জন্যও কলকাতার বাইরে গেলে এক্সট্রা জামা-কাপড় এবং গুরুত্বপূর্ণ কিছু জিনিস নিয়ে বেরনো মাস্ট। কখন কোথায় কী ঘটে যাবে আঁচ করা অসম্ভব। হয়তো কোনও জেলায় এক জামা-কাপড়ে আটকে গেলাম দু’রাত, তিন দিন। যে কোনও সময় রাজ্যের যে কোনও জায়গায় যা খুশি ঘটতে পারে, এমন এক বিচিত্র আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির মধ্যে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য তখন সকাল-বিকেল মহাকরণে বসেন মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে। নিজের প্রশাসন, পুলিশ বাহিনীর থেকেও অসহায় অবস্থা তাঁর। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য তখন নামেই রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান।
এমনই এক জামা-কাপড়ে আটকে পড়ার অভিজ্ঞতা আমার হয়েছিল সেদিনের সপ্তাহখানেক আগেই, পশ্চিম মেদিনীপুরে। সেদিন মানে, যেদিন সন্ধ্যায় নন্দীগ্রাম থেকে খেজুরি যাওয়ার সময় হঠাৎই অফিস থেকে ফোন পেলাম, লালগড় যেতে হবে, তার ঠিক সাত দিন আগে।
সেটা ২রা নভেম্বর, ২০০৮। শালবনিতে জিন্দল গোষ্ঠীর ইস্পাত কারখানার শিলান্যাস অনুষ্ঠানে গিয়েছি। সঙ্গী ক্যামেরাম্যান প্রবীর সামন্ত। অনুষ্ঠান শেষ করে কলকাতায় ফিরছি। দুপুর আড়াইটে-তিনটে বাজে। শালবনির অনুষ্ঠানস্থল থেকে মেদিনীপুর যাওয়ার রাস্তায় লম্বা যানজট। যে কোনও বড়ো অনুষ্ঠান কিংবা রাজনৈতিক কর্মসূচি শেষ হওয়া মাত্র রাস্তায় একটু যানজট হয়ই। ভিআইপি মুভমেন্টের জন্য। সেদিন প্রথমে ভেবেছিলামও তাই। কিছুক্ষণ আগেই এই রাস্তা দিয়ে গিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রামবিলাস পাসোয়ান, শিল্পপতি সজ্জন জিন্দল সহ একগাদা ভিআইপি। যানজট খুব স্বাভাবিক। তখন জানতাম না, যানজটটা যেখানে হয়েছে সেই জায়গাটার নাম ভাদুতলা। তখন বিন্দুমাত্র ধারণা করাও সম্ভব ছিল না, ওই যানজটের কারণের পিছনেই লুকিয়ে রয়েছে রক্তাক্ত লালগড় আন্দোলন। তখন এটাও আঁচ করাও অসম্ভব ছিল, এর পরের আড়াই বছরের মাওবাদী আন্দোলন এবং তিন বছর বাদে কিষেণজির মৃত্যু রহস্য সন্ধান করতে বসব প্রায় দশ বছর বাদে। যেহেতু আমার সাংবাদিক জীবনের অন্যান্য অ্যাসাইনমেন্টের মতো এই লালগড়ের বিভিন্ন অভিজ্ঞতারও কোনও নোট করা নেই, তাই দশ বছর বাদে লিখতে বসে বুঝেছি, অনেক ক্ষেত্রেই নাম, তারিখ ভুলে গিয়েছি, ঘটনা নয়।
প্রায় দশ মিনিট গাড়িতে বসে থাকার পর প্রবীর গাড়ি থেকে নেমে হেঁটে এগোল যানজটের কারণটা দেখতে। একটু বাদে আমিও গাড়ি থেকে নেমে রাস্তায় দাঁড়ালাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রবীর ফিরে এল, আস্তে-আস্তে এগোচ্ছে গাড়ি। কিছু একটা হয়েছে, ঠিক কী বোঝা যাচ্ছে না।
সেদিন সাংবাদিক হিসেবে একটা বড়ো ভুল করেছিলাম। মিনিট পনেরো-কুড়ি বাদে যানজটটা যখন আস্তে আস্তে পেরোচ্ছি, দেখলাম রাস্তার পাশে বাঁদিকে একটা পুলিশের জিপ উল্টে পড়ে রয়েছে। গাড়িটার পাশে চার-পাঁচজন সাধারণ পুলিশ কর্মী দাঁড়িয়ে। ভাবলাম ছোটখাটো অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। না থেমে রওনা দিলাম কলকাতার দিকে। রওনা তো দিলাম, কিন্তু কিছুক্ষণ বাদে মনটা খচখচ করতে শুরু করল। এত ভিআইপি মুভমেন্ট হয়েছে যে রাস্তায়, সেখানে একটা পুলিশের গাড়ি উল্টে পড়ে রয়েছে কেন?
সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে বম্বে রোডে পৌঁছে গিয়েছি। অফিস থেকে ফোন।
‘বুদ্ধদেববাবুর কনভয়ে ব্লাস্ট হয়েছে? একটা চ্যানেল দেখাচ্ছে।’ অফিস থেকে আসা এই এক লাইনের বার্তাই তখন যথেষ্ট ছিল।
ড্রাইভারকে গাড়ি ঘোরাতে বলে সঙ্গে সঙ্গে ফোন করলাম মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে থাকা তাঁর আপ্ত সহায়ক জয়দীপ মুখার্জিকে।
‘বুদ্ধদেববাবুর কনভয়ে ব্লাস্ট হয়েছে?’
‘কিছু একটা হয়েছে। তবে ব্লাস্ট না। এসপি বলছে, ইলেকট্রিক ওভারহেড তার ছিঁড়ে একটা পুলিশের গাড়ির ওপর পড়েছে। তাতে একটু আগুন ধরে যায়। টাল সামলাতে না পেরে গাড়িটা উল্টে গিয়েছে। তাতে তিন-চারজন পুলিশ ইনজিওরড। তবে সিএমের কনভয়ে না, এটা ঘটেছে রামবিলাস পাসোয়ানের কনভয়ে।’
অফিস জানত না, চোখের সামনে পুলিশের গাড়ি উল্টে পড়ে থাকতে দেখেও তাতে গুরুত্ব না দিয়ে বেরিয়ে চলে এসেছি। মনে মনে ভাবছি, ভিআইপি কনভয়ে মাওবাদীদের ব্লাস্টের খবরটা যেন ঠিক না হয়। কিছুটা আশ্বস্ত হলাম বুদ্ধদেববাবুর আপ্ত সহায়কের কথায়। জেলার পুলিশ সুপার যখন বলেছেন, ব্লাস্ট নয়, ঠিকই হবে। তবু মনটা খচখচ করছে। রওনা দিলাম শালবনির দিকে। অন্তত ২০-২৫ মিনিট লাগবে। ফোন করলাম জেলার এক পরিচিত পুলিশ অফিসারকে। ফোন এনগেজড।
দু’মিনিটের মধ্যে ফোন করল জয়দীপদা। ‘মনে হচ্ছে ব্লাস্ট একটা হয়েছে। ডিটেল কিছু পাওয়া যায়নি।‘
গাড়ি জোরে ছুটছে শালবনির দিকে। ফোনে পেয়ে গেলাম সেই পুলিশ অফিসারকে। ‘না না, ইলেকট্রিক তারের কোনও ব্যাপারই নেই। মাওবাদীরা ব্লাস্ট করেছে। ব্লাস্টে ইলেকট্রিক তার ছিঁড়ে পড়ে গেছে।’ ঘটনাস্থলে থাকা অফিসারের কথায় টেনশনে পড়ে গেলাম। চোখের সামনে দেখেও মিস করলাম খবরটা! যে কোনও প্রাপ্তবয়স্ক সাংবাদিকের কাছে ক্ষমাহীণ অপরাধ। পাশের সিটে বসা প্রবীরকে বললাম, ‘এত বড়ো ভুল জীবনে হয়নি।’ প্রতিটা ভুলই পরবর্তী সময়ে তার পুনরাবৃত্তি না করার শিক্ষা দেয়। কিন্তু সেই শিক্ষা নেওয়ার সুযোগ পরবর্তী সময়ে আর পাইনি কখনও। কারণ, এমন ঘটনার মুখোমুখি হইনি পরে আর। তাছাড়া লালগড় আন্দোলনেরও তো পুনরাবৃত্তি হয়নি এরাজ্যে। সেদিন ২রা নভেম্বর ২০০৮, শালবনিতে মাওবাদী বিস্ফোরণই তৈরি করল লালগড় আন্দোলনের প্রেক্ষাপট।
কিন্তু সেদিন কীভাবে প্রথমে উঠে এসেছিল বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে পড়ে পুলিশের গাড়ি উল্টে যাওয়ার তত্ব? ঠিক কী ঘটেছিল সেদিন তা লিখব হুবহু এক অফিসারের মুখে, যা তিনি আমাকে পরে বলেছিলেন। তিনি সেদিন ছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কনভয়ে।
‘সেদিন অনুষ্ঠান শেষ হয়ে যাওয়ার পর প্রথমে বেরিয়ে যাওয়ার কথা ছিল রামবিলাস পাসোয়ানের। তারপর বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের। এমনই প্ল্যানিং করা ছিল জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে। সম্ভবত মাওয়িস্টদের কাছেও এই খবর ছিল। কিন্তু সেদিন অনুষ্ঠান শেষের পর বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর আগে বেরিয়ে যান। মঞ্চের পিছনেই চা খাওয়ার বন্দোবস্ত ছিল। অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর সমস্ত ভিআইপি যান সেখানে। সেখানে সজ্জন জিন্দল অতিথিদের কিছু খেয়ে যেতে বলেন। কিন্তু চিফ মিনিস্টার অনুষ্ঠান শেষেই বেরিয়ে যান মেদিনীপুর সার্কিট হাউসের উদ্দেশে। রামবিলাস পাসোয়ান কিছুক্ষণ বসে যান। তিনি বেরোন মিনিট দশেক বাদে।
মাওয়িস্টরা ব্লাস্টটা করাতে চেয়েছিল বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কনভয়ে। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীই ছিলেন টার্গেট। ওরা হয়তো দূর থেকে নজরও রাখছিল রাস্তার কনভয়ের দিকে। কিন্তু কোন কনভয়ে কে রয়েছেন সেটা দূর থেকে বোঝা সম্ভব ছিল না। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কনভয়কে ওরা রামবিলাস পাসোয়ানের ভেবে ভুল করে। চিফ মিনিস্টার বেরনোর কিছুক্ষণ পর রামবিলাস পাসোয়ান বেরোন শালবনি থেকে। আর তাঁর কনভয়েই ডিরেকশনাল ল্যান্ডমাইন ব্লাস্ট করায় মাওয়িস্টরা।
ঠিক যে মুহূর্তে ব্লাস্ট হয় তখন চিফ মিনিস্টারের গাড়ি মেদিনীপুর সার্কিট হাউসে ঢুকছে। চোখের সামনে ব্লাস্ট দেখে গাড়ি থেকেই চিফ মিনিস্টারকে ফোন করেন রামবিলাস পাসোয়ান। চিফ মিনিস্টার সার্কিট হাউসে গাড়ি থেকে নেমে সঙ্গে সঙ্গে ঘটনাটা বলেন তাঁর নিরাপত্তা উপদেষ্টা অরবিন্দ কুমার মালিওয়ালকে। চিফ মিনিস্টারের ঠিক আগেই ছিল জেলার পুলিশ সুপার রাজেশকুমার সিংহের গাড়ি। হাতের সামনে পেয়ে অরবিন্দ মালিওয়াল ব্লাস্টের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেন এসপিকে। সার্কিট হাউসের ভেতরে না ঢুকে চিফ মিনিস্টার তখন দাঁড়িয়ে আছেন গাড়ির সামনে। তাঁর কয়েক ফুট দূরে দাঁড়িয়ে আছি আমি। এসপি দেখলাম, কাউকে একটা ব্যস্ত হয়ে ফোন করছেন। ঠিক সেই সময় সার্কিট হাউসে এসে পৌঁছোলেন মেদিনীপুর রেঞ্জের ডিআইজি প্রভীণ কুমার। ডিআইজির গাড়ি ছিল চিফ মিনিস্টারের কনভয়ের একদম শেষে। এসপিকে কারও সঙ্গে কথা বলতে ব্যস্ত দেখে মালিওয়াল বিষয়টা দেখতে বলেন ডিআইজিকে। ডিআইজিও ফোন করেন কাউকে। অস্থিরভাবে এদিক-ওদিক দেখছেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। মালিওয়ালেরও এক অবস্থা। দু’জনেই তাকিয়ে রয়েছেন এসপি এবং ডিআইজির দিকে। আর দু’জন অফিসারই ফোনে কথা বলছেন।
মিনিট খানেক বাদে এসপি ফোন ছেড়ে বললেন, ‘‘কিছু হয়নি তেমন। ইলেকট্রিকের তার ছিঁড়ে পড়েছে কনভয়ে পুলিশের গাড়ির ওপর। তাতেই টাল সামলাতে না পেরে পুলিশের গাড়ি রাস্তার ধারে পড়ে গিয়েছে।’’ এসপির কথায় আশ্বস্ত হন চিফ মিনিস্টার। কিন্তু প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ফোন ছেড়ে প্রভীণ কুমার জানালেন, ‘‘স্যার, ব্লাস্ট হয়েছে। ব্লাস্টে ইলেকট্রিক তার ছিঁড়ে মাটিতে পড়েছে। জোরে আওয়াজ হয়েছে, বড় ব্লাস্ট ছাড়া তা হতে পারে না।’’
২রা নভেম্বর, ২০০৮। এই ঘটনার ঠিক পরেই শুরু হয়ে গেল লালগড় আন্দোলন। ঠিকঠাক ধরলে আন্দোলনটা শুরু হল ৮-৯ তারিখ থেকে। ২ তারিখের ঘটনার বিহ্বলতা কাটতে জেলা এবং রাজ্য পুলিশের লেগে গেল কম-বেশি চব্বিশ ঘন্টা। ৪-৫ নভেম্বর থেকে শালবনি, লালগড়ে শুরু হল পুলিশের জোরদার তল্লাশি অভিযান। মুখ্যমন্ত্রী, কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর কনভয়ে ব্লাস্টের মতো বড়ো ঘটনা ঘটেছে, পুলিশের ওপর চাপও ছিল যথেষ্ট। লালগড়ের কাঁটাপাহাড়ি, বড়পেলিয়া এলাকা থেকে কয়েকজন গ্রামবাসীকে গ্রেফতার করল পুলিশ। আর এই গ্রেফতার করতে গিয়ে মহিলা, বাচ্চাদের ওপর হল লাঠিচার্জ, মারধোর। নিরীহ মানুষের ওপর পুলিশি অত্যাচারের অভিযোগকে সামনে রেখেই লালগড় এবং তাকে কেন্দ্র করে এক বিস্তীর্ণ জায়গায় মাওবাদীদের নেতৃত্বে গ্রামবাসীরা শুরু করল সরকার বিরোধী বেপরোয়া আন্দোলন। যার পরতে পরতে রয়েছে হিংসা-প্রতিহিংসা, খুনোখুনি, রাজনৈতিক লড়াই। যে আন্দোলন চলল কার্যত ২০১১ সালের ১৩ মে পর্যন্ত। আর রাজনৈতিক মেরুকরণের পীঠস্থান এপার বাংলার একটা বাচ্চাও জানে, ওইদিন ১৩ মে ২০১১, নিরবচ্ছিন্ন ৩৪ বছরের সিপিআইএম পরিচালিত সরকারের ডেথ সার্টিফিকেটে গণসাক্ষর করলেন রাজ্যের মানুষ। তার সাতদিন বাদে ২০ মে সরকার গঠন করলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

১১ নভেম্বর, ২০০৮  

আগের দিন সন্ধ্যায় খেজুরি থেকে বেরিয়ে ঝাড়গ্রাম শহরে ঢুকতে ঢুকতে হয়ে গিয়েছিল রাত প্রায় বারোটা। মধ্যরাতে ঝাড়গ্রামের অরণ্য সুন্দরী হোটেলে গিয়ে উঠলাম। ২০০৬ সালের গোড়াতেও এই হোটেলে ছিলাম বেশ কয়েকদিন। ঝাড়গ্রাম জেল লাগোয়া অরণ্য সুন্দরী হোটেল থেকে বাস স্ট্যান্ড এবং স্টেশন ঠিক পাঁচ মিনিটের হাঁটা রাস্তা।
১১ তারিখ একদম সকাল সকাল স্টার আনন্দের ঝাড়গ্রামের সাংবাদিক অমিতাভ রথকে ডাকলাম হোটেলে। আগের দিনই বলে রেখেছিলাম, লালগড় যাব। সকাল আটটা নাগাদ মোটরসাইকেল চালিয়ে অমিতাভ এল এক জবরদস্ত দুঃসংবাদ নিয়ে। ‘দাদা, গতকাল বিকেল থেকে লালগড়ে ঢোকার বিভিন্ন রাস্তা কেটে দিয়েছে গ্রামবাসীরা। পুলিশকে ঢুকতে দেবে না বলে গাছ ফেলে সব রাস্তা অবরোধ করেছে। গাড়ি করে তো লালগড় যাওয়া যাবে না।’
‘যত দূর গাড়ি করে যাওয়া যায় যাব, বাকিটা যাব মোটরসাইকেলে। তোমার মোটরসাইকেলে তেল আছে?’
নন্দীগ্রামের অভিজ্ঞতা ততদিনে শিখিয়েছে, যে কোনও আন্দোলনের উৎপত্তিস্থলে যাওয়ার সেরা বাহন মোটরসাইকেল। কাটা রাস্তা দিয়ে যাওয়া তো সহজ বটেই, আচমকা বিপদে-টিপদে পড়লে পালানোও সহজ।
‘না তেল নিতে হবে।’
রওনা দিলাম ঝাড়গ্রাম শহর থেকে। রেল লাইন পেরিয়ে এগোচ্ছি। মোটরসাইকেল চালাচ্ছে অমিতাভ রথ, লালগড় আন্দোলনে প্রবেশে আমার প্রথম গাইড। পেছনে গাড়িতে বসে উজ্জ্বল আর আমি। পেট্রল পাম্প থেকে মোটরসাইকেলে তেল ভরা হল। মিনিট পনেরোর মধ্যে পৌঁছে গেলাম দহিজুড়ি মোড়ে। রাস্তায় ভর্তি লোক।
দহিজুড়ি মোড় থেকে ডানদিকে কোণাকুণি একটা রাস্তা চলে গিয়েছে। সেই রাস্তা ধরলাম আমরা। থামল অমিতাভ, আমরাও গাড়ি থামালাম। নামলাম গাড়ি থেকে। গাড়ি থাকবে দহিজুড়িতে। আমি আর উজ্জ্বল উঠে বসলাম অমিতাভর মোটরসাইকেলের পিছনে। অমিতাভরই পরামর্শে। কখন কোথায় রাস্তা কাটা ঠিক নেই। গাড়ি রেখে মোটরসাইকেলে যাওয়াই ভাল। তাছাড়া গ্রামে কিংবা মফস্বলে মোটরসাইকেলে তিনজন স্বভাবিক দৃশ্য। মোটরসাইকেলে চেপে যাচ্ছি আর ভাবছি লালগড়ে পৌঁছে কী স্টোরি করব তা নিয়ে। মাঝে মাঝে অমিতাভকে জিজ্ঞেস করছি লালগড় নিয়ে। কিন্তু এত হাওয়া, প্রায় কোনও কথাই শোনা যায় না। আধ ঘন্টাখানেক পর মোটরসাইকেল থামাল অমিতাভ। ‘দাদা, নদী পেরোতে হবে।’ নদীর ওপারে লালগড়।
দু’দিকে চওড়া বালির চরা। মাঝখানে ফুট পঞ্চাশেক চওড়া কাঁসাই নদী। কিছুটা বেশি কিংবা সামান্য কমও হতে পারে। ভূগোল বইয়ে এই নদীর নাম কংসাবতী। লোকাল নাম কাঁসাই। এমনিতেই রুক্ষ জায়গা ঝাড়গ্রাম। তার মধ্যে বর্ষা গিয়েছে সবে মাস দুয়েক আগে। তাই কাঁসাইয়ে তবু জল আছে কিছু। ফেব্রুয়ারি, মার্চ মাসে তো গিয়ে দেখেছি লোকে ওই জায়গা দিয়ে সাইকেল চালিয়ে কাঁসাই পেরোয়। এখন নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ, জলের গভীরতা এক থেকে দেড়-দু’ফুটের মধ্যে। কিন্তু পরিষ্কার ঝকঝকে জল। হাঁটু পর্যন্ত প্যান্ট গুটিয়ে নিলাম তিনজনেই। জুতো খুলে বেঁধে নিলাম মোটরসাইকেলের কেরিয়ারে। তারপর খালি পায়ে কাঁসাই নদী পেরিয়ে গেলাম আমরা। উজ্জ্বলের হাতে ক্যামেরা, মাইক। আমি আর অমিতাভ ঠেলে নিয়ে গেলাম মোটরসাইকেল। দু’জন মিলে মোটরসাইকেল ঠেলে নদী পেরোতে তেমন কষ্ট হয়নি, কিন্তু কত ধানে কত চাল বোঝা গেল চরার বালি পেরনোর সময়। রাস্তায় গিয়ে উঠে টানা পাঁচ মিনিট রেস্ট। আবার উঠে বসলাম মোটরসাইকেলে। মিনিট চল্লিশেক পর লালগড় থানা। প্রায় সাড়ে দশটা বাজে।

লালগড় থানা, সিদু সোরেন এবং দাবি সনদ  

২০০৯ সালের প্রায় গোড়া থেকেই পুলিশের হিট লিস্টে উঠে এসেছিল সিদু সোরেনের নাম। আমি সিদুকে প্রথম দেখি ২০০৮ সালের ১১ নভেম্বর। যেদিন প্রথম লালগড় থানার সামনে পৌঁছেছিলাম সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ। লম্বা, পেটানো চেহারা। থানার সামনে রাস্তায় বসে সাদা কাগজে লাল আলতা দিয়ে দাবি সনদ লিখছে এক যুবক। পাশে সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি পরা মাঝবয়সী এক ব্যক্তি সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। পরে জেনেছিলাম, তাঁর নাম লালমোহন টুডু। লালমোহন টুডু বলছেন কী লিখতে হবে, গোটা গোটা অক্ষরে লিখছে সিদু। ছেলেটাকে কোনওদিন আপনি বলিনি, এত কম বয়েস। তাই লেখাতেও আর আপনি সম্বোধন করছি না। সেদিন দেখেছিলাম ঝকঝকে দুটো চোখ। এমন চিবুক, কাঁধ এবং চোখ সচরাচর এই এলাকার ছেলেদের হয় না। সিদুর চোখ এবং চেহারার গড়ন বলে দিচ্ছে, এই ছেলেটাই লিডার। কয়েক মাসের মধ্যেই চেহারা আরও পালটে গেল ছেলেটার। আরও শক্ত হল চোয়াল। হিংস্রতা এল চোখে-মুখে। ২০০৯ সালের লোকসভা ভোটের ঠিক আগে শেষ দেখা হয়েছিল সিদুর সঙ্গে। তখন ওরই নিরাপত্তায় বেশ কিছু যুবক। সিদুরও বয়েস ওই সাত মাসেই বেড়ে গিয়েছে কয়েক বছর। হাতের বন্দুক ওই কয়েক মাসেই তাকে দিয়েছে বেপরোয়া কাঠিন্য এবং আত্মবিশ্বাস। তাকে দশ-বিশ বছর ধরে চেনা তার গ্রামের লোকও চমকে উঠেছে সিদুর হঠাৎ তৈরি হওয়া ব্যক্তিত্ব দেখে। বন্দুক একজনের চেহারায় তিন মাসে এতটা বদলও আনতে পারে!
১১ নভেম্বর ২০০৮, আমরা যে কয়েকজন সাংবাদিক লালগড় থানার সামনে হাজির হয়েছিলাম, তাদের সবার মোবাইল ফোন নম্বর লিখে নিচ্ছিল সিদু নিজে। তখন দুপুর বারোটার এদিক-ওদিক। প্রায় দু’ঘন্টার চেষ্টায় ঝাড়গ্রাম শহর থেকে লালগড় পৌঁছেছি। সাদা একটা বড় কাগজে ১০-১১ দফা দাবি লিখে রাস্তা থেকে উঠে দাঁড়াল সিদু সোরেন। তারপর তা পড়ে দেখলেন লালমোহন টুডু এবং আরও কয়েকজন। জমায়েতটা সব মিলিয়ে ৫০-৭০ জনের। এরপর সেই দাবি সনদ নিয়ে সিদু এবং আরও তিন-চারজন ঢুকে গেল লালগড় থানায়। দাবি সনদ থানায় জমা দিয়ে বেরিয়ে এল মিনিট পাঁচেকের মধ্যে। জানাল, মূল দাবি দুটো। জেলার পুলিশ সুপারকে গ্রামবাসীদের কাছে ক্ষমা চাইতে হবে দলিলপুর চকে গিয়ে এবং লালগড় থানার ওসিকে উঠবোস করতে হবে কান ধরে। নয়তো লালগড়ে ঢুকতে দেওয়া হবে না পুলিশ-প্রশাসনকে। এরপরই আমার এবং অন্য সাংবাদিকদের ফোন নম্বর নিয়ে সিদু বলল, ‘দাদা কিছু ঘটলে জানাব।’ আমিও ওর নম্বর লিখে নিলাম। তারপর বহুবার ফোনে কথা হয়েছে সিদুর সঙ্গে। ওই বেশি ফোন করত। পুলিশ এবং সিপিআইএমের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ জানাত। দু’তিন মাস পরেই আস্তে আস্তে বুঝতে পারছিলাম সিদুর ঘোরাফেরা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। ও আর একা যেখানে সেখানে যাচ্ছে না। সঙ্গে কিছু ছেলে থাকছে। হাঁটাচলায় সতর্কতা বেড়েছে। সঙ্গে যোগ হয়েছে সন্দেহপ্রবণ চাহনি। ১১ নভেম্বর ২০০৮, লালগড় থানায় ঢুকে ডেপুটেশন জমা দেওয়া সিদু সোরেন কয়েক মাসের মধ্যেই হয়ে উঠল মোস্ট ওয়ান্টেড মাওবাদী নেতা। একটা আস্ত ১৫-২০ জনের দল তখন সিদুর নেতৃত্বে লালগড়, গোয়ালতোড়, সারেঙ্গার জঙ্গল দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। যে দাবি সনদ লালগড় থানায় জমা দিয়ে এল সিদু সোরেন এবং তার সহযোগীরা, তা মানার কোনও প্রশ্নই ওঠে না বলে সেদিনই বিকেলের মধ্যে স্পষ্ট করে দিল রাজ্য সরকারও। জেলার পুলিশ সুপার এবং থানার ওসি প্রকাশ্যে গিয়ে ক্ষমা চাইবেন এবং কান ধরে উঠবোস করবেন, এই দাবির পেছনে রয়েছে মাওবাদীরা, তাও জানাল সরকার।
এদিকে লালগড় থানায় লালমোহ টুডু, সিদু সোরেনদের দাবিপত্র পেশের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তৈরি হল পুলিশ সন্ত্রাস বিরোধী জনসাধারণের কমিটি, যা কয়েক দিনের মধ্যেই পিসিপিএ নামে পরিচিত হয়ে গেল গোটা দেশে। নিজেদের দাবি সনদ নিয়ে তারাও নাছোড়। মুখমন্ত্রীর কনভয়ে বিস্ফোরণের পর পুলিশ লালগড়ের কাঁটাপাহাড়িতে গিয়ে মহিলাদের ওপর যে অত্যাচার করেছে তার জন্য ক্ষমা চাইতে হবে। কান ধরে উঠবোস করতে হবে। নয়তো লালগড়ে পুলিশ ঢুকতে দেওয়া হবে না। আর কোনও এলাকায় পুলিশকে ঢুকতে না দেওয়ার ‘নন্দীগ্রাম মডেল’ ততদিনে আমাদের জানা হয়ে গেছে। রাতারাতি লালগড় থানা থেকে কাঁটাপাহাড়ি যাওয়ার রাস্তায় বড় বড় খেজুর গাছ কেটে ফেলে দিল আন্দোলনকারীরা। লালগড়ের একটা বড় অংশকে প্রায় লিবারেটেড জোন তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেল সেদিনই।
তারপর থেকে পরপর প্রায় দু’সপ্তাহ রোজ গেলাম লালগড়ে। দু’একদিনের মধ্যে রীতিমতো স্পষ্টও হয়ে গেল, ‘জনসাধারণের কমিটি’ নামেই। আসলে পুরোদস্তুর মাওবাদীরাই জনসাধারণকে সামনে রেখে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করল। অধিকাংশ মানুষই পুরনো সিপিআইএম বিরোধিতার জায়গা থেকে এই আন্দোলনের পাশে এসে দাঁড়ালেন। সিপিআইএম কিছু নেতা ঘরছাড়া হলেন। আর সিপিআইএমের সাধারণ কর্মী, সমর্থকরা ভয়ে-ভীতিতে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে হাঁটতে বাধ্য হলেন।
১২ কিংবা ১৩ নভেম্বর হবে, সকাল সকাল অমিতাভর মোটরসাইকেলে চেপে আমি আর উজ্জ্বল ঝাড়গ্রাম থেকে লালগড়ের উদ্দেশে রওনা দিলাম। সেদিন কাঁটাপাহাড়িতে পিসিপিএ’র বড় মিটিং হওয়ার কথা। অন্যদিনের মতো হেঁটে কাঁসাই নদী পেরিয়ে রাস্তায় ফেলে রাখা খেজুর গাছ ঠেলতে ঠেলতে প্রায় দু’ঘন্টার চেষ্টায় তিনজনে গিয়ে পৌঁছালাম কাঁটাপাহাড়ি স্কুলের সামনে। সকাল সাড়ে দশটা মতো বাজে। গিয়ে দেখি আগেই দু’চারজন সাংবাদিক পৌঁছেছে। আমাদের পরেও এল বেশ কয়েকজন। সিদু সোরেন এবং পিসিপিএ’র নেতা গোছের কয়েকজনকে ঘিরে আমরা কথা বলছি। মিটিং শুরু হওয়ার কথা দুপুর বারোটায়। আস্তে আস্তে কাঁটাপাহাড়ি স্কুলের সামনে ভিড় বাড়ছে। স্কুলের উল্টো দিকেই বড় মাঠ। মাঠ শেষ হলে শুরু হচ্ছে জঙ্গল। বারোটা-সাড়ে বারোটার পর থেকে দেখি, ওই মাঠে অল্প অল্প করে লোক আসতে শুরু করেছে আশপাশের গ্রাম থেকে। প্রতি দশজনে অন্তত ছ’জন মহিলা। আধ ঘন্টা-চল্লিশ মিনিটের মধ্যে মাঠে পাঁচ-সাতশো মানুষ জড়ো হয়ে গেলেন। কিন্তু আমরা, মানে কলকাতা এবং ঝাড়গ্রাম মিলে প্রায় ৩০-৩৫ জন সাংবাদিক তখনও বুঝতে পারছি না, মিটিংটা করবেন কে? সত্যিই শুধু সাধারণ গ্রামবাসীদের মিটিং, নাকি মাওবাদী নেতৃত্বও যোগ দেবে তাতে? লোক তো জমায়েত হয়েছে খারাপ না। কিন্তু তখন আমাদের একটাই কৌতুহল, মিটিংয়ে বক্তৃতা কে করেন। সেটাই দেখার জন্য মাঠের পাশে আমরা সব জটলা করে দাঁড়িয়ে রয়েছি। রাস্তার পাশে লাইন দিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখা আমাদের বাহন মোটরসাইকেল। কিছুক্ষণ বাদে আমাদের দিকে এগিয়ে এল সিদু। সঙ্গে দু’তিনজন।
‘আপনারা এবার এখান থেকে একটু চলে যান। এবার আমাদের মিটিং শুরু হবে।’ বেশ ভদ্রভাবেই আমাদের বলল সিদু সোরেন।
‘কিন্তু আপনাদের মিটিং কভার করতেই তো আমরা এত দূর থেকে এসেছি।’
‘না, মিটিংয়ের সময় আপনারা থাকতে পারবেন না। এক-দেড় কিলোমিটার দূরে গিয়ে অপেক্ষা করুন। মিটিং শেষ হলে আমরা জানিয়ে দেব কী সিদ্ধান্ত হল।’
‘কিন্তু আমাদের তো মিটিংয়ের ছবি তুলতে হবে। এত লোক জমায়েত হয়েছে!’

কী হয়েছে আগের পর্বে? পড়ুন: কিষেণজি মৃত্যু রহস্য #১৩

সিদুকে বোঝানোর চেষ্টা করল কয়েকজন সাংবাদিক। কিন্তু ততক্ষণে বেশ বুঝতে পারছি, যা দেখার এবং জানার জন্য এত রাস্তা কষ্ট করে মোটরসাইকেলে চেপে এসে এতক্ষণ অপেক্ষা করছি, তা ওরা আমাদের দেখতে দেবে না। আজকের মিটিংটা যে পুলিশ সন্ত্রাস বিরোধী জনসাধারণের কমিটির ডাকে নিছক গ্রামবাসীদের একটা সাধারণ জমায়েত নয়, তার একটা বারো আনা ধারণা ছিলই। কিন্তু সিদুর এই ভদ্রভাবে পেশ করা কঠিন স্বরে বাকি চার আনাও স্পষ্ট হল। তার মানে, মাওবাদীরা সত্যিই যোগ দেবে মিটিংয়ে! সিদু সোরেন স্রেফ নির্দেশ পালন করছে। অভিজ্ঞতায় দেখেছি, এই সব ক্ষেত্রে হাজার অনুরোধ করা মানে সময় এবং এনার্জি নষ্ট। লাভ কিছু হয় না। সাংবাদিকদের বহু অনুরোধেও সিদু সোরেন এবং তার সঙ্গীরা নিজের অবস্থান থেকে সরল না। শেষমেশ রফা হল, আমরা সবাই কাঁটাপাহাড়ির ওই মাঠের সামনে থেকে এক-দেড় কিলোমিটার দূরে সরে যাব। মিটিং শেষ হলে ওরা আমাদের ফোন করে ডেকে নেবে। তখন আমরা ছবি তুলে নেব। আর সঙ্গে জেনে নেব ওদের বক্তব্য। কাঁটাপাহাড়ি স্কুল থেকে পিচ রাস্তা একদিকে যাচ্ছে লালগড় থানার দিকে। অন্যদিকে যাচ্ছে রামগড়ের দিকে। আমি, হিন্দুস্থান টাইমসের সুরবেক বিশ্বাস আর দ্য টেলিগ্রাফের প্রণব মন্ডল চলে গেলাম কয়েক কিলোমিটার দূরের রামগড়ে। থাকতেই যখন দেবে না, এক কিলোমিটারও যা, কয়েক কিলোমিটার দূরের রামগড়ও তা। যাব-আসব তো মোটরসাইকেলে।

 

চলবে

(৩ জুলাই থেকে শুরু হয়েছে কিষেণজি মৃত্যু রহস্য। প্রতি মঙ্গলবার এবং শুক্রবার প্রকাশিত হচ্ছে এই দীর্ঘ ধারাবাহিক। প্রতি পর্বে লাল রং দিয়ে আগের পর্বের লিঙ্ক দেওয়া থাকছে। সেখানে ক্লিক করলে আগের পর্ব পড়তে পারবেন।)

Comments are closed.