আগামীর সফল মে দিবসের প্রত্যাশায়

পেরিয়ে গেলো আরেকটি মে দিবস- আন্তর্জাতিক শ্রমিক আন্দোলনের দিন। ১৮৮৬ সালে আমেরিকার শিকাগো শহরে শ্রমের ন্যায্য মজুরি ও আট ঘন্টা শ্রম ঘন্টার দাবিতে রাজপথে বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছিলো শ্রমিক। সেই থেকে শ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা। ১৮৮৯ সাল থেকে পালিত হচ্ছে মে দিবস।
শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই প্রায় ১২৯ বছরের। কিন্তু এ প্রচেষ্টা কি আজও সফল হয়েছে? শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠার যে দাবানল সংগ্রাম, আজও সে সংগ্রামের পথে অসংখ্য অপ্রাপ্তি আর অধিকারহীনতা। আজও মজুরির জন্য নির্দিষ্ট কোনো কার্যকর আইন প্রণয়ন করা যায়নি। যে মজুরি নির্ধারিত হয়েছে- শ্রমিকের বাস্তব জীবনের দিকে তাকালে আমরা বুঝি, তা কত অযৌক্তিক, অমানবিক এবং অপ্রতুল। কেননা বাজারের মূল্য বাড়ে, সারা দুনিয়াতে অর্থের তারতম্য হয় কিন্তু এসব বিষয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে মজুরি বাড়ানো হয় না। ন্যায্য মজুরির আন্দোলন তাই এখনও বেগবান। এখনও পৃথিবীতে শ্রমের ন্যায্য মূল্যের দাবিতে আন্দোলন হচ্ছে। এখনও শ্রমিকের বাস্তবতা ন্যায্য অধিকারের অনেক দূরে।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, শ্রমিকের অধিকার কি কেবলই মজুরিতে সীমাবদ্ধ? ঘরে, বাইরে, যানবাহনে, কর্মস্থলে পৃথিবীর নানা দেশে শ্রমিকরা কীভাবে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন তা গণমাধ্যমে বা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গবেষণাপত্র মারফৎ জানতে পারি। যে নারী শ্রমিক ভোরের আলো ফোটার আগে ঘরের কাজ সেরে সংসারের স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য কাজে বের হন, সারাদিনের কর্মক্লান্তি নিয়ে বাড়ি ফিরে আবার সংসারের উনকোটি কাজ আর স্বামী নামক পাষণ্ডের শারীরিক ও মানসিক নিগ্রহের শিকার হন- তিনি জানেন, কতটা অধরা এখনও মে দিবসের চেতনা ও শিক্ষা।
কাজে যাবার কিংবা ফেরার পথে মত্ত কোন চালকের স্বেচ্ছাচারে চাকায় পিষ্ট হয়ে স্বজনদের কান্নায় ভাসিয়ে ঘরে ফেরা কিংবা কর্মক্ষেত্রে উর্ধ্বতনের স্বেচ্ছাচারের শিকার হওয়ার প্রতিকার কি শ্রমিকের অধিকারের অংশ নয়? শ্রমিকের সঙ্গে প্রতিনিয়ত এই যে অন্যায় ঘটে চলছে- কেবল শারীরিক নয়, মানসিকও- তার প্রতিবাদ করা, শ্রমের পরিবেশে সমতা বিধানের দাবি বাস্তবায়ন করতে পারার অধিকারও শ্রমিকের অধিকার। বলাই বাহুল্য, সময়ের সঙ্গে পরিবর্তিত হয়েছে সামাজিক ধারণা, বিকশিত হয়েছে মানবতাবাদের সংজ্ঞা এবং মানুষের অধিকারের ইশতেহার। তাই নিঃসন্দেহে আমেরিকার শিকাগো শহর থেকে শুরু হওয়া শ্রমিকের অধিকার আদায়ের সংগ্রামের পরিধি ও ভাষাও বদলেছে। ফলে ‘শ্রমিকের অধিকার’ কেবল কতগুলো মুখস্থ বুলির ওপর নির্ভর করে না। সময়ের সঙ্গে, সমাজের বিকাশের সঙ্গে, বিরাজমান আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির সঙ্গে শ্রমিকের অধিকারের প্রসঙ্গও অনেক নতুন রূপ ধারণ করেছে। এখন প্রশ্ন হলো, বর্তমানে গোটা বিশ্ব যেভাবে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে যন্ত্র-নির্ভর হয়ে যাচ্ছে, তাতে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি। কারণ, তখন মানুষকে তুলনা করা হচ্ছে একটি রোবট বা মেশিনের সঙ্গে এবং তুলনার মাপকাঠি নির্ধারিত হচ্ছে কাজের ‘আউটপুট’ দ্বারা। ফলে একজন মানুষকে যন্ত্রের মতো কাজ করতে হচ্ছে কিন্তু তার মজুরি নির্ধারণের সময় এলে সেখানে প্রধানত ক্রিয়াশীল থাকে মালিকের ইচ্ছা। এখনও অধিকাংশ ক্ষেত্রে কর্মঘন্টা কিংবা মজুরি নির্ধারিত হয় শ্রম আইনে নয় মালিকের ইচ্ছায়। নারী পুরুষের একই শ্রমের মজুরিতে রয়েছে বৈষম্য।
তাহলে প্রশ্ন হলো- এত বছরের এত আন্দোলন উদযাপন কী তার ফল? কেন এমন হলো? এ কার ব্যর্থতা? আজও কেন শ্রমিককে নিজের অধিকার সচেতন করা গেলো না! আত্মসমালোচনার সময় বয়ে যায়। আমরা যারা শ্রমিক রাজ কায়েম করার জন্য মেহনতি মানুষের জয়গান গেয়ে সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, গণ-মানুষের বোধগম্যতার বাইরের ভাষায় গান গাই, নাটক করি; তারা দিন গেলে ভাবি করছি তো শ্রমিক আন্দোলন। কিন্তু ভেবে দেখি না ঠাণ্ডা ঘরে বসে পিএইচডি থিসিসের ভাষার সেমিনারের আলোচনা কিংবা সাজানো মঞ্চের সাজানো বুলির নাটকের কোন কথাই শ্রমিকের হৃদয় কেন কানেই পৌঁছে না।
মে দিবসকে সফল করতে হলে শ্রমিক তথা খেটে খাওয়া মানুষকে নিজ অধিকার সচেতন করার বিকল্প নেই। তাই তার কাছে গিয়ে, বলবো কথা তাদের ভাষায়। তাদের থালায়, তাদের ফেনা ভাত খেয়ে ভরসা অর্জন করে বন্ধু হবো। আমাদের কথায় গানে গল্পে সচেতন হবে সে। নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের প্রয়োজন উপলব্ধি করবে নিজেরই তাগিদে। এবারের মে দিবস যদি আত্ম-সমালোচনার সঠিক পথ অনুসরণ করে, তাহলে আগামীর মে দিবস নিশ্চয়ই হবে সফল মে দিবস।

Leave A Reply

Your email address will not be published.