ছিলেন বহুজাতিক সংস্থার পি-আর ম্যানেজার, হলেন ‘চা ওয়ালা’ ; ‘চুমুকে চমক’ নিয়ে ‘TheBengalStory’-র সঙ্গে কথা বললেন প্রিয়ঙ্কা 

বাঘাযতীন মোড় থেকে গড়িয়ার দিকে ১০ মিনিট হেঁটে গেলেই গাঙ্গুলি বাগান মোড়। বড় রাস্তার ধারেই শহরের ব্যস্ততাকে এড়িয়ে যেন এক টুকরো আলস্যের ছবি। কালো পিচ রাস্তার উপরে কয়েকটি বেতের মোড়া পাতা। তাতে কেউ ধোঁয়া ওঠা চায়ের ভাঁড় হাতে একা বসে। কেউ কেউ আবার প্রিয় জনের সঙ্গে গল্পে মশগুল। দোকানের নাম ‘চুমুকে চমক’। হলুদ সাইন বোর্ড লাগানো দোকানটি চায়ের দোকান হলেও আদতে যেন ঠিক চায়ের দোকান নয়। এই ‘চমকের’ নেপথ্যে যিনি রয়েছেন তিনি নিজেও গতানুগতিক জীবনে যাপনে বিশ্বাসী নন। বহুজাতিক সংস্থায় পিআর ম্যানেজারের চাকরি করতেন। কিন্তু ১০-৭ টায় হাঁপিয়ে উঠলেন। শেষে মোটা মাইনের চাকরি ছেড়ে সিদ্ধান্ত নিলেন চা বিক্রির। 

কাকতালীয় ভাবে আমরা যেদিন দোকান পৌঁছলাম, সেদিনই ‘চুমুকে চমক’ এক বছরের পথ পেরিয়েছে। ক্রেতা সামলাতে সামলাতেই TheBengalStory -এর সঙ্গে কথা বললেন ‘চুমুকে চমকের’ কর্ত্রী প্রিয়াঙ্কা দাশগুপ্ত। 

হঠাৎ চা বিক্রি কেন? আরে জায়গাটা তো কলকাতা। তার উপর বহুদিন ফুড ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে থাকার সুবাদে লক্ষ্য করেছি এই ‘ক্যাফে কালচার’ খুব জনপ্রিয় হয়েছে। তবে আজকাল একটা ক্যাফেতে গিয়ে কফি বা চা খেতে যে খরচটা পড়বে সেটা আমাদের অনেকের ক্ষেত্রেই চাপের হয়ে যায়। যাতে বাজেটের মধ্যেই কেউ ‘ভালো সময়’ কাটাতে পারেন, এই ভাবনা থেকেই চুমুকে চমক। এক নিঃশ্বাসে বলে গেলেন প্রিয়ঙ্কা। 

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে মার্স্টার্স করেছেন প্রিয়াঙ্কা। তারপরে একটি বেসরকারি কলেজে থেকে এমবিএ করে চাকরি। বেশ কয়েকটি নামি বহুজাতিক সংস্থায় পিআর ম্যানেজারের দায়িত্ব সামলেছেন প্রিয়াঙ্কা। জানালেন, চাকরি করতে করতেই বিগত দু-তিন বছর ধরে নিজের জন্য কিছু করার পরিকল্পনা করছিলেন। করোনা এসে পড়ায়, সেই সুযোগ যেন এসে পড়ল। তারপরে একদিন ‘দুম’ করে চাকরি ছেড়েই ব্যবসা শুরু। মা-বাবাকে যখন নিজের ইচ্ছে জানালেন তাঁদের কী প্রতিক্রিয়া ছিল? এক গাল হেসে প্রিয়াঙ্কার উত্তর, জানিনা বিশ্বাস করবেন কিনা। তবু বলছি। ওঁদের প্রথমে কিছুই জানায় নি। সব কিছু গুছিয়ে নিয়েই একদিন বাবাকে দোকানের সামনে নিয়ে এসে হাজির করলাম। ভাবলাম সারপ্রাইজ পেয়ে খুশি হবেন। কিন্তু উল্টে তুমুল রাগারাগি করলেন। মা’ও তাই। আসলে এমবিএ করে মেয়ে চা বিক্রি করবে এটা যে কোনও মা বাবার ক্ষেত্রেই মেনে নেওয়াটা একটু কঠিন। আর এখন কী বলে? আমার সাফল্যে ওরা খুশি। কিন্তু এখনও তেমন ভাবে মেনে নিতে পারেননি। 

বর্তমানা দক্ষিণ কলকাতাতেই ‘চুমুকে চমক’র আরও একটি আউটলেট খোলার পরিকল্পনা রয়েছে প্রিয়াঙ্কার। জানালেন, সব ঠিক থাকলে জানুয়ারি মাসেই নতুন দোকান শুরু হয়ে যাবে। নিজের পরিকল্পনার কথা প্রথম জানিয়েছেন নিজের কাছের বন্ধুকে। এখন সেই বন্ধুও চাকরি ছেড়ে প্রিয়াঙ্কার সঙ্গে এই উদ্যোগে হাত মিলিয়েছেন। 

প্রিয়ঙ্কা জানালেন। তাঁর ইচ্ছে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে একটি ব্রান্ডে পরিণত হোক চুমুকে চমক। বর্তমানে প্রিয়ঙ্কার দোকানে তিন জন কর্মচারী কাজ করেন। বললেন, টার্গেট রয়েছে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে অত্যন্ত ৫০ টি পরিবারের রোজগারের ব্যবস্থা করতে চাই। 

চুমুকে চমক নামটিও তো বেশ চমকপ্রদ….হ্যাঁ এটা আমার বোন রঞ্জার দেওয়া। বর্তমানে ৪০ রকমের চা পাওয়া যায় চুমুকে চমকে। এছাড়াও ফিস ফিঙ্গার, ফিস ফ্রাইয়ের মতো ১২ রকমের পদ রয়েছে। ৪০ রকমের চা! চায়ের এত ভ্যারাইটির ভাবনা কীভাবে মাথায় এল? দেখুন হাজারের উপরে ক্যাফেতে আমি ঘুরেছি। আমি এবং আমার বন্ধু নর্থ বেঙ্গলের প্রায় প্রতিটি চায়ের দোকানে ঘুরেছি। সেই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়েই আপাতত এই ৪০ টি রেসিপি ঠিক করেছি। জানা গেল, চা এবং হাল্কা স্যন্যাক্স সহযোগে খোলা আকাশের নীচে একটি সন্ধ্যা কাটাতে খরচ পড়বে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা। 

চাকরি জীবনের সঙ্গে বর্তমান জীবনের কী তফাৎ দেখছেন? দেখুন, সত্যি বলতে চাকরি করার সময় তাও ছুটি বলে একটা বিষয় ছিল। এখন সপ্তাহে সাত দিনই ব্যস্ততা। একটি ছোট্ট শিশুকে বড় করার মতোই যত্ন নিয়ে সময় নিয়ে ব্যবসাটা দাঁড় করাচ্ছি। অবসর বলতে কিচ্ছু নেই। তবু স্বপ্ন সত্যি করার এই সফরটা বেশ উপভোগ করছি। তাই আর ক্লান্ত হই না। 

অনেকেই তো আপনার মতো প্রথা ভেঙে কিছু করার স্বপ্ন দেখেন।  তাঁদের কী বলবেন? তাঁদের বলব, শুধু আবেগ দিয়ে সিদ্ধান্ত নিলে হবে না, যে কাজটি করতে চাইছেন সেটা সম্পর্কে সব জানুন, শিখুন তারপর সিদ্ধান্ত নিন, মন্তব্য প্রিয়াঙ্কার।   

Comments are closed.