স্মৃতিতে বঙ্গবন্ধু

আমি সেই বহু সৌভাগ্যবানের একজন যে জাতির পিতাকে স্বচোখে দেখেছি। তাঁর আশীর্বাদ স্পর্শ আজও আমায় শিহরিত করে।
প্রথম কবে দেখেছি মনে নেই। মনে আছে যে দিনটার কথা সেদিন বিশাল গণভবন (বর্তমান রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন) প্রাঙ্গণে আমাদের জাতির পিতা স্বাধীন বাংলা বেতারের শিল্পীদের সাথে প্রাণের মিলনমেলায় মিলিত হয়েছিলেন। ছোট্ট আমিও সে আয়োজনে ছিলাম বাবা-মা আরও অনেক কাকু-খালাদের সাথে। বিশাল এই প্রাঙ্গণে আমি অতি সামান্য এক শিশু হলেও আমি সেই পর্বত প্রমাণ বাঙালির নজর এড়াইনি। আমাকে হাত ধরে তিনি হরিণ, ময়ূর দেখাতে নিয়ে যান বাগানের পাশের খাঁচাগুলোর কাছে। আমাকে কোলে নিয়ে বলেন, এই তো আমার ভবিষ্যতের বাংলাদেশ।

(ছবিতে বঙ্গুবন্ধুর সঙ্গে লেখক সঙ্গীতা ইমাম, একদম সামনের সারিতে। বঙ্গবন্ধুর হাত তাঁর বাবা সৈয়দ হাসান ইমামের কাঁধে)

আর একদিনের কথা মনে পড়ে খুব। এক ঈদের দিনে আব্বু, আমি, মুস্তাফা কাকু (প্রয়াত গোলাম মুস্তাফা),সুবর্ণা আপা শেরেবাংলা নগরে তাঁর রাষ্ট্রীয় বাসভবনে যাই দেখা করতে। তিনি ছিলেন না, টুঙ্গীপাড়া গিয়েছিলেন বাবা-মাকে নিয়ে আসতে। আমরা অপেক্ষা করেছিলাম। কিছুক্ষণ পরে হেলিকপ্টার নামলো। অসুস্থ বাবা আর মাকে নিয়ে নামলেন বঙ্গবন্ধু। বাবার হুইল চেয়ার নিজেই ঠেলে আনলেন ঘরের ভিতরে। তারপর এগিয়ে আসলেন আমাদের দিকে। আব্বুর কাঁধে হাত রেখে চিন্তিত চেহারায় কী যেন আলোচনা করলেন আব্বু আর কাকুর সাথে। সম্ভবত তাঁর বাবার অসুস্থতা এবং চিকিৎসা সংক্রান্ত বিষয়ে। ওই বঙ্গবন্ধুকে আমার শেষ দেখা।
পরের স্মৃতি ভয়াবহ, দুর্বিষহ এক কলঙ্কময় ইতিহাসের কালো অধ্যায়। রাতটা ছিল বোবা কান্না আর অস্থিরতার, মুহুর্মুহু টেলিফোন বেজে ওঠার, নানা সন্দেহের দোলাচলের, কী হচ্ছে! কী খবর! শেষে রাত পোহালো। এমন অন্ধকার নিকষ কালো ভোর বাঙালি দেখেনি আর। এমন কলঙ্ক বাঙালি জাতির ইতিহাসে আর নেই। যে মানুষটি নিজের জীবনের সব কিছু তুচ্ছ করে বাঙালিকে এনে দিয়েছিলেন স্বাধীন রাষ্ট্র, সেই বাঙালি কী নৃশংসভাবে হত্যা করল তাঁকে! শান্তিতে নোবেল বিজয়ী উইলিবান্ট বলেছিলেন, ‘মুজিব হত্যার পর বাঙালিকে আর বিশ্বাস করা যায় না। যারা মুজিবকে হত্যা করতে পারে, তারা যে কোনও জঘন্য কাজও করতে পারে।’
১৯৭৫ সালের ১৫ ই অগাস্ট আকাশ কেঁদেছে, বাতাস কেঁদেছে, কেঁদেছে পাখ-পাখালি, বৃক্ষ-লতা। বোবা কান্নায় গুমড়ে মরেছে বাঙালি, ঘাতকের সঙিনের আতঙ্কে পারেনি পিতা হারানো বুক ফাটা চিৎকার আহাজারি করতে।
শুধু বুকের পাঁজর ভেঙেছে বেদনার আঘাতে। জলপাই পোশাক আর বুটের আস্ফালন তখন শহর জুড়ে। ঘাতকের কন্ঠ বেতারে, রাতারাতি যার নাম হয়ে গেল রেডিও। কত নির্লজ্জ গৌরব গাথা প্রচার করে চলেছে দেশের গানের সাথে। বোঝেনি বাংলার মানুষের মন এ নরপিশাচেরা। ছোট্ট আমি রাত থেকে ভোর আব্বুর চোখ ভাটার মতো জ্বলতে দেখেছি, প্রথম সে চোখে অশ্রু দেখেছি সেই ভোরে। অপারগের গুমড়ানো। পুরনো ছবি কাগজ যা ছিল হাতের কাছে রাগে ক্ষোভে বসে বসে ছিঁড়েছিলেন আর কেঁদেছিলেন এই শান্ত মানুষটি। পিতা হারানোর বেদনা, কিছু করতে না পারার যন্ত্রণা প্রতিটি বাঙালির ঘরে এমনই ছিল সেদিন।
সেদিনের সেই না কাঁদতে পারা কান্না বাঙালিকে কাঁদতে হবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম। শুধু কান্না নয়, জাতির পিতার অসাম্প্রদায়িক সুখী, সুন্দর সোনার বাংলার অসম্পূর্ণ স্বপ্ন বাস্তবায়নের কাজটিও সমাপ্ত করার কাজটিও আমাদেরই। সেদিনের সাত কোটি পরের আজকের ষোল কোটির। কোনও দল মত পথের একার নয়।
পিতা তোমার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধায় আজ তোমার স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার শপথ আমাদের।

Comments are closed.