নন্দীগ্রাম আসলে যা ঘটেছিল #১৭: মমতা ব্যানার্জিকে বললাম, এখন আসবেন না, সিপিআইএম পুরো দখল করে নিয়েছে

আগের পর্ব যেখানে শেষ হয়েছিল: ১০ এবং ১১ নভেম্বর অবরুদ্ধ থাকার পর ১২ তারিখ খেজুরি দিয়ে ঢুকলাম নন্দীগ্রামে। ভাঙাবেড়া ব্রিজ থেকে নবকুমার সামন্তর মোটরসাইকেলে চেপে রওনা দিলাম সোনাচূড়ার দিকে……

নবকুমার সামন্তর মোটরসাইকেলের পিছনে বসে আমি আর আমার ক্যামেরাম্যান পার্থপ্রতিম রায়। সোনাচূড়া ছাড়িয়ে এগোচ্ছি গড়চক্রবেড়িয়ার দিকে। যেতে যেতে দেখছি রাস্তার দু’ধারের সমস্ত দোকান-পাট বন্ধ। শুধু একটা চায়ের দোকান খোলা। তার সামনে ৪-৫ টা সিপিআইএমের ছেলে হাতে বন্দুক নিয়ে দাঁড়িয়ে। ভাবছিলাম, স্থানীয় গ্রামবাসীরা সব গেল কোথায়? তবু তখনও পুরো ব্যাপারটা আঁচ করতে পারিনি, কিছুটা বুঝলাম মিনিট কয়েকের মধ্যে গড়চক্রবেড়িয়ার মোড়ে পৌঁছে। সোনাচূড়া থেকে গড়চক্রবেড়িয়া পর্যন্ত রাস্তা পুরো ফাঁকা। সিপিআইএমের কিছু ছেলে শুধু মোটরসাইকেলে লাল ফ্ল্যাগ লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

গড়চক্রবেড়িয়া মোড়ে পৌঁছে রাস্তার ধারে মোটরসাইকেল থামালেন নব সামন্ত। মোটরসাইকেলে বসেই দেখলাম সেখানেও রাস্তার ধারে ১০-১২ জন কাঁধে অত্যাধুনিক বন্দুক নিয়ে দাঁড়িয়ে। ৩-৪ জন রাস্তার ধারে চায়ের দোকানে বেঞ্চে বসে আছে। সোনাচূড়ার ছেলেদের মতো একই পোশাক। চেনা নব সামন্তের সঙ্গে অচেনা দুজনকে দেখে অস্বস্তিতে পড়ে গেল তারা। আমাদের হাতে আবার ক্যামেরা, মাইক। কী করবে তারা ঠিক যেন বুঝে উঠতে পারছিল না। কয়েকজন তাড়াতাড়ি মাথায় বাঁধা কালো কাপড়ের ফেট্টি খুলে তা দিয়ে মুখ ঢাকল। নবকুমার হাত তুলে তাদের আশ্বস্ত করলেন, আমাদের নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। সিপিআইএমের এই সশস্ত্র বাহিনীর প্রকাশ্যে এভাবে বন্দুক হাতে নিয়ে চলাফেরা দেখে তখনও আমার ঘোর কাটেনি। পার্থ এবং আমার গলা দিয়ে কোনও আওয়াজ বেরচ্ছে না। দুজনেই হাঁ করে দেখছি ছেলেগুলোকে। এদেরই তবে গ্রামের লোক হার্মাদ বলত! এতদিন ধরে যে নন্দীগ্রামের বিরোধীরা অভিযোগ করে আসছিল, গড়বেতা, কেশপুরের সশস্ত্র বাহিনী নিয়ে আক্রমণ চালাচ্ছে সিপিআইএম, এরাই কি তবে তারা? গড়বেতা, কেশপুরের বাহিনী? এদের আড়াল করতেই সেই মেচেদার মোড় থেকে সিপিআইএমের ব্যারিকেড? পশ্চিমবঙ্গে এত বছর সাংবাদিকতা করে কোনওদিন একসঙ্গে এত সশস্ত্র ছেলেকে দেখিনি কোনও এলাকা পাহারা দিতে। আর কারও হাতে ওয়ান শটার বা জং ধরে যাওয়া পুরনো বন্দুক নয়। সব নতুন চকচকে রাইফেল। এ দিয়ে তো আধা সামরিক বাহিনীর সঙ্গে লড়াই করা যায়! হঠাৎ এই পরিস্থিতিতে সম্বিত ফিরল পাশ থেকে নবকুমার সামন্তের চিৎকারে। ‘চন্দনদা দেখুন কাকে নিয়ে এসেছি। বিতনুদাকে নিয়ে এলাম। আমাদের বিরুদ্ধে খবর করেছে। তাও নিয়ে এলাম। ফিরে গিয়ে তো বলবে, নব সামন্ত পৌঁছে দিয়েছিল নন্দীগ্রামে।’ পাশেই তাকিয়ে দেখি রাস্তার উল্টদিকে দাঁড়িয়ে গণশক্তি পত্রিকার সাংবাদিক চন্দন দাস। সিপিআইএমের এই সশস্ত্র বাহিনী দেখে আমার তখন এমনই বিহ্বল অবস্থা, মোটরসাইকেল থেকে নেমে কয়েক হাতের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা আমার দীর্ঘদিনের পরিচিত চন্দনদাকে দেখতেই পাইনি। পরিবেশটা স্বাভাবিক করতে চন্দনদার সঙ্গে কথা শুরু করলাম। কারণ, সিপিআইএমের ছেলেরা তখনও আমাদের দিকে সন্দেহে, অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে। বুঝতেই পারছে না বৈদ্যুতিন মাধ্যমের দুই সাংবাদিক ক্যামেরা নিয়ে কীভাবে এখানে চলে এল এত চেক পোষ্ট পেরিয়ে! সঙ্গী পার্থরও আমারই মতো অবস্থা। ক্যামেরা কাঁধেই ঝুলছে, অবিশ্বাসের চোখে দেখছে চারপাশ। চোখের ইশারায় বললাম, এই সশস্ত্র ছেলেদের ছবি তোলার চেষ্টা করার কোনও দরকার নেই।

তারপর গড়চক্রবেড়িয়া মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ। নবকুমার সামন্ত বলে চলেছেন, ‘বিতনুদা, দশ মাস পরে বাড়ি ফিরেছি। আমার মতো শয়ে শয়ে ছেলেও বাড়ি ফিরছে কাল থেকে। ঢুকে দেখি সমস্ত ঘর লণ্ডভণ্ড। তৃণমূল বাহিনী কিছু আস্ত রাখেনি। কতদিনে বাড়িঘর ঠিক করতে পারব জানি না।’ নবকুমারের কথা শুনছি, কিন্তু কানে ঢুকছে না কিছু। শুধু ভাবছি, নন্দীগ্রাম তো ওঁর এবং আরও সব সিপিআইএম নেতাদের ভাষার সন্ত্রাসমুক্ত হয়েছে! ভালো কথা, কিন্তু সাধারণ মানুষজন সব কোথায়? ওঁকে বললাম, ‘একটু ঘুরে দেখি এদিক ওদিক। তারপর হেঁটে এগোলাম কালীচরণপুর গ্রাম পঞ্চায়েত অফিসের দিকে, যেখানে ৩ জানুয়ারি প্রথম গণ্ডগোল শুরু হয়েছিল। কিন্তু গড়চক্রবেড়িয়া মোড় তো বটেই, একটু ভেতরেও কোথাও কোনও লোক নেই। সব শুনশান, ফাঁকা। ছোট্ট একটা বাজার মতো ছিল, এখনও আছে, কিন্তু সবকটা দোকান বন্ধ, একটা বাড়িতেও লোক নেই। দু’একটা বাড়ির সামনে গরু বাঁধা, জ্বলতে জ্বলতে নিভে যাওয়া উনুন। অবিন্যস্ত, পরিত্যক্ত অবস্থায় দাঁড়িয়ে ঘর-বাড়ি, কোথাও কোনও মানুষ নেই। বাড়ির দরজা বাইরে থেকে বন্ধ। কিছু বাড়ির উঠোনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে রান্নার হাড়ি, বালতি। প্রবল সাইক্লোনের পর প্রকৃতি শান্ত হলে যে পরিস্থিতি হয় বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে অনেকটা তেমন এফেক্ট সোনাচূড়া থেকে গড়চক্রবেড়িয়ার সবকটা গ্রামে। তফাত শুধু একটাই, সাইক্লোনের পর গোটা পরিবার ভেঙেচুরে যাওয়া বাড়ি গড়ে তোলার কাজ করে। আর এখানে পরিবারগুলোই ভ্যানিশ হয়ে গেছে।

 

 

গ্রামের মধ্যে ঘুরছি, শুধু ভাবছি গ্রামের লোকগুলো সব গেল কোথায়? নন্দীগ্রাম যদি সন্ত্রাস থেকে মুক্তই হয়েছে তবে তো গ্রামবাসীদের আনন্দ, উছ্বাস করার কথা। সে সব তবে হচ্ছেটা কোথায়? একজন মহিলাকেও দেখতে পাচ্ছি না শুনশান রাস্তায়। অন্তত বাড়ির বাচ্চাগুলোতো থাকবে। তাও নেই। এত দূর এত কষ্ট করে ঢুকতে পারলাম, অথচ নন্দীগ্রামের মানুষের বক্তব্য জানার মতো একটা লোককেও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সিপিআইএমের পুর্নদখলের পর সাংবাদিক হিসাবে প্রথম নন্দীগ্রামে ঢুকতে পারার পর একটা আনন্দ উত্তেজনা হচ্ছিল। কিন্তু তা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। গড়চক্রবেড়িয়া মোড়ে মোটরসাইকেল থেকে নেমেই কালো গেঞ্জি, হাফ প্যান্ট, মাথায় কালো ফেট্টি, হাতে বন্দুক, হিংস্র মুখ-চোখ ছেলেদের দেখে খানিক ধাতস্থ হওয়ার পর পার্থ আমার দিকে চোখের ইশারা করেছিল। আমি বলে দিই, ওদের ছবি তোলার কোনও চেষ্টা না করতে। প্রথমত ওরাই তার অনুমতি দিত না। তাছাড়া সিপিআইএম নেতাদের সাহায্যে এত দূর এসেছি। লুকিয়ে এই ছবি তুলে তা টেলিভিশনে দেখালে তা অনৈতিক কাজ হবে। বিশ্বাসভঙ্গ করা হবে। কিন্তু নন্দীগ্রামে ঢুকতে পেরে ভেবেছিলাম, সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলব। বাইরের জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন নন্দীগ্রামে ৫-৬ দিনে কী ঘটেছে তা নিয়ে গ্রামবাসীদের বাইট নেব। কিন্তু কোথায় কী? কালীচরণপুরের রাস্তা দিয়ে ঘুরছি। আর ভাবছি, তমলুকে ফিরে গিয়ে তো অফিসের কাউকে বলে বিশ্বাসও করাতে পারব না আমরা সোনাচূড়া, গড়চক্রবেড়িয়াতে ঢুকতে পেরেছিলাম।

বৈদ্যুতিন সংবাদমাধ্যমের ভাষায় কোনও ভিশ্যুয়াল তো হচ্ছে না। এরই মধ্যে নব সামন্ত এসে তাড়া দিলেন, ‘বিতনুদা চলুন, আর বেশিক্ষণ থাকা ঠিক হবে না। তাছাড়া আমাকেও ফিরতে হবে।’ প্রায় আধ ঘন্টা গড়চক্রবেড়িয়া এবং আশেপাশের এলাকায় ঘোরাফেরা করে একটাও লোক দেখতে না পেয়ে আমিও ততক্ষণে হাল ছেড়ে দিয়েছি, বুঝে গিয়েছি বলার মতো কোনও স্টোরি হবে না। আবার হাঁটতে হাঁটতে গেলাম বড়ো রাস্তায় গড়চক্রবেড়িয়া মোড়ে। চন্দনদা ফিরবে, আমাদেরও ফিরতে হবে ভাঙাবেড়া ব্রিজ পর্যন্ত। সেখানেই আমাদের গাড়ি দাঁড়িয়ে। কিন্তু ফেরার জন্য মোটরসাইকেল একটাই, নব সামন্তর। আমি চাইছিলাম, ওঁরা চলে গেলে আর একটু থেকে যেতে। কিন্তু ভাবছিলাম, ফিরব কীভাবে? এমন সময় দেখি উল্টো দিক থেকে একটা তিন চাকার ভ্যান আসছে। এক মাঝবয়সী খালি ভ্যান চালিয়ে যাচ্ছে ভাঙাবেড়ার দিকে। নব সামন্তকে বললাম, ‘তুমি চন্দনদাকে মোটরসাইকেল নিয়ে চলে যাও। আমি আর পার্থ ভ্যানে চেপে ভাঙাবেড়া পর্যন্ত চলে যাব। এই প্রস্তাব পছন্দ হল নবকুমারের, ভ্যান চালককে থামালেন হাত দেখিয়ে। বললেন, আমাদের দু’জনকে ভাঙাবেড়া পৌঁছে দিতে। এই যখন কথাবার্তা হচ্ছে, হঠাৎ ফোন বেজে উঠল। পকেট থেকে মোবাইল বের করে দেখি, স্ক্রিনে শোভন চট্টোপাধ্যায়ের নাম ভাসছে। এখন কথা বলা যাবে না। সকালে একবার কথা হয়েছিল, বলেছিলাম, নন্দীগ্রামে ঢোকার চেষ্টা করছি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেদিন সকাল থেকেই তমলুকের হোটেলে বন্দি। নন্দীগ্রামে ঢোকার সব রাস্তা তখনও অবরোধ করে রেখেছিল সিপিআইএম বাহিনী। তাই নন্দীগ্রামে ঢোকার আশা ছেড়ে তমলুকের হোটেলেই বসেছিলেন তৃণমূল নেত্রী। অনবরত কথা বলছিলেন পূর্ব মেদিনীপুরের নেতাদের সঙ্গে। কিন্তু কেউই নন্দীগ্রামের প্রবেশের রাস্তা বতলাতে পারেনি দলনেত্রীকে। তাই আমি নন্দীগ্রামে যাওয়ার চেষ্টা করছি শুনে সকালে ফোনে শোভনদা বলেছিলেন, পৌঁছতে পারলে একবার জানাতে নন্দীগ্রামে কী অবস্থা।

তাড়াতাড়ি ফোনটা ধরে বললাম, ‘পরে কথা বলছি, এখন কাজের মধ্যে আছি।’

‘ঢুকতে পেরেছিস? কী অবস্থা ভেতরে, দিদি জানতে চাইছে।’

‘এখন কথা বলা যাবে না। অসুবিধা আছে। ঢুকতে পেরেছি। একটু ব্যস্ত আছি। পরে তোমাকে ফোন করছি।’ ফোন কেটে দিলাম। তারপর নবকুমার সামন্তকে বললাম, ‘তুমি চন্দনদাকে নিয়ে মোটরসাইকেলে এগোও, আমরা দুজন ভ্যানে চেপে যাচ্ছি। ‘

আমি আর পার্থ চেপে বসলাম তিন চাকার ভ্যানে। চাললকে জিজ্ঞেস করলাম, নাম কী? বাড়ি কোথায়? মূল বিষয়ে ঢোকার আগে পরিস্থিতি হালকা করতে এমনই প্রশ্ন করছিলাম ভ্যান চালককে। কিন্তু কোনও কথার উত্তর নেই। গায়ের জোরে ভ্যান চালাচ্ছে। যত তাড়াতাড়ি পারে পৌঁছতে চাইছে ভাঙাবেড়ায়। চোখে-মুখে স্পষ্ট আতঙ্ক। বহু প্রশ্নের পর এটুকুই শুধু বললেন, বাইরে ছিল এমন কিছু লোক সকালে ব্যাগ-পত্র নিয়ে বাড়ি ফিরেছে। তাঁদের বাড়ি পৌঁছে দিতে তাঁকে ডেকে আনা হয়েছে। কিন্তু কী অবস্থা ছিল এতদিন, ঠিক কী হয়েছিল? কোনও উত্তর নেই। তাড়াতাড়ি যাতে পৌঁছে না যাই তার জন্য ভ্যান চাললকে বললাম, একটু আস্তে চালাও, বসতে অসুবিধা হচ্ছে। ভ্যানের গতি একটু কমল। সোনাচূড়া পেরনোর পর একটু এগোতেই দেখি, সামনে ১০০-১৫০ মিটার দূরে একটা মিছিল যাচ্ছে ভাঙাবেড়ার দিকে। গোঙানির মতো স্লোগান বরিয়ে আসছে গোটা মিছিলটার গলা দিয়ে। ভ্যান চালককে বললাম, তাড়াতাড়ি মিছিলটাকে পার করে দাঁড়াতে। এতক্ষণে কিছু লোক দেখতে পেয়েছি। ১০০-১৫০ জন লোকের মিছিলটাকে পেরোনোর সময় দেখলাম, অধিকাংশেরই হাতে সিপিআইএমের লাল পতাকা। আর আশ্চর্য, সবার মুখে এক স্লোগান। ‘নন্দীগ্রামে শিল্প চাই, পেট্রোকেমিক্যাল হাব চাই, সবার জন্য কাজ চাই’, ‘শিল্প বিরোধী তৃণমূল-মাওবাদী দূর হঠো’, ‘নন্দীগ্রামকে আর অশান্ত করা চলবে না’, যন্ত্রের মতো এমনই সব স্লোগান দিতে দিতে চলেছে ১০০-১৫০ মানুষ। মুখে কোনও অভিব্যক্তি নেই, স্লোগানে প্রাণ নেই। দেখে মনে হচ্ছে গামছা, ধুতি, জামা, প্যান্ট, লুঙ্গি, বা শাড়ি পরা ১০০-১৫০ টা রোগা রোগা চেহারার রোবট হাঁটতে হাঁটতে স্লোগান দিচ্ছে। পুরুষদের বেশিরভাগই বয়স ৬০-৬৫ র বেশি, সঙ্গে কিছু মহিলাও। স্লোগান বলে চলেছে, কিন্তু তা হৃদয় থেকে নয়, উঠে আসছে প্রবল অনিচ্ছা থেকে। শবযাত্রার মিছিলেও এর থেকে বেশি প্রাণ থাকে। মাইক হাতে ভ্যান থেকে লাফ মেরে নামলাম রাস্তায়। মিছিলটা বেশ দ্রুত চলছে। পার্থ প্রায় দৌড়তে দৌড়তে ছবি তুলছে। আমিও জোর পায়ে হাঁটছি মিছিলের সঙ্গে। কয়েকজনকে মাইক হাতে জিজ্ঞেস করতে চাইছিলাম, কী পরিস্থিতি, কেন মিছিল ইত্যাদি। কিন্তু মিছিলের নেতৃত্বে থাকা দুই সিপিআইএম নেতার হাতে অদৃশ্য চাবুক। স্লোগান ছাড়া আর কোনও কথা নয়। আর বাইরের লোকের সঙ্গে কথার তো কোনও প্রশ্নই ওঠে না। দ্রুত এগোচ্ছে মিছিল, ভাঙাবেড়া ব্রিজের দিকে। রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে পড়লাম। মিছিলটা ক্রমে দূরে চলে যাচ্ছে। সেদিকে তাকিয়ে আছি, আর ভাবছি, এটা তো নন্দীগ্রাম নয়। হতেই পারে না। সেই জানুয়ারি থেকে আসছি। এখানে মানুষের এত তেজ, ক্রোধ। জমি রক্ষার জন্য জীবন বাজি রেখে আন্দোলন, কখনও কখনও তা হিংস্রও। সেই সব গেল কোথায়? কী এমন হল ৭-১০ দিনে, বঁটি, ঝাঁটা নিয়ে লড়াই করা মহিলা, লাঠি, রড হাতে দিন-রাত এক করে গ্রাম পাহারা দেওয়া পুরুষ, সশস্ত্র বাহিনী, সব রাতারাতি ভোল পালটে শিল্পের দাবিতে স্লোগান দিচ্ছে? এরা কি নন্দীগ্রামেরই মানুষ? এ কি ম্যাজিক নাকি? হতেই পারে না। হয় মানুষ মিথ্যে, স্লোগান ঠিক। আর মানুষ যদি নন্দীগ্রামের হয়, তবে এ স্লোগান মিথ্যে। বানানো। এক মূহুর্তে ভেবেছিলাম, সশস্ত্র বাহিনীর মতোই শিল্পের দাবিতে মিছিল করার জন্যও বাইরে থেকে লোক নিয়ে এসেছে সিপিআইএম। আর যদি তা না হয়, যদি এরা সব এখানকারই লোক হয়, তবে নির্ঘাৎ এটা হীরক রাজার দেশ। একই লোক, যন্তর-মন্তর ঘরে ঢোকার আগে মুখে এক কথা। আর সেখান থেকে বেরিয়ে আসার পরেই সর্বশক্তিমান রাজার কথা তার মুখে। মানুষের দাবি রাষ্ট্রের পছন্দ নয়, তাই রাষ্ট্রের ভাষা মানুষের মুখে। হীরক রাজার দেশের উপমাটা মাথায় আসতেই ভেবে ফেললাম সেদিনের নন্দীগ্রামের স্টোরি। আর সেটা করতে হবে মিছিলটাকে সামনে রেখেই। আবার ছুটলাম মিছিল লক্ষ্য করে। ধরেও ফেললাম। পার্থ তখনও হাঁটতে হাঁটতে ছবি তুলছিল। মিছিলটাকে পেছনে রেখে একটা স্টোরি করলাম, ‘গোটা নন্দীগ্রাম যেন একটা যন্তর-মন্তর ঘর। যে মানুষ শিল্প নয়, জমি রক্ষার জন্য ১০ মাস আন্দোলন করেছে, তারাই এখন শিল্পের দাবিতে মিছিল করছে। সিপিআইএমের অপারেশন সূর্যোদয় মানে, যন্তর-মন্তর ঘরে সাধারণ মানুষের মগজ ধোলাই।’  স্টোরি শেষ করতে করতে মিছিলটা দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেল। আবার তিন চাকার ভ্যানে উঠলাম দু’জনে। পৌঁছলাম ভাঙাবেড়া ব্রিজে। সিপিআইএমের ছেলেরা জটলা করে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের চোখ-মুখ বিকেলে হলদি নদীর ওপর পড়া সূর্যের আলোর মতোই চকচক করছে। এই ঝকঝকে মুখের কাছে হাজার ওয়াটের আলো তো তুচ্ছ। প্রায় ১০ মাস পর ঘড়ে ফেরার আনন্দ। তাদের কারও সঙ্গে স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে, বয়স্ক বাবা, মা। যে পরিবার নিয়ে বা পরিবার ছেড়ে ঘরছাড়া হয়েছে কখনও, সেই জানে এই অভিজ্ঞতা কেমন। এরাই তো নন্দীগ্রামে তাদেরই নির্বাচিত সরকারের শিল্পায়ন কর্মসূচির প্রচেষ্টার শিকার।

 

কিন্তু এরা কারা? পাশেই চোখ পড়ল মিছিল করে আসা লোকগুলোর দিকে। ব্রিজের একটা পারে বসে আছে চুপচাপ। এতটা পথ মিছিলে হেঁটে হাফাচ্ছে। কেউ কল টিপে জল খাচ্ছে, কেউ ধুতি দিয়ে মুখ মুছছে। ১২ নভেম্বর দুপুরে, মাথার ওপরে গনগনে সূর্যের তাপ। কিন্তু কী বৈপরিত্য মানুষগুলোর মধ্যে। দু’দল রাস্তার দুদিকে। আমরা ওরাও তত্ব স্পষ্ট দু’দলের আচরণে। অথচ দু’দল মানুষই এক জায়গার বাসিন্দা।

নন্দীগ্রাম। মাত্র এক বছর আগেও সবকটা মানুষের আনন্দ, দুঃখ, চাহিদা, ভালোবাসা এক তারে বাঁধা ছিল। একজনের বিপদে, বিয়েতে অন্যজন এগিয়ে আসত। আর আজ, দশ মাসের মধ্যে এই দু’দল সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের মধ্যে দূর্ভেদ্য পাঁচিল তুলে দিয়েছে সাড়ে ১২ হাজার একর জমিতে পেট্রোরসায়ন শিল্প তালুক গড়ার সরকারি উদ্যোগ এবং সিপিআইএম-তৃণমূল কংগ্রেস নামক দুই যুযুধান পক্ষের দলীয় রাজনীতি। এই পাঁচিল কোনও দিনও ভাঙবে? ভাঙা সম্ভব?

 

১২ নভেম্বর। গত দশ মাস ধরে সবচেয়ে বেশি সংঘর্ষ, মৃত্যুর সাক্ষী ভাঙাবেড়া ব্রিজ। নীচে তালপাটি খাল। মাথার এক্কেবারে উপরে সূর্য, উত্তুরে হাওয়া। এখনও শুরু হয়নি, তবে হলদি নদীর এক ঠান্ডা হাওয়া আছে। ব্রিজের কাছে একদল মানুষ আনন্দ, উচ্ছ্বাস করছে, দীর্ঘদিন বাদে ঘরে ফেরার জন্য। মাত্র ৫০ ফুট দূরে বসে থাকা অন্যদলটা ঘরেই ছিল এতদিন, কিন্তু আজ মুখে-চোখে আতঙ্কের ছাপ। একদল, একসময় শিল্পের দাবি তুলে ঘরছাড়া হয়েছিল, তারা সক্রিয় সিপিআইএম নেতা-কর্মী। এতদিন বাদে আজ ঘরে ঢুকছে। অন্যদল, টানা শিল্পের বিরোধিতা করেছে। আন্দোলন করেছে সিপিআইএমের বিরুদ্ধে। আর আজ শিল্পের দাবিতে মিছিল করছে। তবে যে সিপিআইএম নেতারা কলকাতায় ঘোষণা করলেন, ‘নন্দীগ্রাম দুর্বৃত্তদের হাত থেকে মুক্ত  হয়েছে। এখানে এখন চারদিকে শান্তির পরিবেশ।’ কিন্তু শিল্পের দাবিতে এই মিছিল করে আসা একদল লোককে দেখে তো তা মনে হচ্ছে না। তার মানে কি নন্দীগ্রামে সিপিআইএমের নেতা এবং সক্রিয় কর্মীদের জীবনে শান্তি, আনন্দ, আর মুক্তি এসেছে? সেখানকার সমস্ত মানুষের জীবনে নয়? সিপিআইএমের আনন্দ, মুক্তি, শান্তির সঙ্গে বিরোধ আছে তার মানে। এই শান্তি এবং আনন্দটাও সিলেক্টিভ!

যে লোকগুলো এত মাস আন্দলন করছিল, তারা কোন ম্যাজিকে রাতারাতি পালটে গেল সেই খোঁজ নেওয়া আরও জরুরি। বুঝতে পারছিলাম, আজ আর হবে না, কিন্তু এই খোঁজ নেওয়াটা খুবই দরকার। নয়তো নন্দীগ্রামের কোনও অঙ্কই মিলবে না। আমার না, সিপিআইএমেরও না। কারণ, নন্দীগ্রামের এই সোনাচূড়া, ভাঙাবেড়া, গড়চক্রবেড়িয়া সহ আশপাশের সমস্ত এলাকায় সিপিআইএম তো সেই আগের বছরের ডিসেম্বরে লক্ষ্মণ শেঠের মিটিংয়ের পর থেকেই সংখ্যালঘু। কোন যাদুবলে এই ১ নম্বর ব্লকের এক-দেড়শো মানুষ সিপিআইএমের অনুগত ক্যাডারের ভূমিকায় অভিনয় করেছে, সেই রহস্য ভেদ করতেই হবে। নয়তো নন্দীগ্রাম বোঝা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। বাকি হাজার হাজার মানুষই বা কোথায় ভ্যানিশ হয়ে গেল? গ্রামে একটা বাচ্চা কিংবা মহিলা পর্যন্ত নেই! এমনও হয় নাকি?

 

প্রায় দুপুর আড়াইটে পর্যন্ত ছিলাম নন্দীগ্রামে। তারপর রওনা দিলাম তমলুকের দিকে। খেজুরি দিয়েই ফিরতে হবে। এরই মধ্যে আরও দু’তিনবার ফোন করেছিলেন শোভন চট্টোপাধ্যায়। ধরতে পারিনি। গাড়িতে উঠে ফোন করলাম।

 

‘কী খবর? কী অবস্থা ওখানে? কত দূর যেতে পারলি?’ উৎকন্ঠা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সফরসঙ্গীর গলায়।

‘খেজুরি দিয়ে ঢুকছিলাম। ভাঙাবেড়া ব্রিজ পেরিয়ে গড়চক্রবেড়িয়া পর্যন্ত গেছিলাম। এখানে যা তা অবস্থা। এখন তোমরা আর এখানে আসার চেষ্টা কোরও না। সিপিআইএম পুরো এলাকা দখল করে নিয়েছে। বড়ো বড়ো বন্দুক নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। দিদি এলে স্থানীয় লোকেদের দিয়েই সিপিআইএম বিক্ষোভ দেখাবে। সেটা ভালো হবে না। এখন আন্দোলন সব শেষ। তৃণমূলও শেষ।’  টানা বলে থামলাম। পেছনে শুনতে পাচ্ছি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গলা।

‘নে, দিদির সঙ্গে কথা বল।’ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে ফোন দিলেন শোভন চট্টোপাধ্যায়।

একই কথা জানালাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। আর বললাম, ‘দিদি, এখানে পুলিশ, প্রশাসন বলে কিছু নেই। চারদিকে শুধু সিপিআইএমের ক্যাডার। বেশিরভাগই বন্দুক নিয়ে। পরিস্থিতি খুব খারাপ। আমি ফিরছি তমলুকে।’

পুরোটা শুনে ফোন রাখলেন তৃণমূল নেত্রী। গাড়িতে ফেরার সময় ভাবছিলাম, হেঁড়িয়া মোড় থেকে পুরো খেজুরি হয়ে ভাঙাবেড়া ব্রিজ পেরিয়ে এই যে গড়চক্রবেড়িয়া পর্যন্ত গেলাম, গোটা রাস্তায় একটাও পুলিশ দেখতে পাইনি। প্রশাসন বলেও কোনও বস্তুই নেই নন্দীগ্রাম, খেজুরিতে। সমস্ত এলাকায় শুধু শাসক দলের নজরদারি এবং বন্দুক উঁচিয়ে কাল হাফ প্যান্ট, টাইট গেঞ্জি পরা ছেলেদের পাহারা। প্রশাসন নিষ্ক্রিয়, দল সংসদ বহির্ভূত কার্যকলাপে সাফল্য পেয়েছে। এই সব খবরাখবর পেয়েই কি আগের দিন কলকাতায় বসে সিপিআইএম নেতারা বলেছিলেন, নন্দীগ্রাম সন্ত্রাসমুক্ত হয়েছে? এলাকায় আইনের শাসন ফিরেছে। নন্দীগ্রাম থেকে এত দূরে কলকাতায় বসে ভুল যে কিছু বলেননি তা তো কিছুক্ষণ আগে ভাঙাবেড়া ব্রিজের কাছে শিল্পের দাবিতে মিছিল করা লোকগুলোর মুখ-চোখ দেখেই বুঝেছি। আর স্থানীয় সিপিআইএম নেতাদের নন্দীগ্রামে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য কি নির্মম প্রতিশোধস্পৃহা! যে মানুষগুলো এতদিন জমি রক্ষার আন্দোলন করেছে, তাদের দিয়েই শিল্পের দাবিতে মিছিল করিয়ে দিল! চাবুক মেরে সবক শেখানো আর কাকে বলে! তাদের বুঝিয়ে দিল, এ রাজ্যে মহাজাগতিক কাণ্ডকারকখানাও বিচিত্র কোনও কারণে ঘটে যেতে পারে আগাম সতর্কবার্তা না দিয়ে, কিন্তু রাজনীতিতে অত্যাশ্চর্য কিছু ঘটার সম্ভাবনা নেই। পশ্চিমবঙ্গে সিপিআইএম সর্বশক্তিমান। এই না হলে কেউ বলে, প্রতিষ্ঠা হয়েছে আইনের শাসন!

পড়ুন আগের পর্ব: নন্দীগ্রাম আসলে যা ঘটেছিল #১৬: কালো প্যান্ট, গেঞ্জি, কাঁধে রাইফেল! সোনাচূড়া মোড়ে সিপিআইএম বাহিনী এলাকা পাহারা দিচ্ছে

 

কিন্তু এই যে বন্দুকের নলের সামনে নন্দীগ্রামের আন্দোলনকারীদের অসহায় আত্মসমর্পণ, এ কি চিরস্থায়ী কোনও বন্দোবস্ত? এ প্রশ্নের উত্তর সেদিন পাইনি। ১২ নভেম্বর ঘন্টাতিনেক নন্দীগ্রামে কাটিয়ে ফেরার পথে এই প্রশ্নেরই উত্তর খুঁজেছিলাম। এই রহস্যে প্রথম আলো ফেলেছিলেন এক বয়স্ক মহিলা পরদিন ১৩ নভেম্বর। আবার নন্দীগ্রামে গেলাম। এক বয়স্ক মহিলা, নাম জিজ্ঞেস করা হয়নি, বাড়ির বাইরে বসে মাটির উনোনে জ্বালিয়ে রান্না করছিলেন। অধিকারীপাড়ায়। সেদিনও ঢুকেছিলাম খেজুরি দিয়ে। সেদিন আর কেউ কোনও বাধা দেয়নি। কিন্তু ১৩ তারিখ আর ভাঙাবেড়া যাইনি। খেজুরি দিয়ে ঢুকে সোজা গেলাম তেখালি ব্রিজ। তেখালি ব্রিজ পেরিয়ে নন্দীগ্রামে ঢুকে প্রথমে গেলাম মহেশপুর হাইস্কুল। সেখানে তিন দিন আগে গ্রামবাসীদের মরিয়া মিছিলে গুলি চালিয়েছিল সিপিআইএম। মহেশপুরেও থমথমে পরিস্থিতি। আগের দিন সোনাচূড়া বা গড়চক্রবেড়িয়াতে যা দেখেছিলাম, একটাও লোক নেই, মহেশপুরে তা নয়। কিছু লোকজন রয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দা। পাশাপাশি রয়েছে সিপিআইএমের নজরদারিও। কেউ বিশেষ কিছু বলছে না, কিন্তু একটা গুমোট পরিবেশ। মহেশপুরে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করার পর গেলাম অধিকারীপাড়ায়। গ্রামে যে জমজমাট পরিবেশটা থাকে তা নেই। সবাই চুপচাপ। আর একটা জিনিস খেয়াল করেছিলাম, গ্রামে পুরুষ প্রায় নেই বললেই চলে। মহিলা রয়েছেন কিছু। একটা বাড়ির সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি। এক বয়স্ক মহিলা পাখা দিয়ে উনোনে হাওয়া দিচ্ছিলেন। জানতে চাইলাম, কী অবস্থা?’ মুখ তুলে তাকালেন। তারপর বললেন,  ‘এলাকায় দখল লিছে, মানুষের লয়।’

বারবার নন্দীগ্রামে গিয়েও যে কথা বুঝতে বহু সময় লেগেছিল, সেদিন পাঁচ শব্দের বলেছিলেন ওই মহিলা, তাঁর অভিজ্ঞতা বলেছিল! সিপিআইএম এলাকার দখল নিয়েছে, মানুষের দখল নিতে পারেনি। আমিও তো তার আগে, পরে কতবার গিয়েছি, কিন্তু ২০০৮ সালের পঞ্চায়েত ভোটের আগে পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারিনি, নন্দীগ্রামের মানুষ কী চাইছে। বুঝতে পারেনি সিপিআইএমও। সিপিআইএমের ধারণা ছিল, বন্দুকের নলের সামনে আত্মসমর্পণ করা নন্দীগ্রামের মানুষ ভয়ে চিরকালীন দাসানুদাসে পরিণত হবে। কিন্তু সব হিসেব উলটে দিয়েছিল ২০০৮ সালের পঞ্চায়েত ভোট।

আমাকে বারবার বোকা বানিয়েছে নন্দীগ্রাম। একথা স্বীকার করতে লজ্জা নেই, সেই পঞ্চায়েত ভোট চোখের সামনে দেখেও পুরোপুরি বুঝতে পারিনি, কী রেজাল্ট হতে চলেছে। সিপিআইএমের বিরুদ্ধে মানুষের রাগ, ক্ষোভ ছিল জানতাম। পঞ্চায়েত ভোটের ফল দেখে বুঝেছিলাম, ভুল জানতাম, ওটা আসলে ঘৃণা। ১৪ মার্চ ১৪ জনের মৃত্যুর ঘটনা মানুষ কখনও না ভুললেও, হয়তো একদিন তার জন্য ক্ষমা করে দিত সিপিআইএম পরিচালিত সরকারকে। পুলিশকে। কিন্তু নভেম্বরে শাসক দলের সশস্ত্র দখলদারি নন্দীগ্রামের মানুষ মানতে পারেনি। বিশ্বাসই করতে পারেনি, পাশের বাড়ির ছেলে বহিরাগতদের সঙ্গে মিশে অনেক বছরের পরিচিত মহিলার গায়ে প্রকাশ্যে হাত দিতে পারে। মেয়েকে বাঁচাতে মায়ের ইজ্জত গেছে, বাড়িতে থাকার শর্তে বহুদিনের পোষা গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি সব গেছে। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে মানসিক অত্যাচার। জরিমানা। দশ মাস জমি রক্ষার আন্দোলনের মাশুল বহু মূল্য দিয়ে চোকাতে হয়েছে নন্দীগ্রামের সিপিআইএম বিরোধী মানুষকে। আর যত মূল্য দিতে হয়েছে সাধারণ মানুষকে, ততই তার জেদ বেড়েছে। সিপিআইএমওএর বিরুদ্ধে জেহাদ তীব্র হয়েছে।

চলবে

(১৮ সেপ্টেম্বর থেকে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে নন্দীগ্রাম আসলে যা ঘটেছিল। প্রতি পর্বে লাল রং দিয়ে আগের পর্বের লিঙ্ক দেওয়া থাকছে)

Comments are closed.