নন্দীগ্রাম আসলে যা ঘটেছিল #১৮: সুদীপ চোঙদার, তেলেগু দীপক ১০ নভেম্বর জলপথে নন্দীগ্রাম ছাড়ল

আগের পর্ব যেখানে শেষ হয়েছিল টানা ৫-৬ দিন অভিযান চালিয়ে ২০০৭ সালের ১০ নভেম্বর নন্দীগ্রাম দখলে এনেছিল সিপিআইএম। ভীত সন্ত্রস্ত্র নন্দীগ্রামে শিল্পের দাবিতে সিপিআইমের নেতৃত্বে মিছিল চলল কয়েকদিন। সর্বত্র উড়ল লাল পতাকা………

 

আন্দোলনকারীদের অভিজ্ঞতায় নভেম্বর, ২০০৭

২০০৭ সালের গোড়ায় যে নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সুত্রপাত এবং তার আগের বছরের অগাষ্ট, সেপ্টেম্বর থেকে যার প্রস্তুতি শুরু হয়েছিল, তাতে একটা বড়ো ভূমিকা ছিল কংগ্রেসেরও। সোনাচূড়ার বাসিন্দা পিঠোপিঠি দুই ভাই মিলন প্রধান এবং সবুজ প্রধান দীর্ঘদিন ধরেই কংগ্রেস করতেন। সিপিআইএম বিরোধী পরিবার। বাবা প্রবীরচন্দ্র প্রধান, মা বঙ্গবালা  প্রধান। পুরনো কংগ্রেস পরিবারের মতোই জায়গা জমি ছিল কয়েক বিঘে। বাড়ির পিছনের জমিতে পানের বুরুজ, বাঁশ বন। আন্দোলন শুরুর ঢের আগে থেকেই পিছিয়ে পড়া নন্দীগ্রাম ১ নম্বর ব্লকের বাজার এলাকা থেকে অন্তত ২০ কিলোমিটার দূরে সোনাচূড়ার বাড়িতে ল্যান্ড লাইন ফোন ছিল। চাট্টিখানি কথা না। ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য দুই ভাই মিলন এবং সবুজ নন্দীগ্রামে টানা প্রায় ১১ মাসের সশস্ত্র আন্দোলনে শুধু বন্দুকেই যা হাত দেননি, বাদবাকি সমস্ত রকমভাবেই যুক্ত ছিলেন সিপিআইএম বিরোধী লড়াইয়ে। সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির আন্দোলনে। ১০ নভেম্বর দুই ভাইই নন্দীগ্রামছাড়া হয়েছিলেন। কী ঘটেছিল নভেম্বর মাসে তা মিলন প্রধান আমাকে যেমন বলেছেন, হুবহু তেমনই লিখব।

 

‘অক্টোবর মাসের শেষ, দুর্গাপুজো এবং লক্ষ্মীপুজোর কয়েকদিন পর থেকেই নন্দীগ্রামে সিপিআইএমের গতিবিধি অনেক বেড়ে গিয়েছিল। আমরা সোনাচূড়ায় ততটা টের পেতাম না। কারণ, সেখানে সিপিআইএম পৌঁছতে পারত না, কিন্তু সাতেঙ্গাবাড়ি, রানিচক, গিরির বাজার, বাহারগঞ্জ নানা জায়গা থেকেই ফোনে খবর পেতাম, সিপিআইএমের বিরাট বাহিনী বন্দুক হাতে মোটরসাইকেলে চড়ে গ্রামের পর গ্রাম দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। আমার সঙ্গে আদিত্য বেরার রোজ কথা হোত। আদিত্যদা ছিল গোটা নন্দীগ্রামের স্থানীয় যোদ্ধাদের মধ্যে এক নম্বর। বহু বছর আর্মিতে কাজ করেছে, প্রচণ্ড সাহস। আদিত্যদার মুখেই শুনতাম, সিপিআইএম এলাকা ঘিরছে।

নভেম্বরের ৩ বা ৪  তারিখ হবে, ঠিক মনে নেই, দুপুর আড়াইটে-তিনটে বাজে। আমরা প্রায় সারাদিন রাস্তায় জোটবদ্ধ হয়ে থাকতাম। কখন কী ঘটে যায়! সোনাচূড়া বাজারে বসে আছি। হঠাৎ খবর এল, গোকুলনগরের পুলিশ ফাঁড়ির কাছে একটা বাড়িতে প্রচুর বাইরের ছেলে বন্দুক নিয়ে জড়ো হয়েছে। ওরা আসছে সোনাচূড়া দখল করতে। তেখালি ব্রিজের একদম কাছেই ছিল গোকুলনগর ফাঁড়ি। গোকুলনগর থেকে ভেতরের গ্রামের রাস্তা দিয়ে, আল ধরে অধিকারীপাড়া, গাড়ুপাড়া হয়ে সোনাচূড়া পর্যন্ত রাস্তা আছে। এই খবর আসা মাত্রই পাঁচ মিনিটের মধ্যে ফোনে ফোনে আশেপাশের লোকজনকে জানানো হল। মূহুর্তের মধ্যে সোনাচূড়া বাজারে জড়ো হয়ে গেল পুরুষ, মহিলা মিলে এক-দেড় হাজার লোক। তারপর সবাই মিলে মাঠের রাস্তা দিয়ে রওনা দিলাম গোকুলনগরের দিকে। আমি গেলাম মোটরসাইকেল চালিয়ে। ঘন্টাখানেক বাদে সবাই যখন গোকুলনগরে পৌঁছেছি সেখানে আরও বহু লোক জমা হয়ে গেছে। যে যেখান থেকে পেরেছে খবর পেয়ে চলে এসেছে সিপিআইএমের বন্দুক বাহিনীকে ঠেকাতে। প্রায় সাড়ে চারটে বাজে। গোকুলনগরের স্থানীয় লোকজন বলল, দুপুরে কিছু লোক এসেছিল ঠিকই, কিন্তু কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে চলে গেছে। আমরা তখন ভাবছি, কী করা যায়। নিজেদের মধ্যে কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে ঠিক করলাম, ফিরে যাব। সবে ফিরতে শুরু করেছি, গুলির শব্দ। আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম একদম তালপাটি খালের ধারে। খালের উল্টোদিকেই খেজুরি। তখন আমরা প্রায় ৩-৪ হাজার লোক। খেজুরির দিক থেকে বৃষ্টির মতো গুলি আসতে শুরু করল। সঙ্গে সঙ্গে শুয়ে পড়লাম। সবাই হুড়মুড় করে শুয়ে পরে হামাগুড়ি দিয়ে আলের পেছনে যেতে শুরু করলাম। কেউ মাঠে, পুকুরে ঝাপ দিল। কোনওভাবে হামাগুড়ি দিয়ে ১৫০-২০০ মিটার পিছিয়ে এসে আলের পেছনে ধান ক্ষেতে লুকোলাম। এতগুলো মানুষ মাঠে শুয়ে আছি, খেজুরির দিক থেকে গুলি চলছে। মাথার ওপর দিয়ে গুলি চলে যাচ্ছে। ওদের হাতে বাইনাকুলার ছিল। তা দিয়ে দেখে দেখে গুলি চালাচ্ছে। সেদিন রাত প্রায় আটটা পর্যন্ত সবাই গোকুলনগরের ধানক্ষেতে শুয়ে ছিলাম। অন্ধকার নামার পর সাড়ে সাতটা নাগাদ খেজুরির দিক থেকে  গুলি চালানো বন্ধ হয়। ধানক্ষেত দিয়ে প্রায় এক-দেড় কিলোমিটার হামাগুড়ি দিয়ে পিছিয়ে এসে তারপর সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছি। রাত নটা নাগাদ হেঁটে ফিরলাম সোনাচূড়া। সেদিন রাতে আমার প্রথম মনে হয়েছিল, অবস্থা খুব খারাপ, আর বোধহয় ঠেকিয়ে রাখা যাবে না সিপিআইএমকে। আর রক্ষা করা যাবে না নন্দীগ্রাম। সিপিআইএমের এই বিশাল বাহিনী, অত্যাধুনিক বন্দুক আর গুলির সামনে আদিত্যদা, নারায়ণ, গৌরাঙ্গ, সুকুমাররা আর কতদিন লড়তে পারবে? রাতেই ফোন করেছিলাম আদিত্যদাকে। কিছুক্ষণ কথা হয়। তখন প্রথম জানতে পারি, আমাদের গুলির ভাঁড়ার প্রায় শেষ। গুলি আনানোর কোনও ব্যবস্থা করা যাচ্ছে না। এত হাজার হাজার মানুষের সমর্থন আছে, যোদ্ধা আছে, বন্দুক আছে, অথচ গুলি নেই, অসহায় লাগছিল আদিত্যদার গলা। তবে কীভাবে চলবে এই লড়াই? আত্মসমর্পণই কি আমাদের ভবিষ্যৎ?

এই ঘটনার দু-একদিনের মধ্যেই নন্দীগ্রামের বেশিরভাগ এলাকা দখল করে নিল সিপিআইএম। প্রায় বিনা বাধায়। ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির যোদ্ধাদের কাছে গুলি প্রায় শেষ। সবাই পিছু হঠতে শুরু করল বাধ্য হয়ে, কিচ্ছু করার নেই। কোনও প্রতিরোধ করা গেল না।  ৮ তারিখ দুপুরে খবর পেলাম মহেশপুরে হাইস্কুলের কাছে পৌঁছে গেছে হার্মাদ বাহিনী। প্রায় একশোজন সশস্ত্র বহিরাগত খেজুরি, সাতেঙ্গাবাড়ি দিয়ে মহেশপুরে ঢুকে পড়েছে। তার মানে তখন গড়চক্রবেড়িয়া, সোনাচূড়ায় ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির কব্জায় থাকা শেষ এলাকা। পরিস্থিতি যেমন দ্রুত পাল্টাচ্ছে তার পতনও স্রেফ সময়ের অপেক্ষা। সেদিন বিকেলে সোনাচূড়া ছাড়লাম। মোটরসাইকেলে চেপে। সবুজ বাড়িতে থেকে গেল। বাবা, মা আর ওঁকে সাবধানে থাকতে বলে সোজা চলে গেলাম নন্দীগ্রাম বাজারের কংগ্রেস পার্টি অফিসে। সেখানেই থাকলাম রাতটা। রাতে পার্টি অফিস থেকে আবার ফোন করেছিলাম আদিত্যদাকে। আদিত্যদা বলল, বৌদি, আর ছেলে, মেয়েকে  বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছে। ওঁর বাড়ি আক্রমণ হতে পারে। সেই জানুয়ারি থেকেই আদিত্যদা এবং আরও হাতেগোনা  ৪-৫ জন ছিল সিপিআইএমের এক নম্বর টার্গেট।

৯ তারিখ সকালে তমলুকের জেলা শাসকের সর্বদলীয় মিটিং নন্দীগ্রাম নিয়ে। নন্দীগ্রামে শান্তি ফেরাতে জেলা শাসক মিটিং ডেকেছেন। কংগ্রেস পার্টি অফিস থেকই সকালে তমলুকে গেলাম মিটিংয়ে যোগ দিতে। জেলা শাসক বললেন, নন্দীগ্রামে শান্তি ফেরাতে হবে। সব পক্ষেকে বললেন, আক্রমণ, পালটা আক্রমণ বন্ধ করতে। আমি বললাম, আমরা তো শান্তিই চাই। কিন্তু সিপিআইএম তো বহিরাগত নিয়ে  লাগাতার আক্রমণ চালাচ্ছে। এলাকায় সশস্ত্র মিছিল করছে, চোখ বুজে বসে আছে পুলিশ। সিপিআইএমের নেতা অশোক গুড়িয়া অস্বীকার করলেন। বললেন, তাঁদের ঘরছাড়ারা বাড়ি ফিরেছে। মিটিংয়ে কিছুই রেজাল্ট হল না। মিটিং শেষ করে বিকেল নাগাদ নন্দীগ্রাম ফিরছি, খবর পেলাম আমগেছিয়া, গোকুলনগর নানা জায়গায় যুদ্ধ চলছে পুরোদমে। ঠিক করলাম বাড়ি ফিরব, যা হয় হবে। নন্দীগ্রাম বাজারে পৌঁছে দেখি মারাত্মক অবস্থা। বাজার, বাস স্ট্যান্ডে হাজার হাজার লোকের জমায়েত। সবার চোখে মুখে আতঙ্ক। বিভিন্ন জায়গা থেকে কয়েক হাজার  মানুষ সিপিআইএম বাহিনীর আক্রমণে বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছে। বেশিরভাগই মহিলা, বাচ্চা। কিছু একদম বয়স্ক পুরুষ, মহিলাকে বাড়িতে রেখে সবাই ঘর ছেড়ে এসেছে সবাই এক কাপড়ে। সবার এক অভিযোগ, হার্মাদরা বাড়ি বাড়ি ঢুকে অত্যাচার করছে। এতগুলো লোক থাকবে কোথায়, খাবে কী, কিচ্ছু ঠিক নেই। নন্দীগ্রাম বাজারেই তৃণমূল কংগ্রেসের সুফিয়ান, তাহেররা ছিল। ওদের সঙ্গে কথা বললাম। বাজারেই বিএমকে হাইস্কুল। সবাই আলোচনা করে ঠিক হল, বিএমকে হাইস্কুলে ক্যাম্প করা হবে। মহিলা, বাচ্চাদের আগে ঢোকানো হল। বড়ো স্কুল। এক একটা ক্লাস রুমে ৩০-৪০ জন গাদাগাদি করে এঁটে গেল। সন্ধে নাগাদ উনুন বানিয়ে ভাত, ডাল রান্না শুরু হল। বিএমকে হাইস্কুলের এই ক্যাম্প বহুদিন চলেছিল। তার পরেরদিন আরও হাজার হাজার মানুষ নানা জায়গা থেকে হার্মাদ বাহিনীর আক্রমণে ঘরছাড়ারা হয়ে এই ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছিল। ৯ তারিখ রাতেও বাড়ি ফিরতে পারিনি। পরদিন ১০ নভেম্বর, আমার এবং হাজার হাজার নন্দীগ্রামবাসীর জীবনে ভয়ঙ্কর দিন। তার একটা আভাস ৯ তারিখ রাতেই পেয়েছিলাম।

৯ তারিখ রাত সাড়ে ন’টা নাগাদ ফোন করলাম আদিত্যদাকে। কী অবস্থা তার খোঁজখবর নিতে। সন্ধে সাড়ে সাতটা-আটটা থেকে এক নাগাড়ে চেষ্টা করছি, কিছুতেই আদিত্যদার মোবাইল ফোনে লাইন পাচ্ছিলাম না। নন্দীগ্রামে কিছু জায়গায় ফোনের সমস্যা হোত। বাধ্য হয়ে আদিত্যদার বাড়ির ল্যান্ড লাইনে ফোন করলাম। ২-৩ বার টানা বেজে ফোন থেমে গেল। আবার চেষ্টা করলাম। কিছুক্ষণ পর একজন ফোন ধরল, গলাটা অচেনা। আদিত্যদাকে চাইলাম। বলল, এটা আদিত্য বেরার বাড়ি না। ভাবলাম, ভুল নম্বর ডায়াল করেছি। আবার ফোন করলাম। সেই লোকটাই ফের ফোন ধরে একই কথা বলল, এটা আদিত্য বেরার বাড়ি না। কেটে দিল ফোন। তখনও কিছু বুঝতে পারিনি। তারপর রাত সাড়ে ন’টা নাগাদ আদিত্যদাকে মোবাইল ফোনে পেলাম।

‘দাদা কী অবস্থা? সাবধানে থাকবেন। চারিদিকে পরিস্থিতি খুব খারাপ।’

‘দেখো ভাই, যা হবার হবে। আমি কমান্ডার, কাউকে ভয় পাই না। আমি সামনের সারিতে থেকে লড়াই করি। সাবধানে কি আর থাকা যায়, এই অবস্থায়? আমি সাউদখালিতে আছি, কাউকে বোলও না।’

 

‘আপনাকে অনেকক্ষণ থেকে ফোনে চেষ্টা করছি। বাড়িতে টানা ফোন বেজ গেল, তারপর একজন ধরে বলল, ওইটা আপনার বাড়ি না। ‘

‘কী বলছ? কখন?’

‘এই তো আধা ঘন্টা, কুড়ি মিনিট আগে হবে।’

‘সর্বনাশ হয়ে গেছে। আমি তো সকালে বাড়ি বাইরে থেকে তালা মেরে বেরিয়েছি। তার মানে আমার বাড়ি দখল করে নিয়েছে হার্মাদরা। দু’তিনদিন ধরেই আমার বাড়ি টার্গেট করছিল। ঠিকই করেছিলাম, যুদ্ধ শেষ না হলে আর বাড়ি ফিরব না। যাক গিয়ে, কাল দেখা যাবে। এই লড়াই আমরাই জিতব, এত লোক আছে আমাদের সঙ্গে।’

‘আপনি ঠিক আছেন তো? যা করবেন, সাবধানে।’

‘এমনি ঠিক আছি, কিন্তু খুব ক্লান্ত। ৩-৪ রাত ঘুম নেই। শরীর আর চলছে না। তুমি আমার একটা কাজ করে দিতে পার? আমার ফোনে ব্যালেন্স নেই একদম। ১০০ টাকা রিচার্জ করে দেবে?’

‘হ্যাঁ, এখনই করে দিচ্ছি।’

এরপর আমি নন্দীগ্রাম বাজারের একটা দোকান থেকে আদিত্যদার মোবাইল ফোনে ১০০ টাকা রিচার্জ করে দিলাম। সেটাই আদিত্য বেরার সঙ্গে আমার শেষ কথা।

৯ তারিখ রাতেও থাকলাম নন্দীগ্রাম বাজারের পার্টি অফিসে। পরদিন একদম সকালে ফোনে কথা হল সবুজের সঙ্গে। সোনাচূড়া বাদ দিয়ে তখন গোটা নন্দীগ্রামে মোটরসাইকেলে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে হার্মাদারা। আরও দু’একজনের সঙ্গে কথা হল, সবার এক কথা। ভুমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির নেতা, যোদ্ধা, সবাই কোণঠাসা হয়ে সোনাচূড়ায় জড়ো হয়েছে। বাকি নন্দীগ্রাম সিপিআইএমের বহিরাগতদের দখলে। ৯ তারিখ বিকেল থেকেই খেজুরি দিয়ে সিপিআইএমের শয়ে শয়ে লোক ঢুকে গেছে। বেশিরভাগ আশ্রয় নিয়েছে মহেশপুর হাইস্কুলে। সেখানে শিবির করেছে সশস্ত্র সিপিআইএম বাহিনীও। যে কোনও সময়ে সোনাচূড়া আক্রমণ করবে। সোনাচূড়ায় আমাদের লোকজন সব আগের রাত থেকে জাগা। জানতাম না, সবুজই আমাকে বলল, ও, নিশিকান্ত মন্ডল, নারায়ণরা সব রাত থেকে বসে প্ল্যান করেছে, গ্রামবাসীদের সঙ্গে নিয়ে মিছিল করে মহেশপুরে যাবে। বাঁচার এটাই শেষ রাস্তা। কিছুক্ষণ বাদেই মিছিল শুরু হবে। লোকজন সব আস্তে আস্তে জড়ো হতে শুরু করেছে সোনাচূড়া বাজারে। তখন সকাল সাড়ে সাতটা-আটটা হবে। আমি প্রথমে বুঝতে পারিনি ব্যাপারটা কী? এ তো আত্মহত্যার শামিল। সবুজ বলল, “এছাড়া আর কিছু করার নেই। কাল জেলা শাসকের মিটিংয়ে তো আলোচনা হয়েছে, কেউ আক্রমণ পালটা আক্রমণ করবে না। তাই সবাই মিলে মিছিল করে গিয়ে আত্মসমর্পণ করবে মহেশপুরে।” আমি বললাম ওই মিটিংয়ের কথা বিশ্বাস না করতে। এমন কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি। মিটিং ফলপ্রসূ হয়নি, একতরফা হয়েছে। তাছাড়া সিপিআইএমের কথায় কোনও বিশ্বাস নেই। হার্মাদরা বন্দুক নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিন্তু সবুজ, নিশিকান্তদা, নারায়ণরা মানল না। মিছিল করবেই বলে জেদ ধরে আছে।

আমি ভাবছি কী করব, সোনাচূড়ার দিকে যাব কিনা। তারপর ভাবলাম, একটু দেখি কী পরিস্থিতি দাঁড়ায়। কিছুক্ষণ বাদেই খবর পেলাম, ন’টা নাগাদ মিছিল শুরু হয়েছে কয়েক হাজার মানুষের। সব যাচ্ছে মহেশপুর হাইস্কুলের দিকে। তারপর এক দেড় ঘণ্টা কোনও খবর নেই। সাড়ে দশটা নাগাদ কেউ একজন ভয়ঙ্কর খবর দিল, মহেশপুর হাইস্কুল থেকে সিপিআইএম গুলি চালিয়েছে মিছিলে। কম করে ২৫-৩০ জন গুলিবিদ্ধ হয়েছে। পুরো মিছিল ছত্রভঙ্গ হয়ে গেছে। যে যেখানে পেরেছে পালিয়েছে। পাগলের মতো একে ওকে ফোন করছি, কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না। বুঝতে পারছি না কী করব। মূহুর্তের মধ্যে এই খবর ছড়িয়ে পড়ল নন্দীগ্রাম বাজার, বিএমকে হাইস্কুলের ক্যাম্পে। সবাই এদিক ওদিকে ছোটাছুটি  আরম্ভ করল। ঘন্টাখানেক বাদে আরও ভয়ঙ্কর খবর এল, প্রায় ৪০০-৫০০ জনকে হার্মাদরা খেজুরির দিকে  ধরে নিয়ে গেছে। কে বেঁচে আছে, কে মরেছে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। আমি নন্দীগ্রাম থানার সামনে চলে গেলাম। সেখানে ভিড় বাড়তে শুরু করেছে। গিয়ে দেখি তৃণমূল কংগ্রেসের সুফিয়ান, তাহের এবং আরও কয়েকজন নেতাও সেখানে উত্তেজিতভাবে দৌড়াদৌড়ি করছে। কেউই বুঝতে পারছে না কী করা উচিত। আমি বারবার সবুজকে ফোন করছি, কিন্তু পাচ্ছি না। আরও আধ ঘণ্টা কাটল এভাবে টেনশনে। নানারকম খবর আসছে মহেশপুর থেকে। রাস্তায়, মাঠে চারদিকে গুলিবিদ্ধ লোকজন পড়ে আছে। ভাবলাম যা হয় হবে। সাড়ে ১১টা-১২ টা নাগাদ মোটরসাইকেল নিয়ে রওনা দিলাম সোনাচূড়ার দিকে। প্রায় গড়চক্রবেড়িয়ার কাছাকাছি পৌঁছেছি, সবুজের ফোন। ওকে বললাম, সোনাচূড়া যাচ্ছি, কাছাকাছি পৌঁছে গেছি। ও বলল, ‘এদিকে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি। আমাদের মিছিল কাছাকাছি পৌঁছাতেই মহেশপুর হাইস্কুলের ছাদ থেকে সিপিআইএম এলোপাথাড়ি গুলি চালাতে শুরু করে। অনেকের গুলি লেগেছে। আমি পুকুরে ঝাঁপ দিই। তারপর ডুব সাঁতার দিয়ে অনেকটা গিয়ে কোনওভাবে বেঁচেছি। সোনাচূড়া যাওয়ার দরকার নেই। আমি পালাচ্ছি, তুমিও পালাও।’ সবুজের কথা শুনে গড়চক্রবেড়িয়া থেকে মোটরসাইকেল ঘুরিয়ে নিয়ে আবার ফিরে গেলাম থানার কাছে। তখনও আমাদের ধারণা ছিল, এত কিছু ঘটে গিয়েছে, পুলিশ একটা কিছু নিশ্চয়ই করবে। কিন্তু ভুল ভেবেছিলাম। ততক্ষণে কয়েক হাজার লোক জড়ো হয়ে গেছে থানার সামনে। আশ্রয় চেয়ে। সবারই ধারণা ছিল, পুলিশ তাদের বাঁচাবে। কিন্তু থানার সামনে গিয়ে দেখি, বাইরের বড়ো লোহার গেট ভেতর থেকে বন্ধ। কয়েক হাজার মানুষ হার্মাদদের হাত থেকে বাঁচতে পুলিশ ডাকতে গেছিল থানায়। পুলিশ তো বেরোয়ইনি। ভেতর থেকে লোহার গেট বন্ধ করে রেখেছিল, যাতে কেউ ঢুকতে না পারে।

বাড়িতে ফোন করলাম, ল্যান্ড ফোনে। বাবাকে বললাম, ঘরে থাকার দরকার নেই, মাকে নিয়ে বাড়ির পেছনে বাঁশ বনে লুকিয়ে থাকতে। কখন সিপিআইএম বাহিনী বাড়ি আক্রমণ করে ঠিক নেই। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হচ্ছে। খবর পেলাম, সকালে মহেশপুর থেকে সিপিআইএম বাহিনী যাদের ধরে খেজুরিতে নিয়ে গেছিল, তার মধ্যে প্রায় ১০০ জনকে ছেড়ে দিয়েছে। বাকিদের আটকে রেখেছে। তাদের কী হবে কেউ জানে না। হঠাৎ কোথা থেকে রটে গেল হার্মাদরা মহেশপুর থেকে নন্দীগ্রাম বাজারের দিকে আসছে মোটরসাকেলে চেপে। আমগেছিয়া পর্যন্ত চলে এসেছে। থানার সামনে তখন চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলা। সোনাচূড়া, গড়চক্রবেড়িয়া, আমগেছিয়া, গোকুলনগরের হাজার হাজার মানুষ ঘর ছেড়ে জড়ো হতে শুরু করল নন্দীগ্রাম থানা, বাজার চত্বরে। কারও কোনও নিরাপত্তা নেই। পুলিশ লোহার গেট বন্ধ করে থানার ভেতরে বসে আছে। আমি কলকাতায় কংগ্রেস নেতাদের ফোন করেছি, সবাই বলছে দেখছি। থানার সামনে সুফিয়ান, তাহেররাও ছিল। ওঁরা তৃণমূল কংগ্রেসের নেতাদের পাগলের মতো ফোন করছে। বুঝে গেলাম, এরপর নন্দীগ্রামে থেকে গেলে বিপদে পড়ে যাব, তার থেকে পালানোই ভাল। আমার সঙ্গে কংগ্রেসের একটা ছেলে ছিল, চন্দন পাল। ওকে বললাম, চল। আর নন্দীগ্রামে থাকা ঠিক হবে না। আমার মোটরসাইকেলের পিছনে ওকে বসিয়ে সোজা রওনা দিলাম তেরাপেখিয়া নদী ঘাটের দিকে। আর কিছু করার নেই। সব রাস্তায় সিপিআইএমের ব্যারিকেড হয়ে গেছে। তেরাপেখিয়া ঘাটে গিয়ে মোটরসাইকেল নিয়েই দুজনে নৌকায় চেপে নদী পেরোলাম। উঠলাম গিয়ে কাপাসএড়িয়া। তারপর গ্রামের ভেতরের রাস্তা দিয়ে মোটরসাইকেল চালিয়ে গেলাম মহিষাদল। প্রায় সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ মহিষাদলে একটা বড়ো চায়ের দোকানে গিয়ে বসলাম। দীর্ঘক্ষণ কিছু খাওয়া হয়নি। দোকানে টেলিভিশন চলছিল, খবর হচ্ছিল। সেখানেই খবর দেখলাম, মহেশপুর সংঘর্ষে মৃত ২। তারপর দেখলাম, মিলন প্রধানের বাড়ি ভাঙচুর, বাবা অপহৃত।

আকাশ ভেঙে পড়ল মাথায়। বাবা অপহৃত! বাবাকে নিয়ে গিয়ে কী করল সিপিআইএমের হার্মাদ বাহিনী? বাড়িতে ফোন করলাম, বেজে গেল।

এদিকে খবরে দেখাচ্ছে মহেশপুরে দুজনের মৃত্যু হয়েছে। শেখ রেজাউল এবং শ্যামলী মান্না। কিন্তু দুপুরে সবুজ বলেছিল, অন্তত ২৫-৩০ জন গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর জখম হয়েছে। তাদের মাঠে, রাস্তায় ফেলে যে যার মতো বাঁচতে পালিয়েছে। ওদিকে বাবারও খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। ফোন করলাম কলকাতার সোমেনদাকে (প্রদেশ কংগ্রেস নেতা সোমেন মিত্র)। বললাম, সারাদিন কী কাণ্ড ঘটেছে নন্দীগ্রামে। আমরা দুই ভাই পালিয়েছি। বাবাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সোমেনদা উদ্যোগ নেন, সম্ভবত লক্ষ্মণ শেঠকে ফোন করে আমার বাবার কথা বলেছিলেন। রাত সাড়ে ন’টা নাগাদ বাবাকে ছেড়ে দেয় সিপিআইএম। পরে শুনেছিলাম, বাবা বাড়ির পেছনে বাঁশবনে মাকে নিয়ে দুপুর থেকে লুকিয়েছিল। বিকেলে হার্মাদরা বাড়িতে আসে, তল্লাশি করে কাউকে না পেয়ে ভাঙচুর করে। তারপর বাঁশবন থেকে বাবাকে  ঘাড় ধরে বের করে নিয়ে যায়। আরও অনেকেই, যারা বাড়িতে ছিল, তাদেরও মারধর করে বাড়ি থেকে নিয়ে যায় হার্মাদরা। তারপর সবার হাতে লাল পতাকা ধরিয়ে মিছিল করিয়েছিল। যারা কোনও দিন সিপিআইএম করেনি তাদের অনেকেই লাল ফ্ল্যাগ নিয়ে মিছিল করতে বাধ্য হয়। কেউ কেউ মারধরের হাত থেকে বাঁচতে নিজেরাই বাড়ির সামনে লাল ফ্ল্যাগ লাগিয়ে দেয়। (আমি নিজে এমনই একটা সিপিআইএমের ফ্ল্যাগ হাতে মিছিল দেখেছিলাম ১২ নভেম্বর, ক্লান্ত, বিধ্বস্ত ১০০-১৫০ লোকের। সোনাচূড়া থেকে ভাঙাবেড়া ব্রিজ পর্যন্ত)।

রাত ন’টা নাগাদ মহিষাদল থেকে বেরিয়ে আবার মোটর সাইকেল চালিয়ে গেলাম তমলুকে। সেখানেও মোড়ে মোড়ে জটলা। চারদিকে শুধু নন্দীগ্রাম নিয়ে আলোচনা। গোটা জেলা যেন ফুটছে। রাতে থাকলাম তমলুকে কংগ্রেসের পার্টি অফিসে। দুদিন পরে নন্দীগ্রামে সিআরপিএফ ঢুকেছিল, তারপর ফিরেছিলাম সেখানে। ফেরার পরেও দীর্ঘদিন ছিল হাড়হিম করা সন্ত্রস্ত পরিবেশ। সিপিআইএম বাহিনীর বাড়ি বাড়ি গিয়ে অত্যাচার। পরে শুনেছিলাম, ১০ তারিখ মহেশপুর হাইস্কুলের ছাদ থেকে হার্মাদরা গুলি চালানোর কয়েক মিনিটের মধ্যেই পুরো মিছিল ছত্রভঙ্গ হয়ে যয়। যারা পারে পালিয়ে যায় কোনওভাবে। মহিলা, বাচ্চা, বয়স্ক অনেকেই পালাতে পারেনি। এমন প্রায় ৪০০ জনকে ওরা ধরে নিয়ে যায় খেজুরিতে। পিঠমোড়া করে বেঁধে খেজুরিতে তাদের বসিয়ে রেখেছিল সিপিআইএমের লোকজন। দু’তিন ঘন্টা বাদে প্রায় ১০০ জনকে ছাড়ে। তারপর ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির এক নেতাকে সিপিআইএমের এক হার্মাদ ফোন করে হুমকি দেয়, বলে অস্ত্রশস্ত্র ফেলে পালাতে। বলে, তোদের লোক বন্দি হয়ে গেছে। তাদের সামনে রেখে মিছিল করিয়ে সিপিআইএম বাহিনী সোনাচূড়া ঢুকবে। দুপুরের পর ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির সমস্ত নেতাই পালিয়ে যায় নন্দীগ্রাম ছেড়ে। অনেকে বাজারের কাছে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল। সেদিনই বিকেলে গৌরাঙ্গ এবং সুকুমার ১০-১২ জন সঙ্গীকে সঙ্গে নিয়ে তেরাপেখিয়া ঘাট দিয়ে নৌকা করে নন্দীগ্রাম ছেড়েছিল। বিকেলের মধ্যেই আটক বাকি ৩০০ জনকে এক লাইনে দাঁড় করিয়ে মিছিল করে তাদের পেছনে পেছনে সোনাচূড়া ঢোকে হার্মাদরা। তারপর শুরু হয় বাড়ি বাড়ি অত্যাচার। আমার বাবা এবং আরও কয়েক’শো বয়স্ক লোককে বাড়ি থেকে বের করে মিছিলে হাঁটায়।’

কিন্তু মহেশপুরে অনেকে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন, সবুজ প্রধানও তো আপনাকে তেমনই বলেছিলেন, তাঁদের কী হল? মৃতদেহ তো পাওয়া গেল মাত্র দু’জনের। জিজ্ঞেস করেছিলাম মিলন প্রধানকে।

‘মৃতদেহ ভ্যানে তুলে খেজুরিতে নিয়ে গিয়েছিল সিপিআইএমের লোকজন। অনেকে দেখেছে। পরে শুনেছিলাম, তাঁদের দেহ বস্তায় মুড়ে তাতে পাথর ভরে হলদি নদীতে ফেলে দিয়েছিল হার্মাদরা। এর মধ্যে আদিত্য বেরাও ছিল। আদিত্যদাকে তরোয়াল দিয়ে কেটে কয়েক টুকরো করেছিল। এমন ন’জন এত বছর পর পর্যন্ত নিখোঁজ। তাঁদের হদিশ আজও পাওয়া যায়নি।’ বলেছিলেন মিলন প্রধান।

এই অভিযোগ তারপরেও বহুবার করেছে নন্দীগ্রামের বাসিন্দারা। ১০ নভেম্বর মহেশপুরে ন’জনকে খুন করে মৃতদেহ  লোপাট এবং এই ষড়যন্ত্রের অভিযোগ এনে তৎকালীন সাংসদ লক্ষ্মণ শেঠ সহ একাধিক সিপিআইএম নেতা, কর্মীর বিরুদ্ধে পুলিশের দ্বারস্থ হয়েছিল তাদের পরিবারের লোকজন। পরে ২০১১ সালে সরকার পরিবর্তনের পর এই মামলায় লক্ষ্মণ শেঠ এবং পূর্ব মেদিনীপুর জেলার কয়েকজন সিপিআইএম নেতাকে পুলিশ গ্রেফতার করে। কয়েক মাস জেলে কাটিয়ে তাঁরা জামিনও পেয়ে যান, কিন্তু নন্দীগ্রামের সোনাচূড়া, গোকুলনগরের, বাসিন্দা ওই ন’জন আর ফিরে আসেনি। নন্দীগ্রামবাসীর হিসেবে তাঁরা হলেন, আদিত্য বেরা, নারায়ণ চন্দ্র দাস, সুবল মাঝি, কাজল মন্ডল, বাবু দাস, অর্ধেন্দু দাস অধিকারী, বলরাম সিংহ, ভগীরথ মাইতি, সত্যেন গোল।

আদিত্য বেরা ৯ নভেম্বর রাতে বলেছিলেন, সিপিআইএমের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তাঁরা জিতবেন। দেখে যাননি, কিন্তু সশস্ত্র লড়াইয়ে হেরেও, ছ’মাস বাদে পঞ্চায়েত ভোটের গণতান্ত্রিক লড়াইয়ে নন্দীগ্রামই জিতেছিল।

পড়ুন আগের পর্ব: নন্দীগ্রাম আসলে যা ঘটেছিল #১৭: মমতা ব্যানার্জিকে বললাম, এখন আসবেন না, সিপিআইএম পুরো দখল করে নিয়েছে

 

নভেম্বর যুদ্ধঃ সিপিআইএমের কফিনে প্রথম পেরেক

১০ নভেম্বর ২০০৭, সিপিআইএমের ‘অপারেশন সূর্যোদয়ে’র পর নন্দীগ্রামের আন্দোলন নৈতিক সমর্থন পেয়ে গিয়েছিল গোটা রাজ্যের মানুষের। নভেম্বরে সিপিআইএমের সশস্ত্র অভিযানের বিরুদ্ধে রাজ্যজুড়ে যে প্রবল জনমত গড়ে ওঠেছিল, তার মোকাবিলা করার মতো অস্ত্র রাজ্য পার্টির তো বটেই, বৃহত্তর বাম পরিবারের হাতেও ছিল না। ৪-৫ থেকে ১০ নভেম্বর পর্যন্ত নন্দীগ্রামে অপারেশন সূর্যোদয়কে অনুমোদন বা সমর্থন করা তো দূরের কথা, এই ঘটনার পর সিপিআইএমের পাশে থাকার ন্যূনতম যৌক্তিকতা খুঁজে পাননি রাজ্যের লক্ষ-লক্ষ বামপন্থী মানুষজন। অথচ সাতের দশকের গোড়া থেকে এই লক্ষ-লক্ষ বামমনোভাবাপন্ন মানুষই ছিলেন সিপিআইএমের প্রাণভোমরা। সরাসরি পার্টি না করলেও এই বৃহত্তর বাম পরিবার বারবারই নানান ইস্যুতে পাশে দাঁড়িয়েছে সিপিআইএমের। কোনও প্রত্যক্ষ প্রত্যশা না থাকা এই লক্ষ-লক্ষ মানুষের অনুচ্চারিত সমর্থনের শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে বারবার রাজ্যে শাসন ক্ষমতা ভোগ করেছে  সিপিআইএমের নেতৃত্বে বামেরা। সেই বিরাট শক্তিতেই ধস নামল হুহু করে। চোরাবালিতে আটকালে, যেভাবে পা থেকে বালি সরে যাচ্ছে বোঝা গেলেও কিছুই করার থাকে না, নভেম্বরে নন্দীগ্রাম দখল সম্পূর্ণ হওয়ার পর অনেকটা সেই রকমই সিপিআইএমের থেকে দ্রুত সরে যেতে শুরু করল প্রত্যক্ষভাবে দল না করা বামপন্থীদের সমর্থন। যা খানিকটা বুঝলেও কিছুই করার ছিল না বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, বিমান বসুদের। নভেম্বরে নন্দীগ্রাম পুনরুদ্ধারের জয়ের আনন্দের মধ্যেই লুকিয়ে ছিল সিপিআইএমের গোটা রাজ্যে পরাজয়ের উপাদান।

 

অর্থই অনর্থ এবং নিশিকান্ত মন্ডল

 

সরকারি-বেসরকারি হিসেবে ১১ মাসে নন্দীগ্রামে গুলি চলেছে কয়েক হাজার রাউন্ড। বোমার হিসেব কেউ জানে না। মৃত্যু হয়েছে কম-বেশি ১০০ মানুষের। অনেক মৃতদেহ খুঁজেই পাওয়া যায়নি। ৩ জানুয়ারি ২০০৭ যে লড়াই শুরু হয়েছিল, তাতে সাময়িক বিরতি পড়েছিল ১০ নভেম্বরে সিপিআইএম এলাকা দখল নেওয়ার পর। ২০০৮ পঞ্চায়েত ভোট পর্যন্ত নন্দীগ্রামে কার্যত একাধিপত্য ছিল সিপিআইএমের। তখন তৃণমূল কংগ্রেস এবং বিরোধীরা নন্দীগ্রামে অনেকটাই ব্যাকফুটে। নন্দীগ্রামে ভুমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির একমাত্র সহায়সম্বল তখন কেন্দ্রীয় আধাসামরিক বাহিনী। ২০০৮ সালের মে মাস থেকেই শুরু হল আবার নতুন লড়াই। প্রকাশ্যে এবং চোরাগোপ্তা খুনোখুনি লেগেই ছিল নন্দীগ্রামে। এরই মধ্যে ২০০৯ সালে লোকসভা নির্বাচনের পর ক্ষমতার ভারসাম্য মোটামুটি হেলে পড়েছে তৃণমূল কংগ্রেসের দিকে, আপাতশান্ত নন্দীগ্রাম। খেজুরিতেও সিপিআইএমের দূর্গের পতন হয়েছে। গোটা জেলায় দোর্দাণ্ডপ্রতাপ তৃণমূল কংগ্রেস বিধানসভা নির্বাচনের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত। পতাকা ধরার লোক খুঁজে পাচ্ছে না তমলুকের নিমতৌড়িতে জেলা সিপিআইএম অফিস সুকুমার সেনগুপ্ত ভবন। এমনই সময় রাজ্যজুড়ে উৎসবের মরসুম শুরু হয় গেছে। দুর্গাপুজো নিয়ে ব্যস্ত গোটা রাজ্য। আবার আচমকা খবরের শিরোনামে উঠে এল নন্দীগ্রাম। ২০০৯ সালের ২২ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় কলকাতায় এসে পৌঁছল এক খবর। খুন হয়েছেন নিশিকান্ত মন্ডল। গড়বেতা, চন্দ্রকোণা বা আরামবাগ, খানাকূলে নয়। ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতা, দক্ষ সংগঠক, চূড়ান্ত প্রভাবশালী নিশিকান্ত মন্ডল ভরসন্ধ্যায় খুন হলেন নিজের হাতের তালুর মতো চেনা সোনাচূড়ায়!

চলবে

 

(১৮ সেপ্টেম্বর থেকে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে নন্দীগ্রাম আসলে যা ঘটেছিল। প্রতি পর্বে লাল রং দিয়ে আগের পর্বের লিঙ্ক দেওয়া থাকছে)

Comments are closed.