নন্দীগ্রাম আসলে যা ঘটেছিল #২৩: ‘সিপিএম সাপোর্ট করছে বলে হাত গুটিয়ে বসে থাকবেন’, প্রণব মুখার্জিকে বললেন মমতা

আগের পর্ব যেখানে শেষ হয়েছিল: ২০০৮ পঞ্চায়েত ভোটের কইয়েকদিন আগে অধিকারীপাড়ায় প্রচারে গেলেন মমতা ব্যানার্জি, সঙ্গে শোভন চট্টোপাধ্যায়। নন্দীগ্রাম পুরো লাল পতাকায় মোড়া………

২০০৮ সালের ২ নভেম্বর পশ্চিম মেদিনীপুরের শালবনিতে জিন্দল গোষ্ঠীর ইস্পাত কারখানার শিলান্যাস হয়। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রামবিলাস পাসোয়ান, মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এই শিলান্যাস করেছিলেন। রামবিলাস পাসোয়ান, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সেই শিলান্যাস অনুষ্ঠান থেকে ফেরার সময়ই তাঁদের কনভয়ে ল্যান্ডমাইন বিস্ফোরণ হয়েছিল, যা থেকে ঝাড়গ্রামের লালগড় আন্দোলনের সূত্রপাত। সেদিন সকাল ৭ টা নাগাদ মেদিনীপুরের হোটেল থেকে বেরিয়ে শালবনি যাচ্ছি। বড়জোড় আধ ঘন্টার রাস্তা। শহর শেষ হতেই মেদিনীপুর-বাঁকুড়া হাইওয়েতে উঠলাম, সঙ্গে সঙ্গে শুরু হল রাস্তার দু’দিকে লাল পতাকার দাপট। জেলা সিপিআইএমের পক্ষ থেকে তৈরি করা লাল শালুর তোরন। আর রাস্তার দু’ধারে মাটিতে ছ’ইঞ্চি অন্তর সারি দিয়ে পোঁতা সিপিআইএমের ফ্ল্যাগ।  দুশো শতাংশ সরকারি এবং জিন্দল গোষ্ঠীর যৌথভাবে আয়োজিত অনুষ্ঠান। কিন্তু রাস্তায় যাওয়ার সময় দেখে মনে হচ্ছিল, সিপিআইএমের সমাবেশে যাচ্ছি। দেশের সবচেয়ে বড়ো ইস্পাত প্রকল্পের শিলান্যাসে যেখানে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হাজির হবেন, সেখানে কেন শাসক দলের পতাকায় মোড়া থাকবে গোটা রাস্তা তার কোনও যুক্তিগ্রাহ্য উত্তর সেদিন পাইনি। পরেও কোনও সিপিআইএম নেতা আমাকে দিতে পারেননি।

আসলে সরকার, প্রশাসন তুচ্ছ, আমিই সর্বশক্তিমান, এটা সাধারণ মানুষকে দেখিয়ে দেওয়ার একটা প্রবণতা বিভিন্ন জেলার সিপিআইএম নেতাদের মধ্যে কাজ করত। কলকাতা থেকে মুখ্যমন্ত্রী এবং রাজ্য নেতারাও জেলায় গিয়ে এসব দেখে কিছুই বলতেন না, কারণ তাঁরাও জানতেন, এই জেলা নেতাদের জেতানো আসনের জোরেই তাঁরা মন্ত্রী বা কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হয়েছেন। কিন্তু ২০০৮ সালের পঞ্চায়েত ভোটের দু’আড়াই সপ্তাহ আগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে নন্দীগ্রামে গিয়ে যে অভিজ্ঞতা আমার হয়েছিল, তাকে নজিরবিহীন বললেও কিছু বলা হয় না। কোনও সভ্য, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় এমন ঘটতে পারে নিজে না দেখলে বিশ্বাসও করতে পারতাম না।

নন্দীগ্রাম বাজার, থানা পেরিয়ে আমরা এগোচ্ছি। চৌরঙ্গি, হাজরাকাটা পার হয়ে গড়চক্রবেড়িয়া ছাড়িয়ে সোজা সোনাচূড়া মোড়। মাথার ওপরে কাঠফাটা রোদ, শুনশান রাস্তা। যেতে যেতে ভাবছি, অনুষ্ঠানটা হবে তো? তৃণমূল কংগ্রেসের একটা মিছিলও নেই। লোকজন যে ট্রেকার, ভ্যানে চেপে মিটিংয়ে আসে, তাও দেখছি না রাস্তায়। বাড়ি থেকে বেরিয়ে কেউ উঁকি মারছে না মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গাড়ির দিকে। সোনাচূড়া থেকে ডান দিকে নেমে গেল চার গাড়ির কনভয়। সোনাচূড়া হাইস্কুল পার হয়েই রাস্তা একদম সরু। একটা গাড়ি কোনওভাবে যেতে পারে। মোরামের রাস্তা দিয়ে খানিকটা এগিয়ে থেমে গেল তৃণমূল নেত্রীর গাড়ি। কোথায় অনুষ্ঠান মঞ্চ, কী ব্যাপার কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। তখন পর্যন্ত একটা সাধারণ মানুষকেও দেখতে পাচ্ছি না। গাড়ি থেকে নামলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সঙ্গে সঙ্গে আমি এবং ভগীরথও নামলাম গাড়ি থেকে। কোথায় অনুষ্ঠান হবে কিছুই বুঝতে পারছেন না, তৃণমূল নেত্রী রাস্তায় দাঁড়িয়ে ফোন করলেন শুভেন্দু অধিকারীকে। এক-দেড় মিনিট কথা হল। বিরক্ত এবং উত্তেজিত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ফোন রাখলেন। আমি পাশে দাঁড়িয়ে আছি। কী হয়েছে কিছু বুঝতে পারছি না। মাটির রাস্তা থেকে মাঠে নামলেন তৃণমূল নেত্রী, পেছনে শোভন চট্টোপাধ্যায়। দেখলাম একশো মিটার দূরে দু’তিনজন পুলিশ অফিসার এবং সামান্য ফোর্স দাঁড়িয়ে আছে। বহুদিন বৃষ্টি হয়নি। পাথরের মত শক্ত মাটি, রোদে  ফাটা। মাথার ওপরে খটখটে রোদ। হাওয়াই চটি পায়ে মাঠের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে শুরু করলেন তৃণমূল নেত্রী। সঙ্গে আমি, হাতে ক্যামেরা নিয়ে ভগীরথ, শোভন চট্টোপাধ্যায় এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সিকিউরিটি অফিসার কুসুম দ্বিবেদি। দুশো মিটার দূরে মাঠে দাঁড়িয়ে ১৫-২০ জন পুলিশ অফিসার ও কর্মী। বেশিরভাগেরই হাতে লাঠি। অফিসারদের মধ্যে রয়েছেন দু’জন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার। একজন এসডিপিও। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সৈয়দ হোসেন মির্জা এবং প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায় এবং এসডিপিও গৌরব শর্মা।

‘সিপিআইএম শুভেন্দুকে ঘেরাও করে রেখেছে। শয়তান কতগুলো। আমি হেঁটে যাব। দেখি কী করে ওরা, অসভ্যতার একটা লিমিট আছে।’ গজরাতে গজরাতে হন হন করে হাঁটার চেষ্টা করছেন তৃণমূল নেত্রী। এতক্ষণে ব্যাপারটা কিছুটা বোঝা গেল। মাঠের মাটি পুরো ফাটা, খরা কবলিত এলাকার মতো। জুতো পরে হাঁটতেই আমাদের অসুবিধা হচ্ছে। ফলে চাইলেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তার স্বাভাবিক গতিতে হাঁটতে পারছে না। একই অবস্থা শোভন চট্টোপাধ্যায়েরও।

মাঠ দিয়ে হেঁটে একশো মিটার মতো এগিয়েছি, হঠাৎ দেখি, কথা নেই বার্তা নেই, আমরা যেদিকে যাচ্ছি সেদিক থেকে ২৫-৩০ জন মহিলা হাতে ঝাঁটা, লাঠি, খুন্তি নিয়ে দৌড়ে আসছে। তাদের পিছনে কিছু পুরুষও। কয়েকজনের হাতে সিপিআইএমের পতাকা। প্রথমে বুঝতেই পারিনি তারা কেন দৌড়ে আসছে, কী চায়? মাঠের মধ্যে থমকে দাঁড়ালেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এবং সঙ্গে আমরাও। মহিলাদের মুখে তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রীকে উদ্দেশ্য করে অশ্রাব্য গালিগালাজ। আমাদের সঙ্গে ওই মহিলাদের ফারাক তখন মাত্র ৫০ ফুটের। কয়েকজন ঝাঁটা নিয়ে তেড়ে এল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে মারতে। পিছনের পুরুষরা কুৎসিত অঙ্গভঙ্গি করছে। ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি। আমাদের ধারণারও বাইরে, এমন পরিস্থিতি হতে পারে। বহু যুদ্ধের পোড়খাওয়া তৃণমূল নেত্রীও ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে গেছেন। হঠাৎই মাঠ থেকে শুকনো মাটির ঢেলা তুলে ছুড়তে শুরু করল ভিড়ের মধ্যে থেকে কয়েকজন। আমরা যখন তখন জখম হব, এমন অবস্থা। আর সবচেয়ে আশ্চর্যের, আশপাশে দু’তিনজন সিনিয়র অফিসার মিলিয়ে অন্তত ১৫-২০ জন পুলিশ। কেউ আক্রমণকারীদের ঠেকাতে বা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বাঁচাতে এগিয়ে আসছে না।

কেউই বুঝে উঠতে পারছি না কী করা উচিত। এরই মধ্যে কিছু মহিলা গালাগালি দিতে দিতে একদম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাঁচ হাতের মধ্যে ঝাঁটা উঁচিয়ে তেড়ে এল। তাদের মুখে যে অশ্লীল ভাষা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে উদ্দেশ্য করে, তা লেখা সম্ভব নয়। একজন মহিলাকে যে যে কদর্য ভাষায় গালিগালাজ করা যায়, তাই তাদের মুখে। তারই মধ্যে মাথা, শরীর বাঁচিয়ে ভগীরথ কোনওভাবে ছবি তুলছে। আশেপাশে আর কোনও সাংবাদিক নেই, ক্যামেরাম্যানও নেই। সংবাদমাধ্যমের সমস্ত প্রতিনিধি অপেক্ষা করছিলেন অধিকারীপাড়ার অনুষ্ঠান মঞ্চের কাছে। কিন্তু সেখানে পৌঁছনোর আগেই যে খোদ তৃণমূল নেত্রীকে সিপিআইএম আক্রমণ করবে কেউ ভাবতেই পারেননি।

মাথার ওপর দিয়ে মাটির ঢেলা, ইট উড়ে আসছে। আর মহিলা-পুরুষদের মুখে অশ্রাব্য গালিগালাজ। তাদের বক্তব্য, আবার এলাকায় অশান্তি করতে এসেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাই তাঁকে এলাকায় ঢুকতে দেওয়া হবে না। এরই মধ্যে কুসুম দৌড়ে চলে গেল গাড়িতে। গাড়িতে একটা চামড়ার ফাইল ছিল। তাই নিয়ে এসে তৃণমূল নেত্রীর  মাথার কাছে ঢালের মতো করে ধরল। দিশেহারা শোভন চট্টোপাধ্যায় চিৎকার করে বলছেন গাড়ি ঘোরাতে। তাড়াতাড়ি এখান থেকে বেরতে হবে নয়তো বড়ো দুর্ঘটনা ঘটে যাবে। কিন্তু গাড়ি ঘুরবে কীভাবে এই সরু রাস্তায়? অসম্ভব। প্রায় ৪-৫ মিনিট ধরে চলছে সিপিআইএম কর্মী বাহিনীর এই তাণ্ডব। বোঝাই যাচ্ছে পুরো ঘটনাটা পূর্বপরিকল্পিত। একদম সামনে এসে কেউ গায়ে হাত দিচ্ছে না, তাছাড়া যতরকমভাবে হেনস্থা করা সম্ভব করছে। তা সত্ত্বেও কাঠের পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে আছে পুলিশ। বেপরোয়া তৃণমূল নেত্রী বিহ্বলভাব কিছুটা কাটিয়ে পুলিশের উদ্দেশ্যে চিৎকার করলেন, ‘আপনারা কী দেখছেন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে? থামান ওদের।’ কিন্তু কে শোনে কার কথা। দেখে মনে হচ্ছে, মাঠে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশ আমাদের থেকেও বেশি অবাক হয়েছে এই ঘটনায়। অবাক হয়ে দেখছি, সেখানে উপস্থিত অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সৈয়দ মির্জা টানা কারও সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলে চলেছেন। তাকাচ্ছেনই না ঘটনার দিকে। হলদিয়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায় একাই একটু এগনোর চেষ্টা করলেন উত্তেজিত জনতাকে থামাতে। সঙ্গে কয়েকজন কনস্টেবল। কিন্তু এতজন উত্তেজিত, আক্রমণাত্মক সিপিআইএম ক্যাডারকে থামানো তার পক্ষে অসম্ভব। এমনই সময় হঠাৎ ঘটনাস্থলে এসে হাজির হলেন নন্দীগ্রাম থানার ওসি দেবাশিস চক্রবর্তী।  যেদিক থেকে সিপিআইএম ক্যাডাররা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে আক্রমণ করতে ছুটে এসেছে কয়েক মিনিট আগে, সেদিক থেকেই হাঁটতে হাঁটতে এলেন দেবাশিস চক্রবর্তী। এরপর যা ঘটল তা আরও অবিশ্বাস্য!

আক্রমণকারীদের ঠেকানো তো দূরের কথা, ওসি হঠাৎই একটা ছোট হ্যান্ডিক্যাম বের করে গোটা ঘটনার ছবি তুলতে শুরু করলেন। এমন দৃশ্য আমি সাংবাদিক জীবনে কখনও দেখিনি। এমনও ঘটতে পারে আমার সুদূর কল্পনাতেও ছিল না। রাজ্যের বিরোধী নেত্রী, দেশের প্রাক্তন রেলমন্ত্রী, এই সরকার চলে গেলে যাঁর মুখ্যমন্ত্রী হওয়া নিয়ে আসমুদ্র হিমাচলে কারও কোনও সংশয় নেই, তাঁকে মাত্র ২৫-৩০ জন অশ্লীল গালিগালাজ করতে করতে আক্রমণ করেছে। যে কোনও সময় তিনি গুরুতর জখম হতে পারেন। তাঁকে সভা করতে দেওয়া হবে না,  ঢুকতে দেওয়া হবে না, শুধুমাত্র এমন বিচিত্র, অগণতান্ত্রিক দাবি নিয়ে পরিকল্পিত আক্রমণ করছে শাসক দলের কিছু লোক, আর ১৫-২০ জন পুলিশ সিনেমার মতো তা দেখছেন। তার মধ্যে রয়েছেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, এসডিপিও পদমর্যাদার অফিসারও।  জনতাকে নিয়ন্ত্রণ করার অক্ষম চেষ্টা করছেন কয়েকজন পুলিশ। আর থানার ওসি নিজে হ্যান্ডিক্যামে গোটা ঘটনার ছবি তুলছেন। ওসি এবং বাকি পুলিশ অফিসারদের সামনেই সিপিআইএম ক্যাডাররা তৃণমূল নেত্রীর দিকে তেড়ে তেড়ে আসছে। আরও ৪-৫ মিনিট চলল এরকম। পুলিশের প্রত্যক্ষ মদতে শাসক দলের ক্যাডাররা তাঁকে এভাবে অশ্লীল আক্রমণ করতে পারে ভাবতেও পারেননি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনিও তখন বুঝতে পারছেন, কোনওভাবেই অধিকারী পাড়ার অনুষ্ঠানস্থলে তিনি যেতে পারবেন না। মাটির ঢেলা আর ইট লেগে কুসুম দ্বিবেদীর হাতের আঙুল, কব্জিতে একাধিক জায়গায় কেটে রক্ত পড়ছে। আমি, ভগীরথ, শোভন চট্টোপাধ্যায় কীভাবে যে জখম না হয়ে দাঁড়িয়ে আছি তাও পুলিশের ভূমিকার মতোই অবাক করা ব্যাপার। কুসুম তার মধ্যেই বারবার বলছে, ‘ম্যাডাম ফিরে চলুন, আর দাঁড়াবেন না।’ ১২-১৫ মিনিট এই হেনস্থার পর বাধ্য হয়েই পিছু হঠলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আস্তে আস্তে এগোলেন গাড়ির দিকে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ফিরে যাচ্ছেন দেখে ওসি দেবাশিস চক্রবর্তী সিপিআইএম ক্যাডারদের সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা শুরু করলেন। অনেক চেষ্টা করেও ওই সরু মাটির রাস্তায় ততক্ষণে আমাদের গাড়িগুলো ঘোরানো যায়নি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গাড়িতে ওঠার সময় আমাকে বললেন, তাঁর গাড়িতে উঠে পড়তে। আমি আর ভগীরথ উঠলাম তাঁর গাড়িতে। গাড়িগুলো যে দিকে মুখ করে রাখা ছিল, সেদিকেই চলতে শুরু করল আমাদের কনভয়। গাড়িতে উঠেই মোবাইল হাতে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন তৃণমূল নেত্রী। সামনে বাঁদিকের সিটে থমথমে মুখে বসে। আমি তখনও বিশ্বাস করতে পারছি না গোটা ঘটনাটা। অফিসে ফোন করার চেষ্টা করছি খবরটা দেওয়ার জন্য। এই ভিস্যুয়াল আর কারও কাছে নেই। গাড়িতে কেউ কোনও কথা বলছে না। সামনের সিটে বসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মাঝে মধ্যে সিপিআইএমের মুণ্ডপাত করছেন স্বগোতক্তির মতো। আর মোবাইল ফোনে চেষ্টা করছে কাউকে একটা ধরতে। কিন্তু কিছুতেই লাইন পাচ্ছেন না বোঝা যাচ্ছে। তাতে আরও বিরক্ত হচ্ছেন। গ্রামের সরু মাটির রাস্তা দিয়ে বাঁক পেরিয়ে পেরিয়ে চলেছে আমাদের গাড়ি। বেশ কিছুক্ষণ পর পৌঁছলাম তেখালি ব্রিজে। পিচের রাস্তায় উঠে এগোতে থাকলাম নন্দীগ্রাম থানার দিকে। পিচ রাস্তায় উঠে এক চেষ্টাতেই ফোনে লাইন পেয়ে গেলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ফোনের ওপারে তৎকালীন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এবং রাজ্যের জঙ্গিপুর লোকসভা কেন্দ্রের সাংসদ প্রণব মুখোপাধ্যায়। প্রথমে বুঝিনি, কথা শুনে বুঝলাম।

‘কী ভেবেছেটা কী এরা, যা খুশি তাই করবে? নন্দীগ্রামে আমাকে আক্রমণ করেছে। পুলিশের সামনে মেরেছে। চূড়ান্ত অসভ্যতা করেছে। টিভিতে দেখবেন কী হয়েছে একটু আগে নন্দীগ্রামে।’ উত্তেজনায় কাঁপছেন তৃণমূল নেত্রী।

ওপার থেকে কিছু একটা কথায় সামান্য থামলেন, তারপর আবার চিৎকার শুরু করলেন ফোনে, ‘আমি নন্দীগ্রামে আছি। এরপরেও আপনারা কিছু করবেন না? কিছু করবেন না তো নন্দীগ্রাম নিয়ে? সিপিআইএম আপনাদের সাপোর্ট দিয়েছে বলে সেন্ট্রাল গভর্নমেন্ট সব দেখেও হাত গুটিয়ে বসে থাকবে? এতদিন ধরে নন্দীগ্রামে মানুষের ওপর অত্যাচার করেছে। এতগুলো লোককে খুন করল। সেন্ট্রাল গভর্নমেন্ট কোনও অ্যাকশন নেবে না? আপনারা সব সিপিআইএমের সাপোর্টে মন্ত্রী থাকবেন বলে আর কতদিন এভাবে চোখ বন্ধ করে বসে থাকবেন? ‘

পিছনের সিটে বসে বুঝতে পারছি চিৎকার করতে করতে গলার জোর কমে আসছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। গলা  বুজে আসছে কান্নায়। কিন্তু ভাঙবেন, মচকাবেন না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ফের বললেন, ‘ঠিক আছে আপনাদের কিচ্ছু করতে হবে না। যা করার আমিই করব। আমি একাই লড়ব। দেখি সিপিআইএম,  কংগ্রেস, আপনারা সব এক হয়ে কী করতে পারেন?’ তারপর ফোন কেটে দিলেন তৃণমূল নেত্রী। কখনও চোখের সামনে এমন দৃশ্য দেখিনি। গত এক ঘন্টা ঝড় বয়ে গেছে। তারপর কখনও গজরাচ্ছেন, চিৎকার করছেন। কখনও নিশ্চিত পরাজয়ের আশঙ্কায় ভেঙে পড়েছেন, কখনও গলা বুঝে আসছে কান্নায়। আবার পরমূহুর্তেই সিপিআইএম, কংগ্রেস এবং প্রণব মুখোপাধ্যায়ের মতো কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে একাই দেখে নেওয়ার হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন।

নন্দীগ্রাম থানার কাছে রাখা ছিল আমাদের ওবি ভ্যান। সেখানে এসে গাড়ি আস্তে করতে বলে ক্যাসেট দিয়ে দিলাম ওবি ইঞ্জিনিয়ারের হাতে। তারপর রওনা দিলাম কলকাতার দিকে। তার কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের চ্যানেলে খবর দেখে গোটা রাজ্যে চাউর হয়ে গেছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ফের নন্দীগ্রামে আক্রান্ত। অনবরত আমার ফোনো চলেছে, সঙ্গে ভগীরথের তোলা ছবি। গাড়িতে যেতে যেতে আমাদের চ্যানেলে ফোনো দিলেন তৃণমূল নেত্রী। তমলুকের কাছাকাছি পৌঁছতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেল। গাড়িতে যেতে যেতেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বারবার বলছেন, একটু চা খাওয়া দরকার। ঠিক হল, কোলাঘাটে থামব চা খেতে। কোলাঘাটের ড্রাইভ ইন ধাবার কাছাকাছি পৌঁছে দূর থেকে দেখলাম একটা জটলা। ১০-১২ জনের। দূর থেকে ভাবলাম, আবার বোধ হয় কোনও ঝামেলা অপেক্ষা করছে। সামনে পৌঁছে দেখি ওরা তৃণমূলেরই কর্মী। নেতৃত্বে বিপ্লব রায়চৌধুরী। আগে কোলাঘাটের বিধায়ক ছিলেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নন্দীগ্রামে আক্রান্ত হয়ে কলকাতায় ফিরছেন, এই খবর পেয়ে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে আছেন কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে। যদি নেত্রীর গাড়ি থামে, দেখা করবেন। কথা বলবেন।

গাড়ি থামতেই জটলাটা এগিয়ে এল। তৃণমূল নেত্রী গাড়ি থেকে নামলেন। আমরাও সবাই নামলাম। শোভনদা চায়ের অর্ডার দিতে গেল, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এগোলেন বাথরুমের দিকে। দাঁড়িয়ে আছি রাস্তায়। বিপ্লবদা এগিয়ে এলেন। দু-চার  কথার পর জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমরা কি সত্যিই কোনওদিন ক্ষমতায় আসব না? কী বুঝছেন বলুন তো, আপনি তো পুরো রাজ্যে ঘুরে বেরান। এরপরেও আমরা জিততে পারব না?’

২০১১ সালে তৃণমূল রাজ্যে ক্ষমতায় এসেছে। কোলাঘাট থেকে ফের বিধায়ক হয়েছেন বিপ্লব রায়চৌধুরী। বিধানসভায় হাজার বার দেখা হয়েছে। যখনই দেখা হয়েছে, মনে পড়ে গিয়েছে, ২০০৮ সালের ২০ এপ্রিল সন্ধ্যায় কোলাঘাটে রাস্তায় দাঁড়িয়ে করুণ গলায় বিপ্লবদার ওই প্রশ্নটা। ‘আমরা কি সত্যিই কোনওদিন ক্ষমতায় আসব না?’

কোলাঘাটের রাস্তার ধারে প্রায় আধ ঘণ্টা দাঁড়িয়ে, চা খেয়ে, বিপ্লবদা এবং দলের কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে কলকাতার দিকে রওনা দিলেন তৃণমূল নেত্রী। যেতে যেতেই পূর্ব মেদিনীপুরের একাধিক পুলিশ অফিসারের সঙ্গে সেদিন আমার কথা হয়েছিল। পুলিশের বক্তব্য, অধিকারীপাড়ার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের যাওয়ার কিছু আগেই সেখানে পৌঁছন শুভেন্দু অধিকারী। মঞ্চের কাছে রাস্তার দু’ধারে সিপিআইএমের লাল পতাকা পোঁতা ছিল। শুভেন্দু তা উঁপড়ে ফেলেন। তা দেখেই উত্তেজিত হয়ে সিপিআইএম কর্মীরা তাঁকে ঘেরাও করে এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ঢুকতে না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এর পিছনে কোনও পূর্বপরিকল্পনা নেই।

সিপিআইএমের জেলা নেতৃত্বের বক্তব্যও স্বাভাবিকভাবেই পুলিশের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। শুধু দু’একটি বাক্য অতিরিক্ত আছে। আর তা হল, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ঘিরে সাধারণ মানুষের বিক্ষোভ একেবারেই স্বতঃস্ফূর্ত। তৃণমূল নেত্রী নন্দীগ্রামে যাওয়া মানেই নতুন করে অশান্তি সৃষ্টি, তা দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় সেখানকার  মানুষ  বুঝতে পেরেছেন। কিন্তু তৃণমূল কংগ্রেসের রাজনৈতিক মঞ্চের চারপাশের লাল পতাকায়  মুড়ে দেওয়ার কারণ কী, তার কোনও সুদুত্তর নেই সিপিআইএম নেতাদের কাছে। আসলে, বিরোধী রাজনৈতিক দলের কর্মসূচির জায়গায় বা অনুষ্ঠান মঞ্চের চারদিক লাল পতাকায় মুড়ে দেওয়া এরাজ্যে সিপিআইএমের বহুদিনের রাজনৈতিক কৌশল। উদ্দেশ্যে একটাই, নিজের সাংগঠনিক একাধিপত্য জানান দিয়ে বিরোধী দলকে বুঝিয়ে দেওয়া,  সেখানে যে দলই কর্মসূচি পালন করুক না কেন, সেই এলাকার সব মানুষ আসলে সিপিআইএমের সঙ্গে রয়েছে। বিরোধী দল মঞ্চ বাঁধতে পারে, বাইরের নেতারা সেখানে গিয়ে বক্তৃতা করতে পারেন, কিন্তু তাদের পতাকা টাঙানোর লোক নেই। বিরোধী নেতা-নেত্রীদের মানসিকভাবে দুর্বল করে দেওয়ার এও সিপিআইএমের এক কৌশল।

কলকাতা ফেরার পথে সেদিন গাড়িতেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একাধিকবার ফোনে কথা বলেন শুভেন্দুর সঙ্গে। জানিয়ে দেন, দু’দিনের মধ্যেই তিনি ফের নন্দীগ্রাম যাবেন। একই জায়গায় মিছিল করবেন। সেভাবে যেন প্রস্তুতি নেওয়া হয়। দু’ দিন বাদে ফের নন্দীগ্রামে গেলেন তিনি। সেদিনও সঙ্গে গেলাম। অধিকারীপাড়া এবং গোকুলনগরে ৮০০-১০০০ মানুষ নিয়ে মিছিলও করলেন। সঙ্গে ছিলেন শিশির অধিকারী, শুভেন্দু অধিকারী এবং নন্দীগ্রাম তৃণমূল কংগ্রেস নেতারা। সেদিন  অবশ্য সিপিআইএমের কোনও ঝামেলা করেনি। পুলিশও মোতায়েন ছিল প্রচুর। পরিষ্কার বুঝতে পারছিলাম, নক আউট হতে হতেও রিং না ছেড়ে নন্দীগ্রাম নিয়ে পুলিশ এবং সিপিআইএমর ওপর যেভাবে চাপ বাড়াচ্ছেন তৃণমূল নেত্রী, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের প্রশাসন বেশিদিন তার ধকল নিতে পারবে না। সিপিআইএম ভেবেছিল, ওই অশ্লীল হেনস্থা এবং কলতলার থেকেও নোংরা ভাষায় আক্রমণের পর আর বহুদিন নন্দীগ্রামমুখো হবেন না তৃণমূল নেত্রী। কিন্তু পুলিশ এবং সিপিআইএমের সব অঙ্ক গুলিয়ে  দু’দিন বাদেই তাঁর ফের নন্দীগ্রামে যাওয়া দু’পক্ষকে দিশাহারা করে দিয়েছিল। কীভাবে তাঁকে, শুভেন্দু অধিকারীকে নন্দীগ্রামে বাইরে রাখা যাবে তা বুঝে উঠতে পারছিলেন না কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যৌথ ব্যারিকেড গড়ে তোলা পূর্ব মেদিনীপুরের পুলিশ এবং সিপিআইএমের মাথারা। নন্দীগ্রাম নামক বক্সিং রিংয়ে যে লড়াই শুরু হয়েছিল ২০০৭ সালের একদম শুরুতে তাতে কোনও রাউন্ডে সিপিআইএম এগিয়েছে, কোনও রাউন্ডে তৃণমূল কংগ্রেস। দু’পক্ষেরই রক্ত ঝরেছে প্রচুর। দু’ পক্ষই অধিকাংশ সময় লড়েছে নিয়ম কানুনের ন্যূনতম তোয়াক্কা না করেই। কিন্তু পঞ্চায়েত ভোটের ঠিক আগে সিপিআইএমের এই মানসিক চাপ তৈরির কৌশল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চরম অপমান সহ্য করে দাঁতে দাঁত চেপে বারবার সেখানে গিয়ে যেভাবে মোকাবিলা করেছেন, তা শাসকদলের হিসাবের মধ্যে ছিল না। বরং তারা যত এমন করেছে তত নন্দীগ্রামের মানুষের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে। কয়েকদিন বাদেই পঞ্চায়েত ভোটে এর ডিভিডেন্ড সুদে-আসলে পেয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস।

এই রকম এক চরম একদলীয় শাসন ব্যবস্থার মধ্যে দাঁড়িয়ে মে মাসে পঞ্চায়েত ভোটের মুখোমুখি হল নন্দীগ্রাম।

 

প্রাক-নির্বাচন পর্ব

পঞ্চায়েত ভোটের ঠিক সাত দিন আগে নন্দীগ্রামে ধর্ষণের খবর পেয়ে সন্ধ্যায় অফিসে ঠিক হল, যেতে হবে। পরদিন সকালে রওনা দিলে পৌঁছতে দেরি হবে। তাই মাঝরাতেই ক্যামেরাম্যান শ্যামল জানাকে সঙ্গে নিয়ে রওনা দিলাম নন্দীগ্রামের উদ্দেশে। পরদিন একদম ভোর ছ’টা নাগাদ পৌঁছে গেলাম। তার আগে রাতেই তৃণমূল কংগ্রেসের নেতাদের ফোন করে জেনে নিয়েছিলাম ওই আক্রান্ত মহিলার বাড়ির হদিশ। মহেশপুর বাজারের কাছে পৌঁছেছি, অত সকালে সংবাদমাধ্যমের গাড়ি দেখে লোকজন কিছুটা অবাক চোখে দেখছে। মহেশপুর হাইস্কুলের  সামনে একটা চায়ের দোকানে ধোঁয়া উঠছে। বেশ কিছু লোক বসে চা খাচ্ছে। কেউ বা মুড়ি, ঘুগনি।

গাড়ি থেকে নামলাম এবং প্রায় কয়েক মিনিটের মধ্যেই ঘেরাও হয়ে গেলাম শাসক দলের কর্মী বাহিনীর হাতে। কী ব্যাপার, কেন এসেছেন, এত সকালে কী চাই, এমন নানান প্রশ্ন শুরু হল সিপিআইএম স্থানীয় কর্মীদের। কয়েকজন একধাপ এগিয়ে বলল, আপনাদের জন্যই নন্দীগ্রামে যত অশান্তি, বাইরের থেকে এসে এখানে ঝামেলা পাকানোর চেষ্টা করেন। নন্দীগ্রামকে আবার অশান্ত করতে আসবেন না। চলে যান এখান থেকে। আমি তখনও বুঝতে পারছি না, হচ্ছেটা কী? একদম শুরুতে ২০০৭ এর গোড়ায় নন্দীগ্রামের আন্দোলনকারীদের একটা রাগ আমাদের ওপর ছিল ঠিকই, তা কখনও কখনও উগ্র আকারও ধারণ করেছিল, কিন্তু সিপিআইএম তো কখনও আমাদের বাধা দেয়নি। একমাত্র ১৪ মার্চ এবং নভেম্বরে পুলিশের এবং দলীয় অভিযানের সময় ছাড়া। কিন্তু এখন তো কোনও  অভিযানের ব্যাপার নেই। জেলা থেকে রাজ্য সমস্ত স্তরের সিপিআইএম নেতারা বলছেন, নন্দীগ্রামে শান্তি ফিরে এসেছে। মাওবাদী উধাও। মানুষ নাকি বুঝতে পেরেছে, আন্দোলন করে তারা কত বড়ো ভুল করেছিল। তাই যদি সত্যি হবে তবে হঠাৎ কথা নেই বার্তা নেই আমাদের ওপর চড়াও হওয়ার যুক্তিগ্রাহ্য কারণটা কী? এই সব ভাবতে ভাবতেই ফোন করলাম নন্দীগ্রামের সিপিআইএম নেতা অশোক গুড়িয়াকে। ফোনে বেজে গেল। এবার ফোন করলাম অশোক বেরাকে। নন্দীগ্রামের বা পূর্ব মেদিনীপুরের একাধিক সিপিআইএম নেতা আমাকে খুব নির্ভরযোগ্য বন্ধু ভাবতেন এই দাবি করতে পারব না, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই তাঁদের অপরিসীম সাহায্য পেয়েছি। যা না পেলে নন্দীগ্রামের অনেক কিছুই জানতে পারতাম না। অশোক বেরা ফোন ধরলেন একবারেই।

‘কী ব্যাপার বলুন তো, আপনাদের লোকজন এই সাতসকালে আমার ওপর চড়াও হয়েছে কেন?’

‘কেন কেন কী হয়েছে? আপনি কোথায়?’

সংক্ষেপে তাঁকে বললাম সেই মুহূর্তে মহেশপুরের পরিস্থিতি।

‘ঠিক আছে, আমি দেখছি।’

এ কথা বলতে বলতেই দেখছি অশোক গুড়িয়ার মিসড কল। তাঁকে ধরলাম।

‘এত সকালে! কী ব্যাপার?’

‘আমি তো এসেছি নন্দীগ্রামে। এত সকালে আপনাকে আর ফোন করিনি। কিন্তু আপনার দলের লোকেরা আমাকে ঘেরাও করেছে কেন বলুন তো?’

‘সে কী, কোথায়। দাঁড়ান দাঁড়ান, আমি এক্ষুনি দেখছি।’

 

পড়ুন আগের পর্ব: নন্দীগ্রাম আসলে যা ঘটেছিল #২২: থমথমে মুখে শুভেন্দু বেরলেন সুফিয়ানের বাড়ি থেকে, ফের গেলেন বয়ালের মাঠে 

তাদের দলের দুই নেতার সঙ্গে পরপর ফোনে কথা বলতে দেখে সিপিআইএম কর্মীরাও একটু কেমন যেন দিশেহারা হয়ে গেল। বুঝতে পারলাম, সংবাদমাধ্যম নিয়ে তাদের ওপর যে জেনারেল গাইড লাইন আছে তার সঙ্গে ব্যাপারটা খুব একটা মিলছে না। যে কোনও সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিকে দেখলেই সন্দেহ প্রকাশ করা এবং তাঁকে জেরা করা, সেই সময় নন্দীগ্রামের সিপিআইএম কর্মীদের নর্মাল প্র‍্যাকটিস। ‘অপারেশন সূর্যোদয়’ উত্তর নন্দীগ্রাম নামক সাজানো বাগানের ভেতরের খবর বাইরে যাওয়া ঠেকাতেই এই বন্দোবস্ত। নেতৃত্বের এমনই নির্দেশ। বাইরে থেকে দেখলে, গাড়ি করে ঘুরলে মনে হবে, সবই স্বাভাবিক, কোথাও কোনও সমস্যা নেই। কিন্তু সাধারণ মানুষ যেন সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে আলাদা করে বেশি কথা বলতে না পারে। তাহলেই একমাত্র বাইরের জগতে নন্দীগ্রামে শান্তি প্রতিষ্ঠার ভাবমূর্তি অটূট থাকবে। সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলবেন শুধুমাত্র দলের অনুগত কয়েকজন। যাঁদের সবার এক স্বর, ‘এখন কত ভালো আছি, ছেলেটা স্কুলে যাচ্ছে, মেয়ে নিশ্চিন্তে সন্ধেবেলা বাড়ির বাইরে বেরতে পারে। আগে তো জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছিল মাওবাদীরা। খালি জুলুমবাজি, টাকা তোলা আর সন্ত্রাস।’ কেউ কেউ আবার একধাপ এগিয়ে বলতো, ‘আমাদের ভুল বুঝিয়েছিল, শিল্প হলে ভাল হত। ছেলেটা কাজ পেতে।’ নন্দীগ্রামের এমন সাজানো গোছানো দলীয় নিয়ন্ত্রণাধীন শান্তির পরিবেশে স্থানীয় দুই প্রভাবশালী নেতার সঙ্গে আমাকে স্বাভাবিক এবং সহজ গলায় কথা বলতে দেখে তাদের হিসেব কিছুটা গোলমাল হয়ে গেল। তারা তৃণমূল কর্মী হলে তখনই এক কাপ চা, বসার বেঞ্চ জুটে যেত। কিন্তু সিপিআইএমের সন্দেহপ্রবণ মানসিকতা তখনও তাদের বলে চলেছে, ফোন করেছে তো কী হয়েছে। না আঁচালে বিশ্বাস নেই। যদি অন্য কাউকে ফোন করে থাকে। তাই চা, ব্রেঞ্চ জুটল না, তবে ঘেরাও করে চিৎকার করাটা বন্ধ হল। আমিও অপেক্ষা করতে থাকলাম, কখন নেতাদের গাইডলাইন আসে দেখার জন্য। এই সব ক্ষেত্রে যা ঘটে, তা আমার জানা। এমন অভিজ্ঞতা আমার বহু আছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই এক বা দু’জনের কাছে ফোন আসবে। তাঁরা একটু সরে কথা বলে নেবেন নেতার সঙ্গে। তারপর জটলার মধ্যে থেকে কেউ একজন মাতব্বর এগিয়ে এসে বলবেন, ঠিক আছে আপনি যান। আপনার কাজ করুন। কেউ কিছু বলবে না। নিজের চোখে দেখে নিন সব কিছু। তারপর জটলাটাকে উদ্দেশ্য করে বলবেন, অ্যাই তোরা সব যা। নিজের নিজের কাজ কর। ভিড় করিস না, ওনাকে ওনার কাজ করতে দে। এরপরও জটলার মধ্যে থেকে ২-৪ জন সন্দেহজনক ছেলেধরার দিকে তাকানো দৃষ্টিতে দেখবে, তারপর ঘোর অনিচ্ছাসত্ত্বে সরে যাবে। এইসব সাত-পাঁচ ভাবছি। কিন্তু কারও ফোন এল না, তার বদলে আধঘন্টা বাদে এলেন অশোক বেরা নিজে। বেটেখাটো চেহারা। সাদা হাফ শার্ট, ধূসর প্যান্ট পরনে। মহেশপুরে এলেন এক দলীয় কর্মীর মোটরসাইকেলের পিছনে বসে।

‘এত সকালে চলে এসেছেন’, মোটরসাইকেল থেকে নেমে বিনয়ী মুখ করে এগিয়ে এলেন সিপিআইএম নেতা।

‘বিশেষ কিছু না। পঞ্চায়েত ভোটের জন্য দু’দিন বাদে এমনিই আসতাম। কাল বিকেলে কী হয়েছে? তার জন্য রাতেই রওনা দিতে হল।’

‘ধুর কিচ্ছু না। ভোটের জন্য তৃণমূল আবার নানান চক্রান্ত শুরু করেছে।’

চলবে

(১৮ সেপ্টেম্বর থেকে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে নন্দীগ্রাম আসলে যা ঘটেছিল। প্রতি পর্বে লাল রং দিয়ে আগের পর্বের লিঙ্ক দেওয়া থাকছে)

Comments are closed.