নন্দীগ্রাম আসলে যা ঘটেছিল #৬: আমি আর কয়েকজন এক্স-আর্মিম্যান স্থানীয় ছেলেদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করলাম

আগের পর্ব যেখানে শেষ হয়েছিল: ৬ জানুয়ারি মাঝরাতে নন্দীগ্রামের আন্দোলনকারীরা দেখলেন এক অপরিচিত ব্যক্তি তাঁদের হয়ে লড়াই করছেন। তাঁর নাম মধুসূদন মন্ডল, কে তিনি?

 

নন্দীগ্রাম সিংহাসন থেক টেনে নামিয়েছে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে, জর্জরিত করেছে সিপিআইএমকে। সাংসদ করেছে শুভেন্দু অধিকারীকে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মহাকরণ দখলের যাত্রাপথে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় নন্দীগ্রাম। তমলুক থেকে ক্যানিং, কলকাতা থেকে দিল্লি, এমনকী দেশের বাইরেও বহু জায়গায় দিনের পর দিন আলচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল নন্দীগ্রাম। এই সব থেকে হাজার হাত দূরে, জেলে বসে মধুসূদন মন্ডল এখনও মনে করেন, তিনি যা করেছেন ঠিকই করেছেন। আবার সুযোগ আসলে জীবনে, একই কাজ করবেন। কোনও অনুশোচনা নেই এই জেলবন্দি জীবনে। কারণ, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় তিনি জানতেন, জমি চলে যাওয়ার যন্ত্রনা। তাঁর মতে, ‘আমি নন্দীগ্রামের মানুষকে বোঝাতে গিয়েছিলাম, জমি অধিগ্রহণে আমার পরিবারের সর্বনাশ হয়েছে। তোমরা কোনও মূল্যেই জমি দিও না, জমি রক্ষার জন্য লড়াই কর। এটাই গরিব মানুষের একমাত্র এবং শেষ সম্বল। নয়তো তোমাদেরও আমার মতো একই অবস্থা হবে।’ একথা নন্দীগ্রামের লোককে বোঝাতে গিয়ে আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন মধুসূদন মন্ডল। অস্ত্র তুলে নিয়েছিলেন হাতে। নন্দীগ্রাম ১ নম্বর ব্লকের বিরাট এলাকার সাধারণ মানুষ একমাত্র জানেন, তাঁদের আন্দোলনে নারায়ণদার ভূমিকা।

‘আমি প্রথম নন্দীগ্রামে যাই ২০০৭ সালের ১ জানুয়ারি। হলদিয়া থেকে লঞ্চে উঠি। নন্দীগ্রামের কেন্দেমারি ঘাটে গিয়ে নামি। লঞ্চেই আমার এক পরিচিতর সঙ্গে দেখা হয়। তাঁর বাড়ি ছিল খেজুরিতে, কিন্তু আমাদের হলদিয়ায় কাজ করত। আমি অনেকদিন ধরে চিনতাম। তিনি আমাকে লঞ্চেই জিজ্ঞেস করেন, কোথায় যাচ্ছি? বললাম, নন্দীগ্রাম। শুনেছি ওরা জমি রক্ষার আন্দোলন শুরু করেছে। ওই আন্দোলনে আমি ওদের সঙ্গে থাকতে চাই। তিনি আমাকে বলেন, ওই রাতটা ওঁর বাড়িতে থেকে পরদিন নন্দীগ্রামে যেতে। সেই মতো ১ তারিখ রাতে আমি ছিলাম খেজুরিতে ওঁর বাড়িতে। কেন্দেমারি ঘাটে লঞ্চ থেকে নেমে দুজনে ট্রেকারে চেপে খেজুরি চলে যাই। পরদিন, ২ তারিখ প্রথমে বাসে ও পরে ট্রেকারে চেপে তেখালি ব্রিজ পেরিয়ে তেখালি বাজারে গেলাম। প্রথমেই আমার দেখা হয়েছিল যাঁর সঙ্গে, তাঁর নাম আদিত্য বেরা। এক্স-আর্মিম্যান। সে বছর ১০ নভেম্বর সিপিআইএমের লোকজন আদিত্য বেরাকে টুকরো টুকরো করে কেটে খুন করেছিল। দারুণ যোদ্ধা ছিলেন তিনি। আদিত্য বেরা আর আমি অনেক লড়াই করেছি। তেখালি বাজারে ঘোরাঘুরি করছি, দেখা হল আর এক পরিচিত ব্যক্তির সঙ্গে। নাম স্বরূপ জানা। স্বরূপ তো অনেকদিন পর আমাকে দেখে অবাক, বলল ‘মধুদা তুমি এখানে?’ বললাম, সরকার এখানে জমি নেবে বলেছে। খবরের কাগজে দেখলাম। তোমাদের সঙ্গে থেকে আন্দোলন করতে চাই, তাই এসেছি। নিশিকান্ত মন্ডলের সঙ্গে দেখা করব। স্বরূপ আমাকে বলল, ‘ঠিক আছে, কাল তোমাকে নিশিদার কাছে নিয়ে যাব।’ আমি তো কোনও প্ল্যান করে, কিছু ঠিক করে যাইনি। তাই সেখানে থাকারও জায়গা নেই কোনও। ২ তারিখ রাতটা আমি স্বরূপের বাড়িতেই থাকলাম।

পরদিন সকালে, ৩ তারিখ, স্বরূপের সাইকেলে চেপে দু’জনে গেলাম সোনাচূড়ায় নিশিকান্ত মন্ডলের কাছে। নিশিকান্ত মন্ডল তখন খুব ব্যস্ত। এলাকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তৃণমূল কংগ্রেস নেতা। নিশিকান্ত মন্ডলকে গিয়েও একই কথা বললাম। আপনাদের আন্দোলনে অংশ নিতে আমি এসেছি। নিশিদা আমাকে বললেন, ‘আজ তো কথা বলতে পারব না, খুব ব্যস্ত আছি। কাল নন্দীগ্রামে শুভেন্দু অধিকারীর মিটিং আছে। আজ শুভেন্দু অধিকারী ডেকেছেন। তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি।’ নিশিকান্ত মন্ডল হন্তদন্ত হয়ে চলে গেলেন। সেইদিনই তারপরে আমার সঙ্গে আলাপ হল ওখানকার কংগ্রেস নেতা সবুজ প্রধানের। সোনাচূড়াতেই সবুজ প্রধানের বাড়ি। তাঁর সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ কথা বললাম। কোনও কাজ নেই তো। স্বরূপ সাইকেল নিয়ে একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। আমি সোনাচূড়া মোড়ে ঘোরাঘুরি করছি আর লোকজনের সঙ্গে কথা বলছি। সবুজ এবং তাঁর ভাই মিলন প্রধানরা কয়েকমাস আগে আন্দোলনটা শুরু করেছিলেন। সবুজই আমাকে বলে, আজ মনে হয় জমি অধিগ্রহণের জন্য হলদিয়া ডেভেলপমেন্ট অথরিটির নোটিস ব্লক ডেভেলপমেন্ট অফিস থেকে সার্ভ করবে। আমি বললাম, যা করার সবাইকে একসঙ্গে মিলে করতে হবে। সবকটা রাজনৈতিক দল আলাদা আলাদা পোগ্রাম করলে কিছু লাভ হবে না। এরকম কিছু কথাবার্তা হয়, তারপর আমি আর স্বরূপ সাইকেলে করে তেখালি ফিরে যাই। ভাবতেও পারিনি, সেইদিনই মাত্র কয়েক ঘন্টার মধ্যে আচমকা আন্দোলন শুরু হয়ে যাবে এবং আমাদের আবার সোনাচূড়া, গড়চক্রবেড়িয়ায় যেতে হবে।

স্বরূপের সঙ্গে ওর বাড়ি ফিরে দুপুরে একসঙ্গে খেতে বসেছি, এমন সময় ওর মোবাইলে ফোন এল, ভূতার মোড়ে পুলিশ এসেছিল। গুলি চালিয়েছে। গ্রামের লোক পুলিশকে তাড়া করেছে। আসলে আমরা যখন সোনাচূড়ায় ছিলাম তখন ওই কাণ্ড ঘটেছিল গড়চক্রবেড়িয়া কালীচরণপুরে। জানতে পারিনি। দ্রুত খেয়ে উঠে সঙ্গে সঙ্গে আবার দুজনে সাইকেল চালিয়ে চলে গেলাম সেখানে। গিয়ে দেখি রাস্তার ধারে পুলিশের গাড়িটা জ্বলছে। গ্রামের লোক তাড়া করার পর পুলিশ ৩টে বন্দুক ফেলে পালিয়েছে। আমি ওদের বললাম, বন্দুকগুলো থানায় ফেরত দিয়ে দিতে। পুলিশের জিনিস রাখা ঠিক হবে না। স্থানীয় লোকজন তাতে প্রথমে রাজি ছিলেন না। ওঁরা চাইছিলেন বন্দুকগুলো রেখে দিতে। আমি সবুজ প্রধান এবং কয়েকজন নেতাগোছের লোককে বললাম, পুলিশের বন্দুক রেখে দিলে খারাপ হবে। পুলিশ গ্রামবাসীদের বিরুদ্ধে বন্দুক ছিনতাইয়ের অভিযোগ আনবে, যা ভবিষ্যতে আন্দোলনের ভাবমূর্তির পক্ষে খারাপ বার্তা দেবে। সেদিন বিকেলে ২-৩ জন থানার ফাঁড়িতে গিয়ে পুলিশের ফেলে যাওয়া বন্দুক ফেরত দিয়ে এসেছিলেন। সেই দিনই সন্ধ্যায় সোনাচুড়ায় ঘুরছি, এমন সময় কিছু লোকজন এক বয়স্ক সিপিআইএম সমর্থককে ধরে নিয়ে এলেন জমি রক্ষা কমিটির অফিসে। তাঁর বিচার শুরু করলেন ওঁরা। ওই বয়স্ক সিপিআইএম সমর্থক মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে কিছু খারাপ কথা বলেছিলেন। আমি ঢুকে গেলাম সেখানে। ওঁদের বললাম, সামনে কঠিন দিন আসছে। এখন এই সব দলীয় ব্যাপার নিয়ে নিজেরা ব্যস্ত হয়ে পড়লে চলবে না। ওই বয়স্ক ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কি জমি দিতে রাজি আছেন? তিনি বলেছিলেন, ‘আমি সিপিআইএম করি ঠিকই, কিন্তু জমি কোনওভাবেই দেব না।’ আবার সবাইকে বললাম, কে সিপিআইএম, কে তৃণমূল কংগ্রেস দেখবেন না। যাঁরা জমি দিতে চান না, সবাই এক হোন। নয়তো জমি রক্ষা করতে পারবেন না। নিজেদের মধ্যে ঝামেলায় জড়িয়ে পড়লে সিপিআইএমের সঙ্গে লড়তে পারবেন না। তারপর স্বরূপকে বলেছিলাম, সাইকেল নিয়ে বাড়ি চলে যেতে। আমি ঠিক কোথাও থেকে যাব। বুঝতে পারছিলাম, এই যে আমি দল না দেখে সবাইকে এক হতে বলছি, ব্যাপারটা অনেকেই ভালোভাবে নিচ্ছেন না। আমাকে সবাই বিশ্বাস করতে পারছেন না। কারণ, আমাকে কেউ চেনেন না। কেন আমি সেখানে ঢুকে ওঁদের ব্যাপারে কথা বলছি, তা নিয়ে কয়েকজনের মধ্যে সংশয় তৈরি হচ্ছে। কিন্ত আমি জানতাম ওঁদের অনভিজ্ঞতায় আন্দোলন শুরুতেই দিশাহীন হয়ে পড়তে  পারে। ঠিক সেই মূহুর্তে ঠিক করি, সবার বিশ্বাস অর্জন করতে গেলে আমাকে সোনাচূড়াতেই থাকতে হবে, ওঁদের লোক হয়ে উঠতে হবে। কাজটা সহজ নয়, কিন্ত তেখালিতে থাকলে তা আরও কঠিন হয়ে যাবে। আস্তে আস্তে রাত বাড়লে সব লোকজন বাড়ি চলে গেলেন। জমি রক্ষা কমিটির একটা ঘর ছিল সোনাচূড়ায়। সেখানে ছিল অনেক খড়। সেই খড়ের ওপর শুয়েই শীতের রাতটা কাটিয়ে দিলাম। নন্দীগ্রামে আমার পুরোপুরি জড়িয়ে পড়ার ঘটনা বিস্তারিত শুরু করার আগে  শুধু একটা কথা বলা জরুরি। মধুসূদন মন্ডল নামে আমাকে নন্দীগ্রামের হাতেগোনা দু’চারজন জানতেন। ওখানে সাধারণ মানুষ আমাকে জানতেন নারায়ণ নামে। বেশিরভাগ লোক আমাকে নারায়ণদা বলেই ডাকতেন।

পরদিন ৪ তারিখ নন্দীগ্রামে শুভেন্দু অধিকারীর মিটিং ছিল। শুভেন্দু অধিকারীর আসতে একটু দেরি হচ্ছিল, কিন্তু লোকজন তো  সব অনেকক্ষণ আগে থেকে অপেক্ষা করছেন। এপিডিআর করার জন্য প্রচুর গণসঙ্গীত জানতাম। নিশিকান্ত মন্ডলকে বললাম, লোকজন এসে গেছে, মিটিংও দেরি আছে। আমি বরং মঞ্চে উঠে কয়েকটা গান করি। তারপর প্রায় আধ ঘণ্টা গাইলাম। লোকজন সব মোহিত হয়ে আমার গান শুনলেন। তারপর এলেন দোলা সেন, পূর্ণেন্দু বসু। দোলা তো, ‘মধুদা তুমি এখানে? কেমন আছ’, বলে কথা শুরু করল আমার সঙ্গে। এপিডিআর করার জন্য দোলা আমাকে আগে থেকেই চিনত। তারপর দোলাও গান শুরু করল মঞ্চে। আমি যে গানগুলো  গাইলাম,  সেগুলোই। সেই দিনের পর থেকেই নন্দীগ্রামের সোনাচূড়া, গড়চক্রবেড়িয়ার বাসিন্দারা আমাকে আস্তে আস্তে পছন্দ করতে শুরু করেন। আমাকে নিয়ে ওঁদের মনে সন্দেহ অল্প হলেও কাটতে থাকে।

পরদিন ৫ তারিখ সকাল থেকেই সিপিআইএমের লোকজন নানা জায়গা থেকে ফোন করে সবুজ প্রধান এবং নিশিকান্ত মন্ডলকে হুমকি দিতে শুরু করে। বারবারই ওরা বলছিল, বন্দুক নিয়ে আক্রমণ করবে, গুলি করে আন্দোলন শেষ করে দেবে। সাবধানে থাকতে ইত্যাদি। সেইদিনই সোনাচূড়ার বাসিন্দারা সিপিআইএমকে ঠেকাতে নতুন করে বেশ কয়েকটা জায়গায় রাস্তা কেটেছিল। আমিও সেই রাস্তা কাটায় হাত লাগালাম। প্রথমেই কাটা হয়েছিল শঙ্কর সামন্তের বাড়ির পেছনের একটা রাস্তা। সেই দিন রাতে সিপিআইএম খেজুরির দিক থেকে বেশ কয়েকটা বোমা ছোড়ে। কিন্তু মূল আক্রমণটা করেছিল তার পরদিন ৬ তারিখ রাত থেকে। ৬ জানুয়ারি সিদ্দিকুল্লা চৌধুরীর মিটিং ছিল গড়চক্রবেড়িয়ার ভূতার মোড়ে। সেই মিটিংয়ে অনেক লোক হয়। সেদিন রাতে সিপিআইএম আক্রমণ করবে বলে খবর ছিল সবুজ প্রধান, নিশিকান্ত মন্ডলদের কাছে। তা প্রতিরোধ করার মতো অস্ত্র বলতে তখন ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির কয়েক’শো সদস্যের জমি না দেওয়ার মরিয়া জেদ। আর তার সঙ্গে আমার বানানো কিছু বোতল বোমা। ৭ তারিখ সারাদিন প্রবল ঝড়ঝাপ্টার মধ্যে দিয়ে গেল। তিন তিনটে তাজা প্রাণ বেঘোরে চলে গেল সিপিআইএমের ছোড়া গুলিতে। সেই দিনই বুঝেছিলাম, এইভাবে সিপিআইএম বাহিনীর মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। প্রতিরোধ করতে না পারলে কয়েক দিনের মধ্যেই সিপিআইএম এলাকায় সন্ত্রাসের রাজত্ব তৈরি করবে। সাধারণ গরিব মানুষ সব, নিজের জীবন আর পরিবারকে বাঁচাতে জমি দিতে বাধ্য হবে। ৭ তারিখই নন্দীগ্রামের স্থানীয় নেতাদের বলেছিলাম, সিপিআইএমের মোকাবিলা করতে অস্ত্র লাগবে, তার সঙ্গে লাগবে কিছু সাহসী ছেলে। জানতাম ছেলের কোনও অভাব হবে না, কারণ ওঁদের কাছে লড়াইটা জীবন ও সম্পত্তি রক্ষার। তাই তাঁদের লড়াইয়ে উদ্বুদ্ধ করতে কোনও সমস্যা হবে না। কিন্ত সবচেয়ে বড়ো সমস্যা অস্ত্র। বিনা অস্ত্রে এই সশস্ত্র সিপিআইএম বাহিনীর মোকাবিলা সম্ভব নয়।’ ঠিক যেভাবে লিখছি, সেভাবে নয়, কিন্তু আলিপুর কোর্ট চত্বরে পুলিশের কালো ভ্যানে বসে গরাদের পেছন থেকে টানা বলে চলেছেন মধুসূদন মন্ডল। নন্দীগ্রামবাসীর নারায়ণদা।

‘আমরা ছিলাম ৫ ভাই, ১ বোন, প্রচণ্ড দারিদ্রের মধ্যে বড় হয়েছি। সরকার জমি নিয়ে নেওয়ায় পর বাবারা একটা ছোট বাড়িতে থাকতে শুরু করেছিল। ক্লাস টেন পর্যন্ত পড়াশোনা করি। সুতাহাটা জনকল্যাণ শিক্ষা নিকেতনে পড়তাম, মাধ্যমিক পরীক্ষায় ফেল করলাম। তাই ক্লাস টেনের পর স্কুলে যাওয়া বন্ধ হল। তখন রোজগারের চেষ্টা না করে আবার মাধ্যমিকের জন্য পড়াশোনা চালানো তখন আমাদের পরিবারের কাছে বিলাসিতা। সেই সময় আর্থিক টানাটানি প্রচণ্ড। তবে চাকরির একটা সুযোগ আমার কাছে এসেছিল। তা হয়নি। স্কুলে পড়ার সময় আর পাঁচজনের মতো এনসিসি ট্রেনিং করতাম। ভালোই করতাম। তখন অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলা। পুরো জেলার মধ্যে এনসিসির পরীক্ষায় আমি শুটিংয়ের ফার্স্ট হয়েছিলাম। সেটা ১৯৮৪ সাল। মেদিনীপুরের রামনগরে সেই পরীক্ষাটা হয়েছিল। শুটিং ছাড়াও অনেক কিছু ট্রেনিং হোত, তাতেও আমার রেজাল্ট খুব ভাল ছিল। তখন এনসিসি’তে যারা ভালো করত, তাদের কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন জায়গায় নিরাপত্তা রক্ষীর চাকরি দিত। আমার চাকরি প্রায় ঠিকও হয়ে গেছিল কোস্ট গার্ডে। কোস্ট গার্ডে চাকরির ট্রেনিংও নিয়েছিলাম। সব কিছু ফাইনাল, তার কয়েকদিন বাদেই খুন হলেন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। তখনকার মতো এই ধরনের সব নিরাপত্তা রক্ষীর চাকরি সেই বছরের মতো বন্ধ হয়ে যায়। সেই বছরই ক্লাস টেনের পরীক্ষায় ফেল করেছি। ভেবেছিলাম, কোস্ট গার্ডের চাকরিটা হয়ে গেলে আর আর্থিক সমস্যা থাকবে না। কিন্তু তা না হওয়ায় কাজের সন্ধান শুরু করে দিলাম বাধ্য হয়ে। হলদিয়ায় দোকানে ঘুরে ঘুরে গামছা, লুঙ্গি বিক্রি করতে শুরু করি। কলকাতা, হাওড়ায় গিয়ে গামছা, লুঙ্গি নিয়ে আসতাম, বিক্রি করতাম হলদিয়ার বিভিন্ন দোকানে, কখনও বাড়িতেও। এটাই আমার প্রথম পেশা। প্রথম রোজগার। অল্প কিছু টাকা আয় হোত, আমাদের কাছে তখন তাই অনেক। বেশ কিছু দিন চলেছিল এভাবে। তারপর একদিন কাজের সন্ধানে কলকাতা গেলাম। বুঝতে পারছিলাম, এভাবে বেশি দিন চালাতে পারব না। ব্যবসা করতে অনেক টাকা লাগে। আমার তা নেই। বজবজের একটা ছোট্ট কারখানায় এসে ঢুকলাম। কিছুদিন কাজ করলাম সেখানে। টাকা পেতাম খুব অল্প। ওই টাকায় কীভাবে যে চলত তা ভাবলে এখনও অবাক লাগে। সেখানে এবং আশেপাশের কারখানাগুলোতে নানান ইউনিয়ন ছিল। শ্রমিকদের দাবি-দাওয়া নিয়ে লড়াই হোত, সেখানেই আমার প্রথম রাজনীতির শিক্ষা। ওই বয়সে যা ছিল স্বাভাবিক, তাই হল। বামপন্থী ইউনিয়নে ঢুকে গেলাম। কিন্তু সেখানে বেশি দিন কাজ করতে পারলাম না। যা টাকা পেতাম, থেকে-খেয়ে বাড়িতে কিছুই পাঠাতে পারতাম না। অথচ তখন বাড়িতে টাকার দরকার। ভাই, বোন ছোট। আবার ফিরে গেলাম হলদিয়ায়।

তখনও হলদিয়া পুরসভা হয়নি। আমার বয়সী অনেক ছেলে হলদিয়া, মহিষাদল, সুতাহাটায় ছিল, যাদের পরিবারের জমি অধিগ্রহণ হয়েছিল, তারাও আমারই মতো নানান ছোট-খাট কাজ করে কোনওক্রমে টাকা রোজগারের চেষ্টা করছিল। কোনওভাবে সংসার চালানোর চেষ্টা করছিল সবাই। জমি থেকে উৎখাত অধিকাংশ পরিবারেরই তখন নাজেহাল অবস্থা। যা কোনওদিন হয়নি, সেই অভিজ্ঞতা হয়েছিল এই পরিবারগুলোর। রোজকার সামান্য সব্জিও কিনে খেতে হোত। আটের দশকের শেষ দিক থেকেই হলদিয়ায় ছোট-ছোট কিছু কারখানা গড়ে উঠতে শুরু করে। গড়ে উঠেছিল হলদিয়া ডেভেলপমেন্ট অথরিটি। আমার মতোই যাদের হলদিয়ায় জমি-জায়গা ছিল, তাদের পরিবারের কেউই সরকারের প্রতিশ্রুতি মতো কাজ পায়নি। কেউ জোগাড়ের কাজ করত, কেউ মাটি কাটার, কেউ বা ছোট-খাট হকারি করে কোনওভাবে দিন কাটাচ্ছিল। যাদের অল্প বিস্তর জমি ছিল, তাদের অন্তত চালটা কিনে খেতে হতো না। কিন্তু ছ’য়ের দশক থেকে জমি অধিগ্রহণ শুরু হওয়ার পর বহু পরিবার ছন্নছাড়া হয়ে যায়। চোখের সামনে দেখেছি টাকা রোজগারের জন্য এই সব গরিব বাড়ির অনেক মেয়ে কীভাবে পতিতাপল্লিতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। বড় সংসার। অধিকাংশ বাচ্চার টাকার অভাবে পড়াশোনা বন্ধ। ছেলেরা তাও এদিক ওদিক থেকে কিছু টাকা রোজগার করত। কিন্তু সদ্য বড় হওয়া মেয়েরা তো অনেক পরিবারেই বাড়তি বোঝার সামিল। শুধু খাবারের জন্য ওই হলদিয়া, সুতাহাটার বহু মেয়ে রাস্তায় গিয়ে দাঁড়াতে বাধ্য হয়েছে সেই সময়। হলদিয়ার শিল্প, কারখানা, উন্নয়নের ঝকঝকে আলোর নীচে অন্ধকারের মতো থেকে গেছে এই পরিবারগুলোর জীবন। হলদিয়ার পাশেই মহিষাদলে মেদিনীপুরের সবচেয়ে সবচাইতে বড় পতিতাপল্লি। লাইন দিয়ে ট্রাক দাঁড়িয়ে থাকে রাস্তার দু’ধারে, দুপুর থেকে ভোররাত পর্যন্ত। পারলে খোঁজ নিয়ে দেখবেন কোনওদিন, মহিষাদলের এই পতিতাপল্লিতে বেশিরভাগ মেয়ে কবে, কোথা থেকে গেছে। সরকার কোনওদিন, মহিষাদলের এই পতিতাপল্লিতে বেশিরভাগ মেয়ে কবে, কোথা থেকে গেছে। সরকার কোনওদিন খোঁজও করেনি, কীভাবে, কতদিনে কোন কারণে মহিষাদলের এই পতিতাপল্লি এভাবে গড়ে উঠল। আমাদের মতো জমি থেকে উৎখাত হওয়া গরিব পরিবারগুলোর জীবনে হলদিয়ার শিল্পায়নের প্রত্যক্ষ প্রভাব নিদারুণ দারিদ্র‍ আর মহিষাদলের পতিতাপল্লি।

সেই সময় আমি এমন জমি হারানো পরিবারের কিছু ছেলেকে নিয়ে হলদিয়া ডেভেলপমেন্ট অথরিটিতে  গেলাম চাকরির দাবি নিয়ে। কিন্তু গলাধাক্কা খেয়ে ফিরেছি। বজবজের কারখানায় শ্রমিকদের দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলনের কথা মনে ছিল। ভাবলাম, কিছু একটা করতে হবে। আর সেটা একা একা করা যাবে না। যা করতে হবে দল বেঁধে। ১৯৯০-৯১, সংগ্রামী শ্রমিক মঞ্চ নাম দিয়ে একটা কমিটি তৈরি করলাম। হলদিয়া, মহিষাদল, সুতাহাটা এবং আশেপাশের এলাকায় ঘুরে ঘুরে জমি হারানো সব উদ্বাস্তু পরিবারগুলোর ছেলেদের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। সবাইকে বোঝালাম, চাকরির দাবিতে আন্দোলন করতে হবে। এমনি এমনি কেউ কিছু দেবে না। দাবি আদায় করতে হবে। বেশ কিছু ছেলে জোগাড় হয়ে গেল। হলদিয়াতে অনেকদিন চাকরির দাবিতে এখানে ওখানে ঘুরেছি, লাভ হয়নি। এবার মঞ্চ বেঁধে হলদিয়া ডেভেলপমেন্ট অথরিটিতে গিয়ে চাকরির দাবি জানালাম। বললাম, প্রয়োজন বুঝে সবাইকে কারখানায় কাজ দিতে হবে। তাতেও বিশেষ কিছু লাভ হল না। ১৯৯৩ সালের ৮ জুন কয়েকজন মিলে হলদিয়ার এসডিও’র কাছে যাচ্ছিলাম ডেপুটেশন দিতে। রাস্তাতেই সিপিআইএমের বাহিনী এসে আমাদের মারধর করল। আমাদের দু’চারজনের মাথা ফাটে, বাকিরাও ভালোরকম জখম হয়। তার পরের বছর একই দিনে, ৮ জুন  আমরা অবস্থান করেছিলাম সিপিআইএমের ওই মারধরের প্রতিবাদে।

তার কিছুদিন বাদে, ১৪ জুন হলদিয়ার সিপিআইএম নেতা সুরেশ করণের উপর হামলা হয়। সুরেশ করণের ওপর হামলার ঘটনায় পুলিশ আমাকে গ্রেফতার করে। বেশ কিছু দিন জেল খেটে বেরোলাম। তখন হলদিয়ায় সিপিআইএমের দাপট শুরু হয়ে গেছে পুরোদমে। সিপিআইএম করলে চাকরি, সিপিআইএম করলে ঠিকাদারি। আমার সঙ্গে সংগ্রামী শ্রমিক মঞ্চে যারা ছিল, অনেকেই বাধ্য হয়ে শাসক দলের নাম লেখাল। আমি পারলাম না। তারপর আবার চলে গেলাম কলকাতায়। এরপর এখানে-ওখানে নানা ছোট-খাট কারখানায় কাজ করেছি। তখন দেখতাম কারখানায় কারখানায় সিপিআইএমের রাজনীতির একমাত্র যুক্তিগ্রাহ্য বিরোধিতা করত এপিডিআর। কংগ্রেস তো সিপিআইএমের থেকেও খারাপ। আমি এপিডিআর’এ যোগ দিলাম। কাজের ফাঁকে গান এবং নানা ধরনের নাটক করতাম। সিপিআইএম বিরোধী, সরকার বিরোধী সব নাটকে অভিনয় করতাম আর গলা ছেড়ে গান গাইতাম। এভাবেই চলছিল, সেই সঙ্গে ছিল নানা ছোট-খাট কাজ।

২০০৬ সালের শেষ দিকে খবর পেলাম, নন্দীগ্রামে জমি অধিগ্রহণ হবে। ঘটনাটা প্রথম জানতে পারি ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি খবরের কাগজ পড়ে। এও খবর পেলাম, নন্দীগ্রামের মানুষ এই বিপুল জমি অধিগ্রহণের বিরোধিতা করছেন। তখনই ঠিক করে ফেলি, আমি নন্দীগ্রামে যাব। ওখানকার লোককে বোঝাবো, বাস্তু জমি থেকে একবার উৎখাত হলে তার কী প্রভাব পড়ে পরিবারের ওপর। আমি জানতাম, জমি অধিগ্রহণের ভয়ঙ্কর অন্ধকার দিক। গরিব মানুষের পুরো জীবনটা লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় বাস্তু জমি, কৃষি জমি চলে গেলে। উদ্বাস্তু পরিবারের দারিদ্র‍ মানুষকে আর মানুষ থাকতে দেয় না। নানান খারাপ পেশায় জড়িয়ে পড়ে কম বয়সী ছেলে-মেয়েরা। আর টাকার জন্য তা মেনে নেওয়া ছাড়া বাবা-মায়ের কিছু করার থাকে না। আমি আমার জীবন এবং চারপাশের অভিজ্ঞতায় জানতাম, মাথার ওপর ছাদ আর সামান্য একটু জমি-জায়গা থাকলে তাও লড়াই করে বাঁচা যায়, কিন্তু তা চলে গেলে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় গোটা পরিবার, বউ, বাচ্চা। একথা সেখানকার লোককে বলতেই ১ জানুয়ারি, ২০০৭ আমি নন্দীগ্রাম গিয়েছিলাম। সিপিআইএমের বিরোধিতা করতে, সিপিআইএমের সশস্ত্র বাহিনীকে ঠেকাতে সেই এনসিসি ক্যাম্প থেকে বেরনোর বহু বছর পর  নন্দীগ্রামে বন্দুক হাতে নিয়েছি ঠিকই। সরকার আমার গায়ে দাগী মাওবাদী তকমা লাগিয়ে দিল। কিন্তু সেখানে পরিস্থিতি এমন ছিল, সিপিআইএমের সশস্ত্র জমি দখলদারি রুখতে বন্দুক হাতে নেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। আর সরকারের বিরুদ্ধে যে লড়বে, শাসক দলের ভাষায় সেই মাওবাদী। কিন্তু নন্দীগ্রামে তো আর আমি একা লড়িনি, সেখানকার সমস্ত সাধারণ মানুষ, পুরুষ, মহিলা এমনকী বাচ্চারা পর্যন্ত যে যেভাবে পেরেছে সিপিআইএমের বিরুদ্ধে, প্রশাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। লড়াইকে সাহায্য করেছে। তবে কি সবাই মাওবাদী?

৭ জানুয়ারি সারাদিন নন্দীগ্রামে থাকার পরই ঠিক করেছিলাম, সেখানকার ছেলেদের ট্রেনিং দেব। নয়তো সিপিআইএম বাহিনীর মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। এনসিসি’তে ট্রেনিং করেছিলাম বহুদিন, তাই ওখানকার ছেলেদের শেখাতে শুরু করলাম। প্রথমেই ১৫-২০ জন ছেলেকে বেছে নিলাম। তাছাড়া সবচেয়ে বড়ো সুবিধা ছিল, নন্দীগ্রামে অনেক এক্স-আর্মিম্যান ছিলেন। তাঁদের মধ্যে একজন গোকুলনগরের আদিত্য বেরা। আদিত্য বেরার মতোই ৭-৮ জন এক্স-আর্মিম্যান ছিলেন, যাঁরা প্রথম দিন থেকেই জমির আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিলেন। পরে সংখ্যাটা আরও বেড়ে যায়। এই এক্স-আর্মিম্যানদের বেশিরভাগের কাছেই ছিল লাইসেন্সড বন্দুক, রাইফেল। বাড়িতে না ব্যবহারে পড়ে ছিল বহুদিন। এই বন্ধুক দিয়েই আমাদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ শুরু হয়েছিল। আমি, আদিত্য বেরা এবং আরও কয়েকজন এক্স- আর্মিম্যান মূলত সোনাচূড়া, গড়চক্রবেরিয়া, মহেশপুর, কেন্দেমারি এলাকার বাছাই করা ছেলেদের অস্ত্রের প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করলাম। ট্রেনিংয়ে ছেলের সংখ্যা রোজ বাড়তে শুরু করল। একদম প্রাথমিক ট্রেনিং ছিল, এই আনকোরা ছেলেরা যেন আক্রমণের মুখে পড়লে অন্তত প্রতিরোধটা করতে পারে। প্রতিরোধ করার জন্য একদম প্রাথমিকভাবে দরকার ছিল রাইফেল ধরতে শেখানো। এটা করতে আমাদের বেশি সময় লাগেনি। কারণ, নন্দীগ্রামের মানুষের কাছে এটা কোনও ছেলেবেলার শখপূরণ ছিল না। ছিল জীবন, জীবিকা বাঁচানোর মরিয়া লড়াই।

৬ জানুয়ারি রাত থেকে ৭ তারিখ সকাল পর্যন্ত খেজুরির দিক থেকে সিপিআইএমের গুলি চালানো এবং তাতে তিনজন গ্রামবাসীর মৃত্যু নন্দীগ্রামের ওই এলাকার লোককে এককাট্টা করে দিয়েছিল। জমি অধিগ্রহণের জন্য শাসকদল এবং সরকার কী করতে পারে, তার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা হয়ে গিয়েছিল সকলের। ৭ জানুয়ারির পর থেকেই সারা দিন এবং রাতে চলত পাহারা। পাহারার প্রথম সারিতে চলে এলেন মহিলারা। ছেলেরা সকালে, দুপুরে পালা করে ট্রেনিং করত আর রাতে পাহারা দিত তালপাটি খাল বরাবর নানা জায়গায়। মহিলারাও পাহারা দিতেন দিনে, সন্ধ্যায়। খেজুরির দিক থেকে সিপিআইএম আক্রমণ করলেই মহিলারা শাঁখ বাজিয়ে সতর্ক করতেন সবাইকে। তখন ছেলেরা বেরোত বন্দুক হাতে। যত দিন যাচ্ছিল ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির প্রভাবও ততই বাড়ছিল পুরো ১ নম্বর ব্লকে। ফলে যে আন্দোলনটা শুরু হয়েছিল গড়চক্রবেড়িয়ার কালিচরণপুর এবং সোনাচূড়ায়, তা খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল মহেশপুর, আমগেছিয়া, কেন্দেমারি, বয়াল কিংবা একদম তেরাপেখিয়া ঘাট পর্যন্ত। এর একমাত্র কারণ, পুরো ১ নম্বর ব্লকের মানুষই বুঝতে পারছিলেন, নন্দীগ্রামের জমি অধিগ্রহণের বিষয়টা শুধুমাত্র সোনাচূড়া, গড়চক্রবেড়িয়ার সমস্যা নয়। এটা পুরো ব্লকের ১০ হাজার একরেরও বেশি এলাকার মানুষের যৌথ সমস্যা।

এরই মধ্যে রাজ্য সরকার ঘোষণা করল, নন্দীগ্রামে তারা জমি অধিগ্রহণ করবে না। কিন্তু সিপিআইএম যত খেজুরির দিক থেকে আক্রমণ করছিল, ততই মানুষের মধ্যে বিশ্বাস তৈরি হচ্ছিল, সরকারের এই ঘোষণা আসলে মিথ্যাচার এবং নন্দীগ্রামের মানুষকে ধোঁকা দেওয়া। যদি সরকার জমি নাই নেবে, তবে সিপিআইএম বাহিনী সেই ৫ জানুয়ারি থেকে কেন লাগাতার আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে নন্দীগ্রামে? কেন সিপিআইএম নেতারা বলছেন, নন্দীগ্রামের আন্দোলনকে তাঁরা দেখে নেবেন? কেনই বা মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করছেন, শিল্পায়ন প্রক্রিয়া থেকে সরকার সরে আসবে না? আর এই সমস্ত কারণেই নন্দীগ্রামের জমি অধিগ্রহণ নিয়ে মহাকরণ থেকে রাজ্য সরকার যাই বলুক না কেন, নন্দীগ্রামের মানুষ কখনই তা বিশ্বাস করেনি। তাছাড়া খেজুরির দিক থেকে সিপিআইএমের লাগাতার সশস্ত্র আক্রমণ এবং ১৪ মার্চ পুলিশের অভিযানের পর নন্দীগ্রামের মানুষের বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে বিশ্বাস করার কোন কারণও ছিল না।’

আগের পর্বে কী ঘটেছিল: নন্দীগ্রাম আসলে যা ঘতেছিল #৫: সিপিএমের ছোড়া গুলিতে পরপর মৃত ৩, শঙ্কর সামন্তকে পাল্টা খুন করে বদলা, রণক্ষেত্র ভাঙাবেরা 

মধুসূদন মন্ডলের সঙ্গে আলিপুর আদালত চত্বরে যতবারই কথা বলেছি, অধিকাংশ সময়ই দেখেছি সিদ্ধার্থ মন্ডল নামে এক যুবককে। সিদ্ধার্থর বাড়ি খেজুরির চতুর্ভুজ চক এলাকায়। সিপিআইএম করতেন। সিদ্ধার্থর বাবা সহিষ্ণু মণ্ডল ছিলেন সিপিআইএম অন্তপ্রাণ। খেজুরির দুই সিপিআইএম নেতার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে সরব হয়ে  সিদ্ধার্থ দল ছাড়তে বাধ্য হন। খেজুরিতে থেকে নানাভাবে সাহায্য করেছেন নন্দীগ্রামের আন্দোলনকে। সিদ্ধার্থকেও মাওবাদী অভিযোগে গ্রেফতার করেছিল পুলিশ। দীর্ঘদিন জেলে কাটিয়ে জামিনে ছাড়া পেয়েছিলেন সিদ্ধার্থ। হাজিরা দিতে আসতেন আলিপুর আদালতে, কোর্ট লকআপে গিয়ে দেখা করতেন মধুসূদন মন্ডলের সঙ্গে। পরে সিদ্ধার্থর নামে ফের গ্রেফতারি পরোয়ানা বেরোয়।

সিদ্ধার্থের সঙ্গে কথার ফাঁকে ফাঁকেই যতটা সম্ভব পুলিশের নজর এড়িয়ে পুলিশ ভ্যানে বসে থাকা মধুসূদন মন্ডলের সঙ্গে কথা বলে নিতাম। কোনওদিনই বেশি কথা বলা যেত না পুলিশের জন্য। একদিন মধুসূদন মন্ডল বললেন, ‘৭ ই মার্চ, ২০০৭, নন্দীগ্রামে ফের একটা লড়াই হয়েছিল। পূর্ব মেদিনীপুরের এক তৃণমূল নেতা বেশ কিছু ছেলে পাঠিয়েছিলেন নন্দীগ্রামে আমাদের লড়াইয়ে সাহায্য করতে। ৭ জানুয়ারির পর সিপিআইএম বাহিনী খেজুরির দিক থেকে বেশ কয়েকবার আক্রমণ করেছে। কিন্তু ওদের সঙ্গে স্থানীয় মানুষের সমর্থন ছিল না। ফলে আক্রমণ করেও বিশেষ কিছু করতে পারেনি। এবং আমরাই অনেক এলাকা তখন বাড়িয়ে ফেলেছিলাম। ততদিনে ১ নম্বর ব্লকের প্রায় পুরোটাই ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির দখলে চলে এসেছিল। ওই সব এলাকায় মানুষের ধারণা হয়েছিল সিপিআইএম এবং পুলিশ তাঁদের আন্দোলন ভাঙতে বলপ্রয়োগ করবে। তাই পালা করে রাত জাগা থেকে শুরু করে সারাদিন পাহারা দেওয়ার কাজ চলছে খেজুরি এবং নন্দীগ্রাম ২ নম্বর ব্লকের সীমানা বরাবর। যেহেতু ২ নম্বর ব্লকে জমি অধিগ্রহণের কোনও ব্যাপার ছিল না তাই সেখানকার মানুষের একটা বড় অংশকেই এই আন্দোলনে সামিল করা যায়নি। কিন্তু ওই এলাকার সিপিএম বিরোধী লোকজন খবরাখবর দেওয়া থেকে শুরু করে নানাভাবে আমাদের সাহায্য করেছেন। সিপিআইএমের আক্রমণের অনেক প্ল্যানিং আমরা আগেই জানতে পারতাম ওখানকার সাধারণ মানুষের কাছ থেকে। মার্চের শুরুর দিকে নন্দীগ্রাম ২ নম্বর ব্লকেরও কিছু এলাকায় আমাদের শক্তি বাড়তে শুরু করে।’

 

চলবে

(১৮ সেপ্টেম্বর থেকে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে নন্দীগ্রাম আসলে যা ঘটেছিল। প্রতি পর্বে লাল রং দিয়ে আগের পর্বের লিঙ্ক দেওয়া থাকছে)

 

Comments are closed.