২৫ জুন, ১৯৭৫। দেশে জারি হয়েছিল জরুরি অবস্থা। আজ ইন্দিরাকে প্রতিটি সূচকে টপকে গেছেন মোদী।

ফকরুদ্দিন আলি আহমেদ, দেশের রাষ্ট্রপতি তখন গভীর ঘুমে মগ্ন। মধ্য রাত্রি। বয়স্ক মানুষ। এত রাত্রে কীই বা তাঁর করার আছে। কিন্তু সে দিনের মধ্য যামিনী যে আলাদা ব্যঞ্জনার ছিল সেটা তাঁর জানা ছিল না। সেই গভীর রাত্রে সরকারের স্বরাষ্ট্র দফতরের রাষ্ট্রমন্ত্রী একটি ছোট পাতলা ফাইল নিয়ে বাইরের ঘরে অপেক্ষা করছেন। রাষ্ট্রপতির সই করা দরকার, না হলে দেশ নাকি রসাতলে যাবে। কী আর করা, ঠেলা দিয়ে রাষ্ট্রপতিকে তোলা হলো। তিনি আড়মোড়া ভেঙে ঘুম চোখেই বাইরে এসে মন্ত্রীকে দেখে অবাক। ইতিমধ্যে ফাইল ও কলম খুলে গেল। কোনও কথা না জিজ্ঞাসা করে মহা মূল্যবান সইটি দিয়ে কাঁচা ঘুম ভাঙানোর জন্য নিজেরই কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে আবার ঘরে ফিরে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লেন প্রবীণ গান্ধীবাদি মানুষটি। জানতেও পারলেন না তাঁর সইতে দেশময় কী কাণ্ড হয়ে গেল। ভোর পাঁচটায় কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার বৈঠক। দেশে জরুরি অবস্থা চালু হয়ে গেল। সারা দেশে বিরোধী নেতারা গ্রেফতার হতে লেগেছেন। দু’তিনজন কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যও গ্রেফতার হয়ে গেলেন!
সকালবেলা গম্ভীর গলায় ইন্দিরা গান্ধীর বেতার ভাষণ শুনতে পেলো দেশবাসী। দেশের মধ্যে এবং বাইরের দুষ্টুরা ভারতকে ধ্বংস করতে কতখানি তৎপর ছিল। জরুরি অবস্থা জারি করে তিনি দেশকে বাঁচালেন। তাঁর নির্বাচন নিয়ে এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায়ে তখন তিনি নাস্তানাবুদ। তিনি সুপ্রিম কোর্টে গেলেন। কোর্ট ছুটি। অবসরকালীন বিচারপতি কৃষ্ণা আয়ার। বিরোধীরা মনে করেছিল, এবার ইন্দিরা জব্দ হবে। সে সব আশাতে জল ঢাললেন আইনমন্ত্রী কৃষ্ণা আয়ার। কোর্ট খুললে আলোচনা হল, যা রায় দিলেন তা হাস্যকর। ইন্দিরা প্রধানমন্ত্রী থাকবেন। শুধু সংসদে কোনও ব্যাপারে ভোট হলে তা দিতে পারবেন না।
সেদিন মধ্যরাত্রের পর বড় সংবাদপত্রের দফতরে বিদ্যুৎ সংযোগ ছিল না, যাতে প্রভাতী দৈনিক ‘তাজা খবর’ প্রকাশ করতে না পারে। সারা দেশে সাংবাদিকরা গ্রেফতার হলেন। দেশের প্রকৃত অবস্থা জানতে নাকি রাষ্ট্রপতির দুপুর গড়িয়ে গিয়েছিল। অরাজকতার হট্টমেলা আর কী। কেন এমন করলেন? মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, এটাই হলো একনায়ক শাসকদের মনোবিকার। সবাইকে ভয় পেতে শুরু করে। বদ লোকদের সঙ্গী করে। ইন্দিরা গান্ধী অবশ্য ছোট পুত্র ছাড়া আর কারও কথা শুনছিলেন না। আর ছোট পুত্র এক দঙ্গল সমাজবিরোধী দ্বারা ঘেরাও ছিলেন। সংবাদপত্রে সেন্সরশিপ চালু হলো। পাতার পর পাতা ফাঁকা কাগজ। নাকালের একশেষ। রবীন্দ্রনাথ তো কোন ছার, জওহরলাল, মহাত্মা গান্ধীও  কাঁচি কাটা থেকে রেহাই পেলেন না।
সুপ্রিম কোর্টের এত দিনের নিয়মকানুন পাল্টে দিলেন।  দু’তিনজনকে টপকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করলেন। এলাহাবাদ হাইকোর্টের সেই বিচারপতি, যিনি ইন্দিরার নির্বাচন বাতিল করে দিয়েছিলেন, পথ দুর্ঘটনায় (!) তিনি মারা গেলেন। বেতার যন্ত্রে কেবল ২০ দফা আর পাঁচ দফার জয়গান। ‘এশিয়ার মুক্তি সূর্য’ হিসেবে দেশময় হুল্লোড় পড়ে গেল। কার্যত মিলিটারি শাসন চলছে। বিরোধীরা তো কোন ছার, কংগ্রেস নেতারাই ট্যাঁ-ফ্যু করতে পারছেন না। মন্ত্রিসভার বৈঠক ২৪ মিনিটে শেষ। পার্লামেন্ট তো নৈব নৈব চ!
এই পর্বে পশ্চিমবাংলার আঁচটা তেমন তীব্র মনে হয়নি। কারণ তার আগেই এখানে চূড়ান্ত স্বৈরশাসন চলছিল। ১৯৭২ সালের জালিয়াতি নির্বাচনে কংগ্রেস জিতলো। হাজার হাজার ভোটে জ্যোতি বসু হারলেন। তার আগেই রাজ্যজুড়ে ‘কংশাল’দের সন্ত্রাস চলছিল। নির্বাচনের আগেই হয়েছে কাশীপুর-বরানগরের হত্যাকাণ্ড। বর্ধমানজুড়ে সন্ত্রাস। কালনাতে একের পর এক কমিউনিস্ট নেতার শহিদ হওয়া। গ্রামীণ এলাকায় তখনও কংগ্রেসের মানুষজন আছে কিছু। তারা জমিদার নন্দনই বেশি। বরাহনন্দনের মনোভাব নিয়ে বড় বড় জুলফি রেখে যেন নিজেরাই দেশ শাসন করছেন, এমন হাবেভাবে রত। শহরাঞ্চল থেকে হাজার হাজার গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কর্মী উৎখাত হলেন।
জ্যোর্তিময় বসু জরুরি অবস্থার প্রথম রাতেই গ্রেফতার হলেন। ইন্দিরা গান্ধীকে যথেষ্ট দাগা দিয়েছিলেন তিনি। ইন্দিরার বন্ধু, সহপাঠী যাঁরা একসঙ্গে  বিদেশে পড়েছেন, তাঁরা কেন্দ্রে আমলা। তাঁরাও নিস্তার পেলেন না। ডি পি ধর মারাই গেলেন, পি এন হাকসার যোজনা কমিশনে স্থানান্তরিত। একটি মজার ঘটনা ঘটেছিল ক্যাবিনেট সচিব নির্মল মুখার্জিকে নিয়ে। এক বর্ণ বাংলা জানতেন না। বাবার পদবী ব্যবহার করেছেন মাত্র। ইন্দিরা আমলাদের মিটিং করছেন। বোঝাছেন দেশ কত বড় বিপদের সামনে। হঠাৎ মুখার্জি বলে উঠলেন, ম্যাডাম আপনি একটা মামলায় হেরেছেন, দেশবাসী তার জন্য ভুগবে কেন? ব্যস আর যায় কোথায়? মিটিং শেষ। বিকালের মধ্যে মুখার্জি সিভিল অ্যাভিয়েশন দফতরের সচিব পদে বদলি। স্বৈরাচার কাকে বলে? এই তো জরুরি অবস্থা।
জরুরি অবস্থা চালুর দিনে সাত কাহনের গল্প পেড়েছি কেন, তার কৈফিয়ত দরকার। কৈফিয়তটি বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কিত। কোনও অবসন্ন বিকেলে অথবা গহীন রাত্রে ভাবি, সেদিনের চেয়ে আজকে পার্থক্য কতটুকু। সারা দেশে সবার মধ্যে ভয়-ভয় ভাব। নিজের দলের মন্ত্রী, সাংসদরা প্রধানমন্ত্রীর সামনে কথা বলতে পারেন না। প্রধানমন্ত্রী একা সত্য-মিথ্যা বকে যাচ্ছেন। আজও সংবাদপত্রের উপর অলিখিত জোরাজুরি চলছে। প্রধানমন্ত্রী চার বছরে একবারও সাংবাদিকদের মুখোমুখি হননি। নিজে একতরফা ‘মন কি বাত’ চালিয়েছেন ৪৫ বার। একনায়কতন্ত্র আর কাকে বলে!
এই প্রথম বিচারপতি নিয়োগ নিজের হাতে নেওয়ায় সচেষ্ট প্রধানমন্ত্রী। প্রধান বিচারপতিকে ঠারেঠোরে নির্দেশ দিচ্ছেন। যা ইন্দিরা গান্ধীর আমলেও দেখা যায়নি, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা আদালতের আভ্যন্তরীণ বিষয় সাংবাদিক সম্মেলন করে বলছেন। এই প্রথম সরকারি বিজ্ঞাপনে সংবিধানের প্রথম পৃষ্ঠা ছাপা হচ্ছে, যেটি আমাদের সংবিধানই নয়। এই প্রথম আইনসভা ক’দিন বসবে তার কোনও স্থিরতা নেই।  আর প্রধানমন্ত্রী দেশে-বিদেশে ভাষণ দেওয়া পছন্দ করেন খুবই। বাক্য-বাগীশ। সংসদে যেতে এবং সাংসদদের মুখোমুখি হতে ভয় পান।  তাঁদের কোনও প্রশ্নের জবাব দেন না।ইন্দিরা গান্ধী দেশবাসীর সঙ্গে ঘোরতর তঞ্চকতা করেছেন, তাতে কোনও দ্বিমত থাকার কথা নয়। গণতন্ত্র, বহুত্ববাদ, আইনি ব্যবস্থা সব কিছুকে তিনি উপেক্ষা করেছিলেন। নরেন্দ্র মোদী প্রতিটি সূচক টপকে চলে গেছেন। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ফ্যাসিবাদের রমরমা। যেটি স্বৈরাচারের আকার নিয়েছে।
গোরক্ষা বাহিনী তো তাণ্ডব চালাচ্ছে। গরু সংক্রান্ত কোন ব্যবসা কেউ করতে পারবে না। কেউ প্রেম, ভালোবাসা করে বিয়ে করতে পারবে না। একটা রাজ্য তো এ ব্যাপারে নীতি পুলিশ তৈরি করে ফেলেছে। নিজের পছন্দমত খাওয়া দাওয়া করা যাবে না। জিনসের পোশাক পরা যাবে না। কড়া তালিবানরাও এই সব ভাবতে পারে না। স্বৈরাচার গাছে ফলে না। কোনও রাজ্যের যুক্তিসঙ্গত দাবিগুলো বিবেচিত হচ্ছে না। প্রথম সংসদ বেশি দিন বসছে না। বসলেও শাসক দলই তা বানচাল করার তাল খুঁজছে। দ্বিতীয়ত, প্ল্যানিং কমিশন নেই। এখন নীতি আয়োগ। আলোচ্য সূচি দেখেই বোঝা যাচ্ছে, ব্যাপারটা পাতে দেওয়ার মতো নয়। বর্তমানে বিমুদ্রাকরণ বিজেপি সরকারের আর্থিক স্বৈরাচারের সর্বসীমা ছুঁয়ে ফেলেছে। এত বড় আর্থ-সামাজিক দুর্ভোগের মধ্যে দেশ বহুকাল পড়েনি। আভ্যন্তরীন পুঁজিপতিদের সেবা করা হচ্ছে, এই আনন্দে আছেন মোদীবাবু।
একটি বড় অসামঞ্জস্য আছে ১৯৭৫ সালের অবস্থার চাইতে। তা হলো, সরাসরি জরুরি অবস্থা ঘোষণা হয়নি। কিন্তু একটা ঘটনায় বর্তমান রাষ্ট্রপতি মশায়ের অবস্থা ফকরুদ্দিন আলি আহমেদের মতো হয়ে গিয়েছিল প্রায়। চকিতে আমার সেটাই মনে পড়ছিল। কাশ্মীর থেকে বিজেপি সমর্থন তুলে নিয়েছে। সেখানে রাজ্যপালের শাসন চালু হবে। কিন্ত সেটা রাষ্ট্রপতির মূল্যবান সাক্ষর ছাড়া হতে পারে না। রামনাথ কোবিন্দ মশায় তখন সুরিনামের পথে মধ্য গগনে বিরাজমান। সেখানেই তাঁকে জানানো হলো। সইটি অবশ্য মাটিতে পা দিয়ে করলেন এই যা। স্বৈরাচারীদের কাজের পার্থক্য আর কতটুকু!

(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)

Leave A Reply

Your email address will not be published.