মহামারির ইতিহাস: ইতিহাসের ৬টি মহামারি, যা পৃথিবীকে মৃত্যুপুরী বানিয়েছিল

করোনা-হানায় ত্রস্ত বিশ্ব। প্রথম ১১৪ টি দেশে ছড়িয়ে পড়া কোভিড-১৯-কে ‘প্যানডেমিক’ বা অতিমারি হিসেবে ঘোষণা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)। করোনার ছোবলে বিশ্বজুড়ে প্রায় ৩৫ লক্ষ মানুষ আক্রান্ত, মৃত্যু হয়েছে প্রায় ২ লক্ষ  ৪৭ হাজার মানুষের। ভারতে কোভিড-১৯ এর হানায় মৃত্যু ছাড়িয়েছে ১ হাজার ৩০০, আক্রান্ত প্রায় সাড়ে ৪২ হাজার মানুষ।

করোনায় দিন দিন মৃত্যু সংখ্যা বেড়ে চলেছে, টালমাটাল বিশ্ব অর্থনীতি। কিন্তু কী এই প্যানডেমিক? এর আগে কোন ৬ বার প্যানডেমিকের কারণে সবচেয়ে বিপদের মুখে পড়েছিল মানব সভ্যতা? জেনে নিন pandemics in history.

 

প্যানডেমিক কী?

pandemic flu history

 

খুব কম সময়ের মধ্যে কোনও রোগ একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে বা দেশে ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়লেই তাকে প্যানডেমিক বলা হয় না। যেমন, ২০১৯ সালে আমেরিকায় এক প্রকার হাম ছড়িয়ে পড়েছিল। ১৯৯২ সালে এর সংক্রমণ দেখা গেলেও ২০১৯ সালে তা মাত্রা ছাড়িয়েছিল। কিন্তু ভ্যাকসিন থাকার জন্য তা ব্যাপক ভাবে ছড়িয়ে পড়েনি। করোনাভাইরাসের মতো এত ভয়ঙ্কর রূপও নেয়নি। এখানেই এপিডেমিক ও প্যানডেমিকের মধ্যে পার্থক্য (difference between pandemic and epidemic.)

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মহামারিকে যে ভাবে বিশ্লেষণ করেছেন, তা হল কোনও অসুখ যখন স্বাভাবিকতা ছাড়িয়ে একটি সম্প্রদায় বা অঞ্চলকে আক্রমণ করে তখন তা মহামারি। কিন্তু প্যানডেমিক এর থেকে আলাদা। ‘এ ডিকশনারি অফ এপিডিমায়োলজি’ অনুযায়ী, প্যানডেমিক হল এমন এক মহামারি যা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে, অথবা আন্তর্জাতিক সীমানা ছাড়িয়ে কোনও বিশাল এলাকাজুড়ে প্রচুর মানুষকে আক্রমণ করে। সহজ ভাবে বললে, মহামারির চেয়ে আরও বেশি ভয়াবহ, তা-ই হল প্যানডেমিক। এই বিষয়ে বলে রাখা প্রয়োজন, চিকিৎসা বিজ্ঞান বলছে, কোনও অসুখ কতটা ভয়াবহ, তার উপর প্যানডেমিক ঘোষণা নির্ভর করে না। কোনও অসুখ বিশ্বের কতটা অংশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে এবং তার হার কেমন ইত্যাদি বিবেচনা করার পর প্যানডেমিক ঘোষণা করা হয়।

 

কখন প্যানডেমিক ঘোষণা হয়?

জেনিভায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)-র ডিরেক্টর জেনারেল টেডরস আধানম গোবিয়াসেস জানান, করোনাভাইরাসের কারণে এই প্রথমবার প্যানডেমিক বা অতিমারি হল। এর আগেও করোনাভাইরাস বিপজ্জনক ছিল কিন্ত তা প্যানডেমিক বা অতিমারির আকার নেয়নি।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাই সিদ্ধান্ত নেয় কোনও অসুখ বা রোগকে প্যানডেমিক হিসেবে ঘোষণা করা হবে কি না। কটি দেশ আক্রান্ত হচ্ছে, কতজন মারা যাচ্ছে বা কত মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে, শুধু তার উপর নির্ভর করেই প্যানডেমিক ঘোষণা হয় না। আরও বেশ কিছু জিনিস বিশ্লেষণ করা হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, ২০০৩ সালে সার্স করোনাভাইরাস ২৬ টি দেশের উপর প্রভাব ফেললেও তাকে প্যানডেমিক বলেনি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।

 

Pandemic in History – ইতিহাসে টি মহামারি যা পৃথিবীকে মৃত্যুপুরী বানিয়েছিল

pandemic virus history

 

) ২০০৯ সালে সোয়াইন ফ্লু

২০০৯ সালে এইচ ওয়ান এন ওয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা বা সোয়াইন ফ্লু-কে প্যানডেমিক ঘোষণা করেছিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। কিন্তু করোনাভাইরাসের মতো অত ভয়ঙ্কর হয়নি সোয়াইন ফ্লু। এই রোগে গড় মৃত্যুহার ছিল ০.০২ শতাংশ, মৃতের সংখ্যা বেশি হলেও চিকিৎসা ব্যবস্থাকে সে ভাবে প্রভাবিত করতে পারেনি ওই রোগ। বিশ্বের ১১ থেকে ২১ শতাংশ মানুষ এই প্যানডেমিকে প্রভাবিত হয়।

২০০৯ সালে আমেরিকায় প্রথম সোয়াইন ফ্লু হয়। ২০০৯ সালের ১১ জুন একে প্যানডেমিক ঘোষণা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। ২০০৯ সালের ১০ অগাস্ট প্যানডেমিক শেষ হয়েছে বলে ঘোষণা করা হয়। সোয়াইন ফ্লুর প্রথম বছরে বিশ্বজুড়ে প্রায় ১০ থেকে ৪০ লক্ষ মানুষ মারা যায়। ভারতে প্রথম হায়দরাবাদে ধরা সোয়াইন ফ্লু ধরা পড়েছিল। ২০১০ সালের ৮ অগাস্ট কেন্দ্রীয় সরকার একটি রিপোর্টে জানায় মোট ১,৮৩৩ জন মানুষের মৃত্যু হয় এই সোয়াইন ফ্লুয়ে।

 

) দ্য গ্রেট প্লেগ অফ লন্ডন

১৬৬৫ সালে প্লেগ রোগ ভয়াবহ আকার নেয় লন্ডনে। যা প্যান্ডেমিকের ইতিহাসে গ্রেট প্লেগ অফ লন্ডন নামে পরিচিত। লন্ডনের মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশই মারা যায় এই অতিমারিতে। মৃত্যুর সংখ্যা এমন জায়গাতে পৌঁছয় যে গণকবর খুঁড়তে হয়েছিল। কুকুর এবং বিড়াল এই রোগের বাহক বলে সন্দেহ করে কয়েক হাজার কুকুর, বিড়াল মেরে ফেলা হয়।

যদিও ১৬৬৫ সালের লন্ডনের এই বিউবনিক প্লেগ এখনও যুক্তরাষ্ট্রের পূর্বাংশের গ্রামীণ এলাকায়, আফ্রিকা ও এশিয়া মহাদেশের কিছু জায়গায় হানা দেয় বলে জানাচ্ছে সেন্টারস ফর ডিজিস কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন।

ছোঁয়াচে এই অসুখের উপসর্গ হল প্রচণ্ড জ্বর, মাথা ব্যথা, দুর্বল ভাব এবং শরীরের গাঁটে গাঁটে ব্যথা। তবে আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থায় এই রোগ এখন তেমন ভয়ঙ্কর নয়।

 

) স্প্যানিশ ফ্লু এ (এইচওয়ান  ১৯১৮ সালে স্প্যানিশ ফ্লু (এইচওয়ান এনওয়ান)-কে প্যানডেমিক বলা চলে। বিশ্বের প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ এই স্প্যানিশ ইনফ্লুয়েঞ্জায় প্রভাবিত হয়েছিল। ওই বছর গোটা ইউরোপ ও আমেরিকা ব্যতিব্যস্ত হয়েছিল এই ইনফ্লুয়েঞ্জায়। মোট দুই পর্যায়ে এই ভাইরাস ছড়িয়েছিল। সব মিলিয়ে ২ থেকে ৫ কোটি মানুষের মৃত্যু হয়।

 

) এশিয়ান ফ্লু (এইচটু এনটু)

১৯৫৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এশিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা (এইচ টু এন টু) মহামারির থেকেও ভয়ঙ্কর আকার নিয়েছিল। ব্রিটেনে প্রায় ৩০ হাজার মানুষ এবং বিশ্বব্যাপী ১০ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয় এই এশিয়ান ফ্লুতে। প্রথম এই ভাইরাসের সংক্রমণ দেখা দেয় সিঙ্গাপুরে। ১৯৫৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এই রোগের প্রাদুর্ভাব হয় সিঙ্গাপুরে, সেখান থেকে হংকং হয়ে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল।

 

) হংকং ফ্লু (এইচ থ্রি এন টু)

১৯৫৭ সালের চেয়ে কম ভয়ঙ্কর হলেও ভিয়েতনামের যুদ্ধবাহিনীর কাছ থেকে ছড়ানো এই ভাইরাসের ক্যালিফোর্নিয়া থেকে গোটা আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়তে মাত্র তিন মাস সময় লেগেছিল। শুধু ইংল্যান্ডেই মারা যায় ২ লক্ষ ৩০ হাজার মানুষ এবং বিশ্বজুড়ে মৃতের সংখ্যা ছিল ১০ লক্ষেরও বেশি। বিশেষজ্ঞরা বলেন, এই প্যানডেমিক বেশি ভয়ঙ্কর হতে পারেনি। কারণ, ১৯৫৭ সালের ফ্লু এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে একরকম অনাক্রমণতা তৈরি করতে পেরেছিল

 

) এইচআইভি/এইডস

১৯৮১ সালে প্রথম এইচআইভি চিহ্নিত হয়। লস এঞ্জেলসের পাঁচজন যুবকের দেহে এই এইচআইভি পাওয়া যায়। যদিও একই সময়ে নিউইয়র্ক ও ক্যালিফোর্নিয়াতেও এইচআইভি আক্রান্তের খবর উঠে আসে বলে ভিন্নমত রয়েছে। সে বছর প্রায় ১২১ জন সমকামী পুরুষের মৃত্যু হয়। তবে ১৯৮২ সালে ক্যালিফোর্নিয়ায় এইডস আক্রান্তের খবর ছড়ায়। এরপর নারী-পুরুষ নির্বিশেষে ইউরোপ ও আফ্রিকা থেকে এইডস আক্রান্তের খবর আসে। যে ভাইরাস এখনও ছড়াচ্ছে। ২০১৮ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, বিশ্বজুড়ে প্রায় ৪০ কোটি মানুষ এইচআইভি/ এইডসে আক্রান্ত।

Comments are closed.