পহেলা বৈশাখ: বিপন্নতার বিরুদ্ধে কৃষ্ণচূড়া

পহেলা বৈশাখ।
নতুন আরেকটি বছরকে আবাহনের দিন। একটি নতুন প্রত্যাশার জন্যে কান পাতার দিন। গত হয়ে যাওয়া বছরটির দুঃখ, কষ্ট, না-পাওয়ার বেদনা, বঞ্চনা, মিথ্যাচার, হানাহানি পিছনে ফেলে নতুন প্রত্যাশায় সম্মুখ যাত্রার দিন।
মুঘল সম্রাট আকবরের সময় থেকে মূলত ব্যবসায়িক কারণে নতুন এই বর্ষ গণনা এবং উদযাপনের শুরু। আজও এ ভূখণ্ডের মানুষ আনন্দে উৎসাহে কাটায় দিনটি। আবহমান কালের আনন্দের এই উৎসবটি উদযাপনে থাকে না ধর্ম-বর্ণ বা জাতিগত ভেদাভেদ। শাশ্বত মানুষের উৎসব এই বর্ষবরণ।
অধুনা পান্তা ইলিশ বা মাটির সানকিতে পথে বসে খাওয়া বর্ষবরণের আচার কোনদিনও ছিল না। ঘরে ঘরে অন্যদিনের চেয়ে একটু উন্নত আয়োজনের চেষ্টা করতেন অভিভাবকেরা। গরম বলে দই চিড়া থাকতো সকালে। যে পরিবার শাক-ভাত খায় তারা একবেলা মাছ-ভাত খাওয়ার চেষ্টা করতেন, যে পরিবার মাছ-ভাত খান তারা এক টুকরো মাংসের ব্যবস্থা করার চেষ্টা করেন- এই প্রত্যাশায় যে বছরের প্রথম দিন ভালো খেলে সারা বছর ভালো খাওয়া যাবে। খেটে খাওয়া যে মানুষের ঘরে নুন আনতে পান্তা ফুরায়, সে রাতের খাবারে আধ পেটা খেয়ে একটু ভাত বাঁচিয়ে পানি দিয়ে রাখেন গৃহিনী যাতে সকালে কাজে যাবার আগে স্বামী-সন্তানের মুখে দুটি অন্ন দিতে পারেন। পহেলা বৈশাখ ঘটা করে পানতা খাওয়া যেন সেই আধপেটা খাওয়া মায়ের দারিদ্রকে পরিহাস করা।
এখনকার মতো পোশাক কেনার এতো ধুম সেদিন ছিল না। তবে বাবা মায়ের শখ ছিল সাধ্যের সাথে মিলে গেলে নতুন পোশাক আসতো পরিবারে। না হলে পুরোন কাপড় পরিষ্কার করে ভোরবেলা রমনার বটমূলে উপস্থিত হওয়ায় কিন্তু কোন আলস্য ছিল না।
শুধু ভালো খাওয়া পরাই না, আমার দাদি বলতেন প্রথমদিন সবার সাথে ভালো ব্যবহার করলে, ভালো হয়ে চললে, ঠিকমতো লেখাপড়া করলে সারাটা বছর এমনই কাটবে। অভিভাবকরা এই দিনটিতে আমাদের পারত পক্ষে বকতেন না। একে যদি সংস্কার বলি তো সংস্কার। তবে বাঙালির সংস্কার যা এক শুভ আগামীর স্বপ্নের সংস্কার।
আমাদের শৈশবে হয়তো এত চাকচিক্য ছিল না কিন্তু উৎসব উদযাপনে ছিল প্রাণের ছোঁয়া। সাজে ছিল বাঙালির আবহমান সংস্কৃতির পরিচয়। সুন্দরের প্রতি ছিল মুগ্ধতা, ছিল না ছিন্নভিন্ন করার লালসা।
নারী সেদিন নিরাপদেই চলতো আপন স্বাধীনতায়। তখন বেঁধে দিতে হয়নি উৎসব আনন্দের সময়। সংস্কৃতি-কর্মীরা গান-নাচ-আবৃত্তি নাটক নানা পরিবেশনা করেছেন। ব্যবসায়ীরা বেচা-কেনা আর হালখাতা করেছেন। সাধারণ মানুষ আনন্দ উল্লাস করেছেন। আর যাদের নিরাপত্তা দেবার কাজ তারা সদা-জাগ্রত থেকে নিরাপদ রেখেছেন সকলকে। কোনও সমস্যা তো হয়নি। পহেলা বৈশাখের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলকে ধ্বংস করতে উদ্ধত হয়েছিলো মৌলবাদী অপগোষ্ঠী। তারা বোমা হামলা চালিয়েছিলো রমনার বটমূলের অনুষ্ঠানে। কিন্তু সংস্কৃতির যে স্রোত মানুষের হৃৎ-মন্দিরে বহমান, তাকে ধ্বংস করতে পারে না কোনও অশুভ শক্তি। তাই বোমা হামলার পরের বছরের পহেলা বৈশাখ ছিলো শুভবোধের নতুন সূর্যোদয়। জনগণ এতটুকু ভয় পায়নি। বাবার কাঁধে চড়ে শিশুর ডুগডুগির শব্দ কি এতোটুকু কমেছে? বরং জনস্রোত বেড়েই চলেছে একটু একটু করে প্রতিবছর। প্রতিমুহূর্তে মানুষ পহেলা বৈশাখের সুরে পৃথিবীর সকল অশুভ শক্তিকে নিশ্চিহ্ন করার প্রতিজ্ঞা করে। বৈশাখের সুরে শপথ নেয় নতুন পৃথিবীর।
যে সাম্প্রদায়িক দুরাচার এই ভূখণ্ডকে এর কৃষ্টি, সংস্কৃতি, আবহমান আচার, ঐতিহ্যকে ভুলিয়ে দিতে চায় তাকে রুখতে হবে সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায়। তার ভয়ে ঘরে ঢুকে যাওয়া বা ঢুকিয়ে দেওয়া কোন দায়িত্ববানের কাজ হতে পারে না। যারা সামাজিক মাধ্যমকে ব্যবহার করে ধর্মের নামে আমাদের সংস্কৃতিকে বিজাতীয় বলে, আমাদের আচার অনুষ্ঠানকে কটাক্ষ করে পরকালের ভয় দেখিয়ে আমাদের অনুভূতিতে আঘাত করে, আসুন তাদের নামে অনুভূতিতে আঘাতের মামলা করি সারা দেশের সকল সচেতন মানুষ। এদের প্রতিহত করি এদেরই অস্ত্রে। কেননা এই বাংলা আমাদের, এই বাংলা আমাদের হাজার বছরের ঐতিহ্যলালিত সংস্কৃতির বাংলা। এ বাংলা কোনো ধর্মীয় গোষ্ঠীর কোনো জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীর বাংলা নয়।

Leave A Reply

Your email address will not be published.