রবীন্দ্রনাথ ও বাংলাদেশ

বাংলাদেশের মুক্তি-সংগ্রামের ইতিহাসের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে আছে ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ উদযাপন। তৎকালীন পাকিস্তান সরকার বাঙালির আত্ম-পরিচয়ের শিকড় উপড়ে ফেলতে চেয়েছিল নানা ষড়যন্ত্রে। প্রথমে ভাষার অধিকারে খড়গ চালিয়েছিল তারা। বাঙালি বুকের রক্ত দিয়ে আদায় করে নিয়েছিল মাতৃভাষা বাংলার রাষ্ট্রভাষা মর্যাদা। ১৯৬১ সালেও বাঙালির প্রাণের রবীন্দ্রনাথে শোষণের শিকল পরায় পাকিস্তানি বর্বর শাসকগোষ্ঠী। সে সময় অবিভক্ত সার্বভৌম বাংলার পক্ষে জোরালো অবস্থান নেওয়া রাজনৈতিক তাত্ত্বিক আবুল হাশিম বলেছিলেন— “যাহারা ইসলাম ও পাকিস্তানী আদর্শের নামে রবীন্দ্রসংগীত বর্জনের ওকালতী করিতেছেন, তাহারা শুধু মূর্খই নহেন, দুষ্টুবুদ্ধি-প্রণোদিত ও তাহারা না বোঝেন রবীন্দ্রনাথ, না বোঝেন ইসলাম”।
১৯৬৭ সালে রবীন্দ্রনাথের গান বেতার ও টেলিভিশনে নিষিদ্ধ করার প্রতিবাদে নেতৃস্থানীয় কয়েকটি সাংস্কৃতিক দল নিয়ে “রবীন্দ্র স্বাধিকার প্রতিষ্ঠা পরিষদ” গঠিত হয়। তিনদিনের রবীন্দ্র-উৎসব পালিত হয় পরিষদের প্রযত্নে। ছায়ানট ও বুলবুল ললিতকলা কেন্দ্র এই পরিষদে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। সেই সময় সংস্কৃতি সংসদ মঞ্চস্থ করে রবীন্দ্রনাথের তাসের দেশ। নাটকটির নির্দেশনায় ছিলেন সৈয়দ হাসান ইমাম।
১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্ত হয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রমনার রেসকোর্স ময়দানে বিশাল এক জনসভায় ঘোষণা দেন— “আমরা এই ব্যবস্থা মানি না। আমরা রবীন্দ্রনাথের বই পড়িবই, আমরা রবীন্দ্রসংগীত গাহিবই এবং রবীন্দ্রসংগীত এই দেশে গীত হইবেই”। সে বছর ১৬ ডিসেম্বর রবীন্দ্রসংগীতের কিছু রেকর্ড উপহার পেয়ে তিনি বলেন— “… ভেস্টেড কোয়ার্টারস উইল অলওয়েজ বি অ্যাকটিভ টু ব্রিং কালচারাল সাবজুগেশন টু পারপেচুয়েট এক্সপ্লয়টেশন অব দ্য পিপল। বাট দ্য পিপল মাস্ট স্ট্যান্ড ইউনাইটেড টু কারেজাসলি ডিফেন্ড দেয়ার ল্যাঙ্গুয়েজ আন্ডার সারকামেসটনসেস”। দুই বছর পর এ তারিখেই স্বাধীনতাযুদ্ধে জয়লাভ করে বাংলাদেশ প্রথম বিজয় দিবস উদযাপন করে।
তুকারাম, কবীর ও লালনের মতো সুফি কবিদের চলমান ধারায় রবীন্দ্রনাথের অবস্থান। কিন্তু এই মরমি কবির বিচরণ কেবল আত্মমুক্তি এবং উপনিষদের ও এই পার্থিব জগতের অর্থের মধ্যকার সম্পর্ক সংজ্ঞায়িত করতে চাওয়ার মধ্যেই নয়। রবীন্দ্রনাথ হলেন সেই ঋষি, যিনি ইংরেজি শিক্ষার জন্য পাঠ্যপুস্তক রচনা করেন, বিশ্বব্রহ্মাণ্ড বিষয়ে বৈজ্ঞানিক গ্রন্থ বিশ্বপরিচয় রচনা করেন, বৈজ্ঞানিক ধারণা ও মূল্যবোধ হদয়ে গেঁথে নেন, সুতা কাটার চরকা অর্থনৈতিক মুক্তির হাতিয়ার হতে পারে কি না, তা নিয়ে বিতর্কে নামেন, কৃষিতে ট্রাক্টর যন্ত্র নিয়ে আসেন, চাষিদের মধ্যে ঋণ বিতরণের জন্য প্রতিষ্ঠান তৈরিতে সচেষ্ট হন ও বিরোধ মীমাংসার বিকল্প পদ্ধতি উদ্ভাবন করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালান।
রবীন্দ্রনাথের জীবন-দেবতা, উপনিষদ, অসীম ও সীমার ধারণা সহজে বোধগম্য নয়। সাধনায় ব্রহ্মার উপলব্ধির কথা শোনার পর ১৯১৩ সালের জুন মাসে বারট্রান্ড রাসেল লন্ডন থেকে লেখা এক পত্রে অটোলিন মোরেলকে লেখেন— “নদী গিয়ে মহাসমুদ্রে মিলিত হওয়া আর ব্রহ্মের সঙ্গে মানুষের মিলন নিয়ে এটা পুরাদস্তুর জঞ্জাল, মামুলি রচনা…মানুষটা নিষ্ঠাবান ও আন্তরিক, কিন্তু বাতিল কথা নিয়ে বকবক করছেন”। ১৯৬৭ সালে অসীমের ধারণা নিয়ে রবীন্দ্রনাথের বক্তব্যকে তিনি অর্থহীন, অস্পষ্ট বলে অভিহিত করেন। রবীন্দ্রনাথের যে ভাষা অসংখ্য ভারতীয় পছন্দ করে, সে সম্পর্কে রাসেলের মন্তব্য— “দুর্ভাগ্যবশত তা আসলে কোনো অর্থ বহন করে না”।
আইনস্টাইন রসিকতা করে রবীন্দ্রনাথকে ‘পুরোহিত’ বলতেন। জর্জ বার্নার্ড শ একটি নাটকে মঞ্চের বাইরের এক চরিত্রের নাম দিয়েছিলেন কবি ‘স্টুপেন্দ্রনাথ বেগর’। আবার ১৯৪১ সালে কবি মারা যাওয়ার পর বার্নার্ড শ-ই ন্যাশনাল গ্যালারির তৎকালীন পরিচালককে রবীন্দ্রনাথের ছবি টাঙাতে বলেন।
রবীন্দ্রনাথ আমাদের সমসাময়িক লেখক এবং বাঙলাদেশের সামগ্রিক প্রশ্নে তিনি আমাদের ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা। আমরা তাঁর নাটক মঞ্চস্থ করি, উপভোগ করি। সাহস ও প্রতিরোধের নাটক হিসেবে আমরা ডাকঘর মঞ্চস্থ করতে পারি এবং এখনও করি। ১৯৪০ সালে প্যারিসের পতনের আগ মুহূর্তে রেডিও ফ্রান্স যথার্থভাবেই এই নাটকটি প্রচার করেছিল। একবার হোসে অর্তেগা ই গাসেত যথার্থই বলেছিলেন— “আমাদের মধ্যে এমন কেউ নেই যে অমলের মতো রাজার কাছ থেকে চিঠি পাওয়ার অপেক্ষায় বসে থাকে না”।
এখনও, এই দগ্ধ সময়েও রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবন-দেবতার কাছ থেকে অপূর্ব সব সুন্দর পত্র আমাদের উপহার দিয়ে যাচ্ছেন প্রতিদিন— আমাদের দ্রোহে, সংগ্রামে, বিপ্লবে, শান্তিতে, অর্জনে, ব্যর্থতায়। আমরা তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ।
শুভ জন্মদিন আমাদের জীবনদেবতা।

Leave A Reply

Your email address will not be published.