কেরলে ভোটে দাঁড়িয়ে ইন্দিরার সিপিএম বিরোধী পথেই হাঁটলেন রাহুল, কংগ্রেস নিয়ে বাংলায় এবার কী জবাব দেবেন সূর্যকান্ত-ইয়েচুরিরা!

রাজনীতিতে কিছু করার চেয়ে বার্তা দেওয়াটা কম বড় কাজ নয়। আর সেই বার্তাকে ট্রানস্লেট করতে হয় ভোট বাক্সে। সেই নিরিখে কেরালায় সরাসরি বামবিরোধী শিবিরে সেনাপতি হতে নেমে পড়লেন কংগ্রেস সভাপতি! যদিও কংগ্রেসের আকবর রোডের ম্যানেজাররা বলছেন, রাহুলের লড়াই বিজেপির বিরুদ্ধেই। কিন্তু তা কি আদৌ বিশ্বাসযোগ্য?
নরেন্দ্র মোদীর সার্জিকাল স্ট্রাইকের সঙ্গে তুলনা টেনে কেরালা সিপিএমের মুখপত্র ‘দেশাভিমানী’তে বলা হয়েছে, ‘রাহুল গান্ধীর এই ওয়েনাড়কে বেছে নেওয়া থেকেই স্পষ্ট, তিনি একজন ব্যর্থ রাজনীতিবিদ।’
সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি দীর্ঘ পোস্টে কেরালার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অচ্যুতানন্দন লিখেছেন, ‘পরিস্থিতি যথাযথ বিবেচনা না করে পদক্ষেপ করার জন্য আমি অতীতে রাহুল গান্ধীকে আমুল বেবি বলেছি। এবার ওয়েনাড়ে রাহুল। এর ফল তো স্পষ্ট, আমরা রাহুল ও বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াই করব।’ আর ‘দেশভিমানী’ অতীতের কথা উল্লেখ করে বলেছে, ‘সবাই জানেন, কংগ্রেসের কৃত কর্মের জন্যই দেশে বিজেপি শাঁসেজলে বিকশিত হয়েছে। সেই অর্থে বিজেপিকে লালনপালন করেছে কংগ্রেস। হিন্দুদের পুজো করার জন্য অযোধ্যার বিতর্কিত জায়গায় দরজা খুলে দিয়েছিল কংগ্রেস। নরসিমা রাওয়ের নেতৃত্বে কংগ্রেস সরকারের আমলেই ধ্বংস হয়েছে বাবরি মসজিদ।’ আসলে সিপিএম বলতে চেয়েছে, কংগ্রেসের নরম হিন্দুত্বের জন্যই বিজেপির আজ বাড়বাড়ন্ত। রাহুল গান্ধী সেই কংগ্রেসের উত্তরাধিকার বলেই ২০১৯ এর নির্বাচনে সব থেকে বড় শত্রু বিজেপি জেনেও, সেই বিজেপির বিরুদ্ধে গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষকে এক করে লড়াই করার বদলে বন্ধুস্থানীয় দলগুলির বিরুদ্ধে লড়াই করতে উদ্যত হয়েছেন।
দলের মধ্যে টানা মতাদর্শগত ও কৌশলগত লড়াই চালিয়ে বিজেপিকে ঠেকাতে কংগ্রেসের সঙ্গে নির্বাচনী বোঝাপড়ার লাইনে কেন্ত্রীয় কমিটির সিলমোহর আদায় করেছিলেন সীতারাম ইয়েচুরিরা। আর ঠিক সেই সময়ই রাহুলের এই অবস্থান দিশেহারা করে দিয়েছে ইয়েচুরি শিবিরকে। বাংলায় বাম-কংগ্রেস আসন সমঝোতা ভেস্তে যাওয়া এবং কেরালায় রাহুল নিজে প্রার্থী হওয়ার পরে বিমান-ইয়েচুরি-সূর্যকান্তদের ‘কংগ্রেস-সখ্য’র লাইন নিয়ে বাম শিবিরে ফের বিতর্ক মাথাচাড়া দিয়ে ওঠাটা সময়ের অপেক্ষা। এর পরে কোথাও আর বাম ও কংগ্রেসের সমঝোতা কীভাবে হবে, সেই প্রশ্ন উঠে গিয়েছে খাস সিপিএমের অভ্যন্তরে।
বাম নেতারা যথার্থই প্রশ্ন তুলেছেন, আমেঠিতে বিজেপি প্রার্থীকে পরাস্ত করার মতো আত্মবিশ্বাস যে নেতার নেই, সেই নেতা কীভাবে বিজেপি বিরোধী জোটের নেতৃত্ব দিতে পারেন? গলা তুলেছেন প্রকাশ কারাট। সিপিএমের প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্য, ‘বিজেপিকে ঠেকানোর জন্য জাতীয় স্তরে কংগ্রেসের যে দায়বদ্ধতা, তার বিরোধী এই সিদ্ধান্ত। কেরালায় বিজেপির বিরুদ্ধে মূল শক্তি হিসেবে বামরাই তো লড়াই করছে। সেই বামদের বিরুদ্ধে রাহুল প্রার্থী হয়ে, আসলে বিজেপি বিরোধী শক্তিকেই আঘাত করতে চেয়েছেন।’ কেরালার মুখ্যমন্ত্রী বিজয়ন বলেছেন, ‘দেশের কাছে কী বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করছে তা কংগ্রেসের ভেবে দেখা উচিত… রাহুল এখানে বিজেপির সঙ্গে লড়তে আসছেন না, আসছেন এলডিএফের সঙ্গে লড়তে।’
আমেঠির পাশাপাশি রাহুলের আরও একটি কেন্দ্রে দাঁড়ানোর পিছনে যুক্তি হিসেবে উঠে এসেছে, আমেঠি আসনটিকে আর নিরাপদ বলে মনে করছে না কংগ্রেস। স্মৃতি ইরানি বা অমিত শাহদের সঙ্গে একমত না হয়েও বলা যায়, আমেঠি আর নেই সেই আমেঠি। ২০১৪ র নির্বাচনে রাহুল স্মৃতিকে হারিয়েছেন ১ লক্ষ ৭ হাজার ৯০৩ ভোটে। কিন্তু যে ৫ টি বিধানসভা নিয়ে অমেঠি লোকসভা গঠিত, ২০১৭ র বিধানসভা নির্বাচনে তার ৪ টিই গেছে বিজেপির দখলে। ১ টি গেছে সমাজবাদী পার্টির পক্ষে। সরল পাটিগণিতেই বলা যায়, কংগ্রেস সভাপতির জন্য আমেঠি সুরক্ষিত নয়। আর কংগ্রেস তার সভাপতির জন্য ন্যূনতম ঝুঁকি নেই, এমন একটা কেন্দ্র চাইতেই পারে। এর মধ্যে কোনও ডিজাইন নেই। সেই নিরিখে উত্তর কেরালার ওয়েনাড় সব শর্তই পূরণ করছে। এই লোকসভা কেন্দ্রের ৪ টি বিধানসভাই কংগ্রেস ও তার সহযোগী আইইউএমএল’র হাতে। ৩ টি আছে সিপিএম নেতৃত্বাধীন এলডিএফের হাতে। জনবসতির দিক থেকে এই কেন্দ্র আদিবাসী অধ্যুষিত বলা চলে। এর আগের দু’বারের ভোটেই এখান থেকে জিতেছিলেন কংগ্রেসের এমআই শানবাস। তবে ২০১৪ সালের ভোটে তাঁর জয়ের ব্যবধান কমেছিল অনেকটাই। তিনি পেয়েছিলেন ৪১.২০ শতাংশ ভোট। বিজেপি এই লোকসভায় দু’বারই ভোট পেয়েছিল ১০ শতাংশের কম। ২০১৪ সালে বিজেপি প্রার্থী ভোট পেয়েছিলেন ৮.৮২ শতাংশ, সেখানে এলডিএফের শরিক সিপিআই প্রার্থী ৩৮.৯২ শতাংশ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় হয়েছিলেন। ফলে ওয়েনাড় কেন্দ্রে রাহুলের প্রধান প্রতিপক্ষ বিজেপি নয়, এলডিএফ। এরপরেও কংগ্রেস নেতৃত্ব কোন মুখে বলেন, রাহুল মূলত বিজেপির বিরুদ্ধেই লড়াই করতে চলেছেন!
এখন কথা হচ্ছে, ট্র্যাডিশনাল আমেঠি যদি নড়বড়ে হয় তবে রাহুল কেন কেরালাকেই বেছে নিলেন? ভূ-ভারতে কী আর কোথাও কংগ্রেস সভাপতির জন্য নিশ্চিত কেন্দ্র নেই! আসলে এখানেই লুকিয়ে আছে একটি সমীকরণ। ১৯৫৭ সালে কেরালা রাজ্যটি গঠিত হওয়ার পর থেকেই কংগ্রেসের প্রধান প্রতিপক্ষ কমিউনিস্টরা। কেরালার প্রথম সাধারণ নির্বাচনে জওহরলাল নেহরু, কামরাজদের কংগ্রেসকে হারিয়ে দেশের প্রথম কমিউনিস্ট সরকার গড়েছিলেন ইএমএস নাম্বুদ্রিপাদ। সেই থেকেই কেরালার বামেরা কংগ্রেসের চক্ষুশূল। এবং তার প্রমাণ, মেয়াদ শেষ হওয়ার অনেক আগে, ১৯৫৯ সালের ৩১ জুলাই নাম্বুদ্রিপাদ সরকারকে ফেলে দিয়েছিল জওহরলাল নেহরুর সরকার। আর এই গোটা রাজনৈতিক চক্রান্তের পাণ্ডা ছিলেন রাহুল-প্রিয়ঙ্কাদের আহ্লাদের ‘দাদি’ ইন্দিরা গান্ধী। কংগ্রেস কেরালার বাম নেতৃত্বকে কোনও দিনই সহ্য করতে পারে না। সব পরিস্থিতিতেই দলের প্রধান প্রতিপক্ষ মনে করে বামদের। সেই ট্রাডিশন সমানে চলেছে। করুণাকরন থেকে এ কে অ্যান্টনি আর হালের ওমান চণ্ডী থেকে কে সি বেণুগোপাল, সেই বামবিরোধী ধারা বজায় রেখেছেন। এমনকী, দেশের সামনে যখন বিজেপি নামক ফ্যাসিস্ত শক্তি শক্তিবৃদ্ধি করছে, তখনও। রাহুল গান্ধী যতই সীতারাম ইয়েচুরির সঙ্গে বিজপি-বিরোধী মঞ্চে গলা মেলান বা বাংলায় বাম-কংগ্রেস আসন সমঝোতা করার জন্য ওয়ান টু ওয়ান বৈঠক করুন না কেন, সেই অতীত থেকে বেরোতে পারেননি! ওয়েনাড়ে বামদের বিরুদ্ধে ভোটে দাঁড়িয়ে ইন্দিরা গান্ধীর সিপিএম বিরোধী পদচিহ্নময় পথেই হাঁটলেন রাহুল।

(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)

Comments are closed.