মাত্র ৩৭ টাকা পকেটে নিয়ে কলকাতায় পা রেখেছিলেন, এখন কোম্পানির মূল্য কয়েক কোটি; পরিশ্রমই যেন বিমল মজুমদারের মূলধন 

কৃষক পরিবারের সন্তান। দরিদ্রতা কী জিনিস জন্মেই বুঝে ছিলেন। কিন্তু অভাব তাঁকে আটকে রাখতে পারেনি। স্কুলে পড়ার সময় থেকেই নিজের চারপাশের পরিস্থিতি পাল্টে ফেলার স্বপ্ন দেখতেন। সম্বল বলতে কিছু একটা করার স্বপ্ন আর কঠোর পরিশ্রম। আর এই দুটিকে হাতিয়ার করেই কার্যত শূন্য পকেটে কলকাতায় এসে আজ তিনি কয়েক কোটি টাকার কোম্পানির মালিক। 

সম্প্রতি অ্যামাজন ইকর্মাসের দৌলতে বিমল মজুমদারের কথা প্রকাশ্যে এসেছে। তাঁর এই শূন্য থেকে শিখর যাত্রা যে কোনও রূপকথাকেও হার মানাতে পারে। ১৯৯২ সাল, মাধ্যমিক পাস করেন বিমল কুমার। বাবা পেশায় কৃষক। মা বাড়িতেই থাকেন। রয়েছে, এক ভাই এবং বোন। মাধ্যমিক পাশের পরেই বোঝেন, বাবার যা আর্থিক অবস্থা তাতে করে তাঁর পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব না। ওই কিশোর বয়েসেই পরিবারকে সাহায্য করতে গ্রামেই চালের ব্যবসা শুরু করেন। কিন্তু কয়েক দিন পরেই বুঝতে পারেন, এতে করে তাঁর প্রয়োজন মিটবে না। এক বন্ধু কলকাতায় থাকতেন। সেই বন্ধুর ঠিকানা নিয়ে বাড়িতে শুধু মা’কে জানিয়ে বনগাঁ থেকে রওনা দেন। এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, তাঁর বাড়ি ছাড়ার কথা বাবা’কে বলতে পারেননি। তাঁর কথায়, বাবা আমায় এত ভালোবাসত, যে আমি বাড়ি ছাড়ছি শুনলে আসতে দিতেন না। 

ওই সময়ে কলকাতা শহরে যখন পা রাখলেন, তখন তাঁর পকেটে পড়ে মাত্র ৩৭ টাকা। কয়েক দিন বন্ধুর আশ্রয়ে থেকে দীর্ঘ খোঁজাখুঁজির পর শহরের এক মিষ্টি দোকানে কাজ পেলেন। কিন্তু মিষ্টি দোকানের ওই কাজ করে তিনি বুঝতে পারছিলেন, এ ভাবে চলতে থাকলে তিনি কোনও দিনই তাঁর স্বপ্ন সফল করতে পারবেন না। অতীতের স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে বললেন, মিষ্টি দোকানেই ওই পরিশ্রম, তার পর রাতে ছাদে চিনির বস্তা পেতে আর মাথায় ইট দিয়ে ঘুমোতে হত। এরকম বেশ কিছু দিন চলার আরও কয়েক জায়গায় কাজ করে এক কোম্পানিতে সিকিউরিটি গার্ডের চাকরি পান বিমল। এর পর সেখান থেকে এক লেদার কারখানায় সিকিউরিটি গার্ডের চাকরি। তাঁর কথায়, ওই চাকরিই এক কথায় আমার জীবননের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। লেদার জিনিস কীভাবে তৈরি হয়, আমি সেই কাজটা শিখতে চাইছিলাম। বুঝতে পারছিলাম এটা থেকে কিছু করা যেতে পারে। কোম্পানির এক ম্যানেজারের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক তৈরি হয় তাঁর। সকাল ১০ টা থেকে রাত ১০ টা, ১২ ঘন্টা গার্ডের কাজ করে ওই কোম্পানিতেই লেদার গুডস বানানো শিখতে শুরু করলেন। এরপর প্রায় তিন বছর ওই কোম্পানিতে চাকরি করেন তিনি।  

এর মাঝেই বাবা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। বাবার চিকিৎসার খরচ, নিজের কাজ, সেই সঙ্গে ব্যবসা করার স্বপ্ন, বিমলের কথায়, ওই সময়টা নিজেকে শুধু বলতাম পরিবারের পাশে দাঁড়াতে গেলে, ব্যবসা করতে গেলে আমায় আরও পরিশ্রম করতে হবে। পরিশ্রম ছাড়া আমার কিছু করার নেই। এর মাঝেই বাবার মৃত্যু। ওই সাক্ষাৎকারেই তিনি জানান, সে সময়ে তিনি যেখানে চাকরি করতেন, সেই কোম্পনিতে তাঁর বাবার মৃত্যুর খবর পৌঁছলেও কোম্পানি তাঁকে জানায়নি। পরে বন্ধুদের কাছ থেকে জানতে পেরে গ্রামে ছুতে যান। সেই অভিমানে তিনি কোম্পনির চাকরিটিও ছেড়ে দেন। এরপর গ্রামের এক পরিচিতের সঙ্গে মুম্বাই চলে যান কাজের খোঁজে। 

কিন্তু মুম্বাইতেও বেশি দিন থাকা হয়নি তাঁর। এর পর কলকাতায় ফিরে ফের এক কোম্পানিতে সামান্য চাকরি। যদিও এবারে চাকরির পাশাপাশি নিজের ব্যবসাও শুরু করে দিলেন। নিজেই বাড়িতে লেদারের প্রডাক্ট বানাতেন। সকাল ১০ টা পর্যন্ত বাড়িতে প্রডাক্ট বানানোর কাজ করতেন। এরপর অফিস। সন্ধ্যে সাড়ে সাতটায় ফিরে নিজের তৈরি সেই লেদারের জিনিসপত্র বিক্রি করতে বেরোতেন।  প্রথম প্রথম সেই প্রডাক্ট কেউ কিনতেও চাইতেন না। বিমল জানান, এই ভাবেই প্রোডাক্ট নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে একদিন ঘটনাচক্রে খাদিম কোম্পনির মালিকের সঙ্গে আলাপ হয়। তাঁর কাছ থেকেও ব্যবসা করা নিয়ে উৎসাহ পাই। পাশাপাশি সেই সময় অনলাইন সাইটগুলোতেও প্রডাক্ট বিক্রি শুরু করি। ব্যবসা বাড়তে বাড়তে এক সময়ে মাসে দেখি শুধু অনলাইনেই আমার ৪ থেকে ৫ লক্ষ টাকার বিক্রি হচ্ছে। বর্তমানে বিমল মজুমদারের তৈরি লেদার জাংশন কোম্পানির বাজার মূল্য ৪ কোটি টাকারও কিছু বেশি। নিজের এই দীর্ঘ লড়াইয় সম্পর্কে বলতে গিয়ে তাঁর মন্তব্য, জীবনে ঝুঁকি নিতে কখনও ভয় পায়নি। আসলে আমার শুরুটাই তো শূন্য থেকে তাই হারানোরও কিছু নেই। পরিশ্রমই সফল হওয়ায় একমাত্র রাস্তা, আর কিচ্ছু নয়।   

Comments are closed.