দীর্ঘ ১ দশক সুন্দরবন রক্ষার জন্য লড়ছেন, স্কুল মাস্টার উমাশঙ্কর এখন বাদাবনের মানুষের কাছে ‘ম্যানগ্রোভ ম্যান’ 

সুন্দরবনের রক্ষাকবচ ম্যানগ্রোভ।ভূগোলের শিক্ষক হিসেবে বিলক্ষণ জানতেন এই সত্যটি।তাই নিজের জন্মভূমিকে বাঁচাতে দীর্ঘ ১ দশকের বেশি সময় ধরে প্রায় সাড়ে সাত লক্ষ ম্যানগ্রোভ গাছ লাগিয়েছেন তিনি।সম্প্রতি নিজের এই বিরাট কর্মকাণ্ডের জন্য প্রথম বাঙালি তথা ভারতীয় হিসেবে ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ড( ডব্লিউ ডব্লিউ এফ)-এর ড: রিমিংটন পুরস্কার পেয়েছেন উমাশঙ্করের মন্ডল।পেশায় স্কুল শিক্ষক উমাশঙ্কর সুন্দরবনের মানুষের কাছে ‘ম্যানগ্রোভ ম্যান’। 

আগামী ১২ জানুয়ারি স্বামী বিবেকানন্দের জন্মদিন উপলক্ষ্যে সুন্দরবনের কুমিরমারিতে প্রায় ১০০ বিঘে জমিতে ম্যানগ্রোভ রোপণের পরিকল্পনা করেছেন তিনি। একজন স্কুল মাস্টার থেকে ‘ম্যানগ্রোভ ম্যান’ হয়ে ওঠার যাত্রাপথ নিয়ে TheBengalStory-এর সঙ্গে কথা বললেন উমাশঙ্কর। 

২০০৯ সালে বিধ্বংসী আয়লা ঝড়ে পুরো সুন্দরবন কার্যত ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল।ঝড়ে রক্ষা পায়নি নিজের বাড়িও।পরিবারের লোকজন আশ্রয় হারিয়ে যখন লঞ্চে ঠাঁই নিয়েছে, উমাশঙ্কর গ্রামের পর গ্রাম ছুটে বেড়িয়েছেন ত্রাণ নিয়ে। বললেন, ওই সময় অনুভব করলাম শুধু ত্রাণ সামগ্রী দিয়ে কিছু হবে না।এখানকার মানুষদের বাঁচাতে কোনও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা দরকার। আর সেখান থেকেই ম্যানগ্রোভ গাছ লাগানোর পরিকল্পনা নেন। 

নদীতে ভেসে আসা ম্যানগ্রোভর বীজ আর স্থানীয় ২২০ জন গ্রামবাসীকে নিয়ে গাছ লাগানোর কাজ শুরু করেন।গাছ লাগাতে ও আনুষঙ্গিক কাজে অনেক টাকার দরকার ছিল। নিজের বেতনের একটা বড় অংশ খরচ করে কাজ শুরু করেন তিনি। জানালেন, পরে পরিচিতরা অনেকেই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। বর্তমানে  এই বিরাট কর্মকান্ডে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে প্রায় ১ হাজার জন তাঁর সঙ্গে রয়েছেন। 

কথায় কথায় উমাশঙ্কর জানালেন, কাজের জন্য লোকবল, টাকা সবকিছু জোগাড় হলেও রাজনৈতিকভাবেও তাঁকে বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে এবং এখনও হয়। ২০০৯ সালে রাজ্য রাজনীতির পালাবদলের সন্ধিক্ষণে একাধিকবার তাঁর উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন একাধিক স্থানীয় নেতৃত্বে। মাঝে মাঝে চূড়ান্ত হতাশাও গ্রাস করেছে। 

এত সমস্যার মাঝে কখনও মনে হয়নি এসব ছেড়ে দিতে ? প্রশ্ন শুনে বেশকিছুটা সময় চুপ করে গেলেন ভূগোলের শিক্ষক।তারপর কিছুটা হেঁসেই বললেন, সত্যি কখনও কখনও খুব বিরক্ত হয়েছি। আমি তো নিজের জন্য কিছু করছি না। এটাই অনেকে বুঝতে চায় না। তবে কি জানেন, আমি জানি আমার সঙ্গে ৯৯% মানুষ রয়েছে। বাকি ১% আমার বিরুদ্ধে।এগুলো সব জায়গাতেই থাকে। এখন ওঁদের সামলানোর উপায় শিখে গিয়েছি। 

সুন্দরবনের গোসবার সাতজেলিয়া দ্বীপের চরঘেরিতে বাড়ি উমাশঙ্করের। মুর্শিবাদের জঙ্গীপুর হাইস্কুলে ভূগোল পড়ান তিনি। কাজের সঙ্গে সঙ্গে বেশিরভাগ সময়টাই তাঁর কেটে যায় সুন্দরবনের মানুষদের নিয়ে। জানালেন, ছোট থেকেই মানুষের সঙ্গে মিশতে ভালোবাসেন। 

সুন্দরবনবাসী হিসেবে এখানকার মানুষের উন্নতির পথে মূল বাধাটা কী বলে আপনার মনে হয়? দেখুন, সুন্দরবন নিয়ে সরকার অনেক পরিকল্পনা নিয়েছে। অজস্র এনজিও, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনও এখানে এসে কাজ করছে। তবে আমার মনে হয়, এখানে কোনও প্রকল্পের কাজই ধারাবাহিক ভাবে দেখা হয়না। সরকার থেকে হয়তো গাছ লাগানো হল। কিন্তু সেগুলোর পরিচর্যার অভাবে কিছুদিনের মধ্যে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। শুধু ত্রাণ দিয়ে কিন্তু সমস্যার সমাধান হবে না। 

উমাশঙ্করের দাবি, একমাত্র পর্যটন শিল্পের হাত ধরেই সুন্দরবন ঘুরে দাঁড়াতে পারে। বললেন, এখানে পর্যটনের ব্যাপক সম্ভবনা রয়েছে। শুধু রিসোর্ট নয়, পর্যাপ্ত হোম-স্টে করতে হবে। দেখুন আমার মনে হয়, মাটির বাড়িতে বসে কোনও নির্জন সন্ধ্যায় বাঘের গর্জন শোনার জন্য সুন্দরবনে পর্যটক ছুটে আসতে বাধ্য। আর যাই হোক রিসোর্টে থাকলে আপনি জঙ্গলের অনুভূতি পাবেন না। 

  

Comments are closed.