ফলবতী গাছের বুকে নীলচে হাহাকার।

বিশ্বজুড়ে চলছে মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ আর কট্টরপন্থীদের ভয়াবহ সন্ত্রাস আগ্রাসন। লেখক, প্রকাশক, ব্লগার, সাংবাদিকসহ মুক্তচিন্তার মানুষদের ধরে ধরে হত্যা করা হচ্ছে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায়। গত ১১ জুন বাংলাদেশের মুন্সীগঞ্জে নির্মমভাবে হত্যা করা হলো লেখক ও প্রকাশক শাহাজান বাচ্চুকে। এর আগেও একের পর এক মুক্তচিন্তার মানুষদের হত্যা করা হয়েছে বাংলাদেশে। ১৯৯৯ সালের ১৮ জানুয়ারি হত্যার উদ্দেশ্যে আক্রমণ চালানো হয়েছিল কবি শামসুর রাহমানের ওপর। ২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি বইমেলা থেকে বাড়ি ফেরার পথে মৌলবাদীদের আক্রমণের শিকার হন প্রথাবিরোধী লেখক, ভাষাতাত্ত্বিক অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ। একই বছরের ২৪ ডিসেম্বর হত্যা করা হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ডঃ ইউনুসকে। ২০১৩ সালের শাহাবাগ আন্দোলনের সময় থেকেই মৌলবাদী গোষ্ঠী একের পর এক ব্লগারকে হত্যা শুরু করে। প্রশ্নের মধ্য দিয়ে, যুক্তি আর চিন্তার মধ্য দিয়ে যাঁরা বিজ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনের স্বপ্নে কাজ করছিলেন, তাঁদের একে একে স্তব্ধ করে দেওয়ার ষড়যন্ত্রে নামে যুদ্ধাপরাধী মৌলবাদী গোষ্ঠীগুলো।
ব্লগার ও স্থপতি রাজীব হায়দার থেকে শুরু করে আরিফ রায়হান দীপ, জগেজ্যাতি তালুকদার, লেখক অভিজিত রায়, অনন্ত বিজয় দাস, নীলাদ্রী নীল, ওয়াশিকুর রহমান বাবু, প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপনসহ আরও অনেককে হত্যা করা হয়েছে তাঁদের সৃষ্টিশীল কাজ আর মুক্তচিন্তার জন্যে। একইরকম ঘটনা ঘটছে ভারতেও। গত বছরের ৫ সেপ্টেম্বর মৌলবাদ ও উগ্রবাদের বিরুদ্ধে লেখালেখির কারণে নিজ বাড়ির সামনে খুন হন ভারতের বেঙ্গালুরুর সাংবাদিক গৌরী লঙ্কেশ। ২০১৩ সালের অগাস্টে হত্যা করা হয় অন্ধবিশ্বাস বিরোধী ও যুক্তিবাদী আন্দোলনের নেতা মহারাষ্ট্রের নরেন্দ্র দাভোলকরকে। মহারাষ্ট্রের কমিউনিস্ট বিধায়ক গোবিন্দ পানসারকে হত্যা করা হয় ২০১৫ সালে। এছাড়াও লেখক এম এম কুলবর্গীকে হত্যা করে ভারতের কট্টরপন্থীরা। পৃথিবী জুড়ে এসব নির্বিচার হত্যাকাণ্ড চলছে। আইএসের (ইসলামি স্টেট) হাতে নিহত মার্কিন সাংবাদিক জেমস ফলির কথা আমরা জানি। সাংবাদিক স্টিভেনস সটলফের ওপর নির্যাতনের কথা আমরা জানি। এভাবেই আমাদের প্রিয় পৃথিবীটা চলে যাচ্ছে মৌলবাদ আর জঙ্গিবাদের হাতে। তাদের ভয়াবহতা আর নৃশংসতা দিনকে দিন বেড়েই চলছে—কী সিরিয়ায়, আমেরিকায়, আফগানিস্তানে, মেক্সিকো, ভারত বা বাংলাদেশে। এ থেকে উত্তরণের জন্যে আমরা রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে কোনও কার্যকর পদক্ষেপও দেখছি না। দিনকে দিন এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে চলছে জঙ্গি সন্ত্রাসীরা। আর তাদের বিচারের আওতায় আনতে চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হচ্ছে রাষ্ট্রগুলো। আন্তর্জাতিক নানা মহলে নানা গালভরা প্রতিশ্রুতি থাকলেও শেষ পর্যন্ত সেগুলোও কেবলই কথার কথা থেকে যাচ্ছে। জঙ্গি সংগঠনগুলোর কাছে যারা অস্ত্র বিক্রি করছে, তারাই বিভিন্ন ধর্মীয় উন্মাদনাকে কাজে লাগিয়ে সন্ত্রাসবাদের মদত দিয়ে যাচ্ছে। দিন শেষে আক্রান্ত হচ্ছে মুক্তচিন্তা, দিন শেষে ধসে পড়ছে আমাদের স্বাধীনভাবে চিন্তা করার ক্ষমতা।
সারা পৃথিবীর দিকে তাকালেই আমরা দেখতে পাই, রাষ্ট্রগুলোও এ বিষয়ে অনেকটাই দর্শকের ভূমিকা পালন করছে। কোনও কোনও রাষ্ট্র সরাসরি মৌলবাদকে মদত দিয়ে যাচ্ছে তাদের ক্ষমতার আসন পাকাপোক্ত করার জন্যে। মৌলবাদ ও উগ্রবাদের বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক এবং বিজ্ঞানভিত্তিক দর্শনের যে জয়যাত্রা থাকার কথা ছিলো, তাও দিনে দিনে ক্ষীণ হয়ে আসছে। ক্ষমতার নানামাত্রিক ব্যবহারে আমাদের সাংস্কৃতিক আন্দোলনগুলো ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। কোনও সাংস্কৃতিক সংগঠন মৌলবাদীদের মদত দেওয়া রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার তাঁবেদারি করছে। অন্যদিকে, বিজ্ঞানের যে যুক্তিবাদী অবস্থান, তাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে নানা ভাবে। মুক্তচিন্তার গ্রন্থগুলোর ওপর দেওয়া হচ্ছে নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পালনের ওপর আরোপ করা হচ্ছে নানাবিধ বিধি-নিষেধ। ফলে রাষ্ট্রীয়ভাবে কোথাও কোথাও প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে কূপমণ্ডূকতাকে। এতে জঙ্গিবাদ, মৌলবাদ আরও মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। কোনও কোনও রাষ্ট্রের প্রশাসন ও বিচার ব্যবস্থাও আক্রান্ত হচ্ছে এই মৌলবাদী ভাইরাসে। ফলে বিচারের বিষয়ে বিচারব্যবস্থার স্বচ্ছতা ও আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
মৌলবাদীদের এ আস্ফালনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে প্রগতিশীলদের একতাবদ্ধ হওয়ার বিকল্প নেই। কিন্তু প্রগতিশীলরা এত মতে আর পথে বিভক্ত যে বৃহত্তর স্বার্থের আন্দোলন সম্ভব হচ্ছে না। অপরপক্ষে মৌলবাদীরা বিভিন্ন রাষ্ট্রে সংখ্যাগুরুদের ধর্মকে অবলম্বন করে তাদের উগ্রবাদকে প্রতিষ্ঠিত করছে। এক সময় প্রগতিশীল বামপন্থী আন্দোলনের যে পথ ছিল, তা আজ অনেকটাই সরু হয়ে এসেছে। মৌলবাদীরা ধর্মকে ব্যবহার করে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পথ রুদ্ধ করে দিচ্ছে। ফলে প্রান্তিক মানুষের কাছে গিয়ে তাদের অধিকার সচেতন করার যে আন্দোলন, তা মুখ থুবড়ে পড়েছে। সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ভূমি দখল করছে ধর্মীয় উগ্রবাদের ভূমি। এ পরিস্থিতি দিনকে দিন আরও ভয়াবহ হচ্ছে।
এ কথা অনস্বীকার্য যে মৌলবাদের ভয়াল এই থাবাকে প্রতিহত করতে হলে সর্বত্র একটি সাংস্কৃতিক জাগরণ তৈরি করতে হবে। যে অস্ত্র আমাদের সহযোদ্ধাদের বিশ্বব্যাপী আঘাত করছে, তাকে দমন করতে হলে মুক্তচিন্তার আকাশকে ছড়িয়ে দিতে হবে সারা পৃথিবীতে।

Leave A Reply

Your email address will not be published.