শিলচর রেলস্টেশনের নাম ‘ভাষা শহিদ স্টেশন’ করার গণদাবিকে উপেক্ষা করা প্রমাণ করে, যতই আমরা সর্ববৃহৎ গণতন্ত্রের গর্ব করি না কেন আমাদের দেশ ও সমাজে গণতন্ত্রের নাভিশ্বাস উঠেছে এবং প্রায় সব সামাজিক প্রতিষ্ঠান মৃত্যু সজ্জায় শায়িত। যেভাবে গৌরবময় ইতিহাসকে বাঁচিয়ে রাখার সংকল্প নিয়ে শিলচরের প্রায় সব সাংস্কৃতিক সংগঠনের সদস্য-সদস্যারা মাঠে নেমে সংগ্রাম করেছেন, মিছিলে পথে হেঁটেছেন, দিল্লি, দিশপুর ছুটে গেছেন এবং প্রত্যেকবার মিথ্যে প্রতিশ্রুতি, দ্বিচারিতা, ভন্ডামি এবং বিভাজনের কুট কৌশলের কাছে পরাজিত হয়েছেন, তা মনে অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। এই সব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার মধ্যে দিয়ে স্বার্থক হউক ২০১৮র ১৯ শে।
শিলচর স্টেশন
আগের সরকারের মুখ্যমন্ত্রী কেন্দ্রের স্বরাষ্ট্র দফতরে চিঠি পাঠিয়ে দিয়েছেন বলে বিবৃতি দিয়েছিলেন। কিন্তু পরে প্রমাণিত হয়, চিঠি আদৌ যায়নি। তারপর যখন সত্যি সত্যি গেল তখন কেন্দ্রের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক জানাল, ৬১র ভাষা আন্দোলন হল ‘আঞ্চলিক দেশপ্রেম’। ৬১ র ভাষা আন্দোলনকে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী স্বতঃস্ফুর্ত গণঅভ্যুত্থান বলেছিলেন। আর পি চিদাম্বরম সেই ভাষা আন্দোলনকে অভিহিত করলেন ‘আঞ্চলিক দেশপ্রেম’ বলে। একেই বলে নিয়তির পরিহাস। দেশপ্রেম কি করে খন্ডিত হয়? তবে তো বলতে হয় তেলেঙ্গানা বিদ্রোহ, চৌরিচৌরা আন্দোলন, চট্টগ্রাম আন্দোলন সব কয়টি আন্দোলন আঞ্চলিক। বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অন্তরেই এই সব চিন্তার জন্ম হয়। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী নিজে যে পোশাকে সংসদে আসতেন তাতে কি মন্তব্য করা উচিত ছিল, পি. চিদাম্বরমের চিন্তা বা দৃষ্টিভঙ্গি আঞ্চলিক?
কিন্তু সে তো অনেক আগের কথা। ইতিমধ্যে কেন্দ্রীয় সরকার বদল হয়েছে। কেন্দ্র সরকারের সদর্থক পদক্ষেপ আছে মনে করে এই দাবির সমর্থনে আন্দোলনকারীদের মনে নূতন আশার সঞ্চার হয়েছিল। কেন্দ্র-রাজ্য চিঠি চালাচালি হল, তা রাজ্য থেকে জেলায় আসল। জেলাস্তরের উপায়ুক্ত ও পুলিশ অধীক্ষকের মধ্যে আর এক প্রস্থ চিঠি চালাচালি হল। পরে ‘নো অবজেকশন’ পাঠানো হল রাজ্য সরকারের কাছে। হা হতোস্মি। চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে আবার পুনঃমুষিক হয়ে গেল। জানা গেল, অন্য এক ভাষিক গোষ্ঠীর নাকি এতে আপত্তি আছে। যে ভাষিক গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে আপত্তি উত্থাপিত হয়েছে বা যে ব্যক্তির নামে স্টেশনের নামকরণের দাবি উঠেছে, ইতিহাস বলছে, এই দাবির সাথে স্টেশনের নামের কোনও প্রত্যক্ষ সম্পর্ক নেই। এখন প্রশ্ন, কেন এই দাবি? যে দাবি ন্যায়সঙ্গত নয়, যুক্তিসঙ্গত নয়, সেই দাবিকে শিখন্ডী বানিয়ে এতদিনের লাগাতার গণআন্দোলনকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়া অবশ্যই ধৃষ্টতা এবং গণতন্ত্রবিরোধী কার্যকলাপ। ভাষা শহিদের নামে স্টেশনের দাবিতে সব ভাষিক গোষ্ঠীকে উল্লেখ করা হয়েছে, কোনও বিশেষ গোষ্ঠীর কথা উল্লেখ করা হয়নি। আমাদের মধ্যে কোনও বিতর্ক থাকতে পারে, সেটা স্বতন্ত্র বিষয়। কিন্তু তোমরা কে হে বাপু, বিভেদের বীজ পুঁততে এসেছ? উন্নত সংস্কৃতির ঐতিহ্যস্নাত উদারচেতা বাঙালিকে আর কতটা মূল্য দিতে হবে? আমাদের সহনশীলতাকে দুর্বলতা ভাবা ভুল হবে । একমাত্রিক জাতীয়তাবোধ ও উগ্রপ্রাদেশিকতাবাদের জন্য আসামের বাঙালিকে অনেক মূল্য দিতে হয়েছে, মূল্য দিতে হচ্ছে, হবেও। অর্জুন নমঃশূদ্র থেকে শুরু করে অনেককে ডিটেনশন ক্যাম্পে মরতে হয়েছে। আর যাঁরা বেঁচে আঁছেন তাঁদের নারকীয় যন্ত্রণা পোহাতে হচ্ছে কেন? অথচ নির্বাচনী ইশতেহারে অনেক কিছুই বলা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, ডিটেনশন ক্যাম্প গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে। হয়েছে কি? হয়নি তো। কেন হল না? বলা হয়েছিল, ১৯৭১ এর পর আসা সমস্ত হিন্দু শরনার্থীকে নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। এই নিয়ে অসমের আকাশে, বাতাসে, জলে, স্থলে অশান্তির জন্ম দেওয়া হয়েছে। হাজার হাজার লোক বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছে উত্তেজনায়। থর থর করে কাঁপছে আর স্লোগান দিচ্ছে।
শহিদ বেদি
এর পর বাঙালিদের শাপ শাপান্ত করে বলা হচ্ছে, অসমীয়া ভাষা বিপন্ন। আর বলা হচ্ছে, অসম শরনার্থীদের বোঝা নিতে পারবে না। কি বিচিত্র প্রহেলিকা! ১৮৭৪ এ বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি থেকে সুরমা উপত্যকাকে কেটে অসমে লাগিয়ে দেওয়া হল। অসমের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য। কারণ, অসমের রাজস্ব খুব কম ছিল। পরবর্তী সময় দেশ ভাগের সময় সুরমা উপত্যকাকে গণভোটের মাধ্যমে ছেটে ফেলা হল। তারপর ১৯৪৭ এর ১৪ আগষ্ট এর মধ্য রাতে যখন আলোর রোশনাইয়ে আলোকিত দিল্লি, তখন অন্ধকার সর্পিল রাস্তা দিয়ে আমাদের পিতা, পিতামহ, মাতা, মাতামহীদের রক্ত ঝরানো পায়ে পাকিস্তান থেকে ইন্ডিয়াতে প্রবেশ। কয়েকশ একর জমিজমা রেখে ছিন্নমূল হয়ে শরনার্থী পরিচয়ে ‘রিফিউজি ক্যাম্প’। আত্মীয়ের বাড়িতে বা কেউ ভাড়াটে হয়ে জীবন শুরু করলেন।
দেশভাগের সত্তর বছর পরেও নাগরিকত্বের অগ্নি পরীক্ষা দিতে হচ্ছে আমাদের। এই উপত্যকায় বা সমগ্র অসমে যে ছিন্নমূল মানুষরা এসেই বসতি স্থাপন করেছেন, এমনও নয়। প্রায় দ্বিশত বর্ষের অধিক এই উপতক্যায় বাঙালি জনবসতির, বাঙলা সাহিত্য চর্চার প্রমাণ আছে। আজ আকাশে বাতাসে স্লোগান উঠছে, অসমীয়া ভাষার সংকটের জন্য বাঙলা দায়ী। অথচ ভাষাচার্য সুনীতি চট্টোপাধ্যায় এবং বাঙলার বাঘ স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় সদর্থক পদক্ষেপে অসমীয়া ভাষার প্রচার প্রসার ও উন্নতির জন্য কতটা কী করেছেন, তার মূল্যায়ন না করে বাঙলাকে ও বাঙালিকে কাঠগড়ায় তোলা হচ্ছে। আরও একটা মিথ তৈরি করে প্রচার মাধ্যমে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, এই উপতক্যার সব বাঙালি বাংলাদেশ থেকে এসেছেন। বাংলাদেশ, মায়ানমার, পাকিস্তান, চীন, ভুটান, নেপালসহ বিভিন্ন দেশের আন্তর্জাতিক সীমানা বিভিন্ন রাজ্যের সাথে ভাগ করেছে। অন্য কোথাও বিদেশি বিতাড়নের সমস্যা নেই, সব সমস্যা এসে ভিড় করেছে এই রাজ্যে। ছয়ের দশকে ‘বাঙাল খেদা’ সাতের দশকে ‘বিদেশি খেদাও’ আর এখন ন্যাশনাল রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট নবায়ন পক্রিয়ার নামে চূড়ান্ত হয়রানি এক সূত্রে বাধা। একদিকে একমাত্রিক জাতীয় দল, অন্যদিকে উগ্র প্রাদেশিকতাবাদী আঞ্চলিক দলের জোটবন্ধন এই উপতক্যার অস্তিত্ব রক্ষার আন্দোলনকে চূড়ান্ত পর্যায় নিয়ে গেছে।
আমাদের রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব নেই। আমাদের হয়রানির জন্য দায়ী যে অসম চুক্তি, তা চুক্তি রুপায়নের সময় এই উপত্যকার কোনও প্রতিনিধি ছিল না। আগামীতে আলফার সাথে যদি কোনও চুক্তি হয় অবস্থা আরও ভয়াবহ হবে। জাতীয় ও রাজ্যিক দলের নের্তৃত্ব ও সদস্যদের এই উপত্যকার কথা আলাদাভাবে ভেবে দেখার অবকাশ নেই। সেদিক থেকে বিচার করলে ৬১ র ভাষা আন্দোলন ব্যর্থ, কেননা, সুদীর্ঘ সময়ের ব্যাবধানে এই উপত্যকার কথা বলার মতো কোনও রাজনৈতিক মঞ্চ তৈরি হল না। তা হলে সামান্য এক স্টেশনের নাম পরিবর্তন নিয়ে এত নাটকের প্রয়োজন হত না। ১৯৫২ ভাষা আন্দোলনে সালাম বরকত ভাইয়েদের আত্মবলিদান যদি এক স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের জন্ম দিতে পারে, তবে ৬১র ১৯ কেন একটা আলাদা রাজ্যের জন্ম দিতে পারল না, এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে। মুম্বইয়ে রেল স্টেশনের নাম বাল গঙ্গাধর তিলকের নামে আছে, অথচ লাল-বাল-পালের অন্যতম বিপিন চন্দ্র পালের কথা এই উপত্যকায় কয়জন সম্মান ও শ্রদ্ধার সাথে আজ মনে রেখেছে সন্দেহ হয়। নৈর্ব্যক্তিক শুদ্ধ ইতিহাস চর্চা ও অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবোধের লক্ষ্য নিয়ে ১৯শের কর্মসূচি সাংস্কৃতিক ব্যাপ্তি ছাড়িয়ে যেদিন রাজনৈতিক এজেন্ডা হবে, সেই দিন শহিদের আত্মবলিদান যথার্থ সার্থক হবে।