বিজেপির সঙ্গে সম্পর্ক, দক্ষিণ দিনাজপুরের জেলা কমিটির সদস্যকে বহিষ্কার করল সিপিএম। আইওয়াশ নয় তো? প্রশ্ন দলেই।

সিপিএম-বিজেপি আঁতাতের অভিযোগ ফের প্রকাশ্যে। যা নিয়ে গত কয়েক দিন ধরে তীব্র ডামাডোল দক্ষিণ দিনাজপুর জেলা সিপিএমের অন্দরে। শেষমেশ বিতর্ক এড়াতে, বিজেপির সঙ্গে সম্পর্ক রাখার অভিযোগে দক্ষিণ দিনাজপুরে সিপিএম জেলা কমিটির এক সদস্যকে দল থেকে বহিষ্কার করা হল। দক্ষিণ দিনাজপুর জেলা সিপিএম সূত্রে খবর, শুক্রবার জেলার তপন এরিয়া কমিটির সম্পাদক এবং জেলা কমিটির সদস্য নিরদ দাসকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অভিযোগটা প্রথম তুলেছিলেন সরাসরি বিমান বসুর কাছে। বিমান বসু তখন সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক এবং বামফ্রেন্টের চেয়ারম্যান। রাজ্যে সন্ত্রাসের অভিযোগ তুলে বামফ্রন্টের নেতাদের নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ডেপুটেশন দিতে নবান্নে গিয়েছিলেন। সেটা ২০১৪ সালের জুন মাস। লোকসভা ভোটের পর। সেটাই রাজ্যে প্রথম ভোট, যেখানে বিজেপির উত্থানের প্রথম স্পষ্ট ইঙ্গিত মেলে।
সেদিন বিমান বসুদের ফিশ ফ্রাই খাইয়ে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আপনাদের ভোট সব বিজেপিতে চলে যাচ্ছে কেন? নিজেদের ভোট ধরে রাখতে পারছেন না কেন’? মুখ্যমন্ত্রীর এই বক্তব্যের তীব্র বিরোধিতা করেছিল রাজ্য সিপিএম। বলেছিল, তৃণমূলের জন্যই রাজ্যে বিজেপির উত্থান, সিপিএমের কেউ সেখানে যাচ্ছে না। তারপর গঙ্গা দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে। গত চার বছরে রাজ্যবাসী দেখেছেন, কীভাবে রাজ্যে ক্রমেই ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে সিপিএম, কীভাবে শক্তিবৃদ্ধি করেছে বিজেপি। কিন্তু রাজ্যে বিজেপির এই শক্তিবৃদ্ধি কার তাকতের ওপর দাঁড়িয়ে?
২০১৬ বিধানসভা নির্বাচন পরবর্তী সময়ে রাজ্যে যত উপনির্বাচন হয়েছে, সর্বত্র এই লক্ষণ স্পষ্ট। তমলুক, কোচবিহার এবং উলুবেড়িয়া লোকসভা আসন কিংবা কাঁথি দক্ষিণ, সবং, নোয়াপাড়া বিধানসভা উপনির্বাচনে বিজেপির ভোট বেড়েছে ব্যাপক হারে। কোচবিহার এবং উলুবেড়িয়াতে তো বামেদের জামানতই জব্দ হয়েছে। এই আসনগুলিতে তৃণমূলের ভোটও বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রায় সব জায়গাতেই তৃণমূলের ভোট বেড়েছে ২-৪ শতাংশ। বিজেপির ভোট বেড়েছে ১০-১২ থেকে ২২-২৫ শতাংশ, আর সিপিএম কিংবা বামেদের ভোট কমেছে ১৫ থেকে ২৫ শতাংশ। কার ভোট কোথায় যাচ্ছে, তা জানার জন্য এরপরও একের পর এক রাজ্য কমিটির মিটিংয়ে ‘তৃণমূল এবং বিজেপিকে সমান বিপদ’ বলে তত্ত্ব আওড়ে চলেছেন ৩১ নম্বর আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের নেতারা।
কিন্তু গত দু’বছর ধরে রাজ্যে হওয়া বিধানসভা কিংবা লোকসভা নির্বাচনকেও ছাপিয়ে গিয়েছে এবারের পঞ্চায়েত ভোট। সেখানে তৃণমূলের বিরুদ্ধে গ্রামস্তরের লড়াইয়ে প্রায় সব জেলায় সিপিএমের একাধিক স্থানীয় নেতা প্রকাশ্যে বিজেপির সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন বলে বারবার অভিযোগ উঠেছে। এমন ঘটনাও ঘটেছে, গ্রামের সিপিএম নেতারা সরাসরি স্থানীয় পার্টি অফিসে গিয়ে দাবি জানিয়েছেন, ‘এবার পঞ্চায়েতে প্রার্থী দেওয়ার দরকার নেই। বিজেপিই বরং লড়ুক, আমরা বিজেপিকে সমর্থন করে তৃণমূলকে হারাব’। স্থানীয়স্তরের নেতাদের এই অভিযোগের সামনে বহু ক্ষেত্রে জেলা নেতারা মাথা ঝুঁকিয়েছেনও। যদিও বিজেপির সঙ্গে তাঁদের আঁতাতের এই অভিযোগ বারবার অস্বীকার করেছেন আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের নেতারা। কিন্তু ঘটনা চাপা থাকেনি মে মাসের শেষে সিপিএমের রাজ্য কমিটির মিটিংয়ে। বিভিন্ন জেলার একাধিক নেতা রাজ্য কমিটির মিটিংয়ে রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র, সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি, বিমান বসুদের সামনেই স্বীকার করেন, তাদের ভোট বিজেপিতে চলে যাচ্ছে। স্থানীয় সিপিএম নেতারা মনে করছেন, তৃণমূলকে ঠেকাতে হলে বিজেপিই একমাত্র অবলম্বন। রাজ্য কমিটির মিটিংয়ের পর স্বাভাবিকভাবেই কিছুটা চাপে পড়ে যায় আলিমুদ্দিন স্ট্রিট। রাজ্য নেতৃত্ব স্বীকারও করতে বাধ্য হন, বিজেপি সম্পর্কে দলের একটা অংশের মোহ কাটাতে তারা সক্ষম হননি।
কিন্তু দক্ষিণ দিনাজপুরের ঘটনায় ঝুলি থেকে বেড়াল সেই বেরিয়েই পড়ল। এবার আর গ্রামস্তরের কোনও নেতা নন। একেবারে জেলা কমিটির সদস্য। সেই সঙ্গে তপন এরিয়া কমিটির সম্পাদকও। বেশ কিছুদিন ধরেই জেলা পার্টি খবর পাচ্ছিল, জেলা কমিটির সদস্য নিরদ দাস নিজেই যোগাযোগ রাখছেন বিজেপির স্থানীয় এবং জেলা নেতাদের সঙ্গে। শুধু যোগাযোগই রাখছেন না, ‘তৃণমূলকে ঠেকাতে আগে রাম, পরে বাম’ এই মন্তব্যও করছেন পার্টি অফিসে বসেই। পঞ্চায়েত ভোটেও তিনি এবং আরও কয়েকজন সিপিএম নেতা সরাসরি বিজেপির সঙ্গে সম্পর্ক রেখে চলেছেন। শুক্রবার দক্ষিণ দিনাজপুর জেলা সিপিএম সম্পাদক নারায়ণ বিশ্বাস জানান, নিরদ দাস বিজেপির সঙ্গে যোগাযোগ রাখছিলেন। সেই খবর আমরা পাচ্ছিলাম, এই কারণে তাঁকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
কিন্তু দক্ষিণ দিনাজপুরের এই জেলা কমিটির সদস্যকে বহিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গেই আরও কিছু প্রশ্ন উঠছে সিপিএমের অন্দরেই। পঞ্চায়েত ভোটের আগে রাজ্য কমিটির সদস্য, বিধায়ক রমা বিশ্বাস নিজে বিজেপির সঙ্গে মিছিল করেছিলেন বলে অভিযোগ উঠেছিল। শুধু তাই নয়, নদীয়ার একাধিক জায়গায় সিপিএম-বিজেপির যৌথ দেওয়াল লেখাও চোখে পড়ে। বিশেষ করে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকায় বিজেপির সঙ্গে স্থানীয় সিপিএম নেতাদের প্রকাশ্য আঁতাতের অভিযোগও ওঠে। কিন্তু সব ক্ষেত্রে চোখ বন্ধ করেই ছিলেন আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের নেতারা। এমনকী, সব কিছুকে ছাপিয়ে যায় যখন, বিজেপির সঙ্গে আতাঁতের এত অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও নদীয়া জেলার সম্পাদক সুমিত দে’কে সম্প্রতি আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের নেতারা রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর আমন্ত্রিত সদস্য হিসেবে জায়গা করে দেন। শুক্রবার দক্ষিণ দিনাজপুরের ঘটনার পর জেলায়-জেলায় সিপিএমের মধ্যে প্রশ্ন উঠছে, একজনের ক্ষেত্রে বহিষ্কার, অন্য কাউকে রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীতে নিয়ে পুরস্কার, এমন স্ববিরোধী নীতি কেন মুজফফর আহমেদ ভবনের নেতাদের?
প্রশ্ন উঠছে, নিরদ দাসের মতো কলকাতা থেকে দূরবর্তী জেলার নেতাদের দল থেকে বহিষ্কার শুধুমাত্র আইওয়াশ নয় তো?

Leave A Reply

Your email address will not be published.