বরুণ সেনগুপ্তর শিক্ষা, ‘বর্তমান’কে টাকা দিয়ে কেনা যায় না।

১৯৮৪ সালে যাত্রা শুরু। তারপর কেটে গিয়েছে প্রায় ৩৪ বছর। একটা সংবাদপত্রের জীবনে সাড়ে তিন দশক মোটেই খুব বেশি সময় নয়। কিন্তু এই সময়ের মধ্যেই বরুণ সেনগুপ্তর ‘বর্তমান’ একটা নিজস্ব আপসহীন হার না মানা ইমেজ তৈরি করেছে। গড়ে তুলেছে নিজস্ব ঘরানা। সিপিএমের শাসনে যখন জেলায় জেলায় ভোট লুট, ছাপ্পা, রিগিং হত, মানুষ তাঁর গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করতে পারত না, তখন ক্ষমতাবানদের পরোয়া না করে সীমিত ক্ষমতায় মাথা উঁচু করে কলকাতার আর সব কাগজকে পিছনে ফেলে প্রতিবাদে গর্জে উঠেছে বরুণ সেনগুপ্তর ‘বর্তমান’। বিজ্ঞাপনের পরোয়া করেননি, প্রভাবশালীদের ভয় পেয়ে পিছিয়ে যাননি। প্রতিষ্ঠান বিরোধিতাই ছিল তাঁর সাংবাদিকতার মূল মন্ত্র। মেরুদণ্ড সোজা রেখে ক্ষমতা ও টাকার কাছে মাথা বিকিয়ে না দিয়ে সত্য ও আদর্শকে সামনে রেখে কাগজ চালানোই ছিল তাঁর প্রথম ও প্রধান শিক্ষা। আর সেই ভিতের উপর দাঁড়িয়েই একটার পর একটা মাইলস্টোন পার করেছে ‘বর্তমান’। প্রচার সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে কলকাতারই আরও বড় নামি-দামী কাগজকে পিছনে ফেলে। ২০০৮ সালে বরুণবাবুর অকাল প্রয়াণের পরও কাগজের সেই জয়যাত্রা থমকে যায়নি, উল্টে একই আদর্শে আজও ডালপালা বিস্তার করে এগিয়ে চলেছে ‘বর্তমান’।

‘বর্তমান’-এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক নির্ভীক বরুণ সেনগুপ্ত প্রয়াত হয়েছেন প্রায় ১০ বছর। কিন্তু তাঁর দেখানো পথেই এখনও মাথা উঁচু করে কোনও কিছুর সঙ্গে আপস না করে বীরবিক্রমে আগের মতোই এগিয়ে চলেছে ‘বর্তমান’। অন্যদের মতো টাকার কাছে, শাঁসালো বিজ্ঞাপনদাতার সামনে মাথা নুইয়ে ‘বর্তমান’ সেদিনও কাগজ চালায়নি, আজও নয়। কলকাতাসহ দেশের নামি-দামী সংবাদপত্র গোষ্ঠী ও চ্যানেল যখন টাকার সঙ্গে সহজেই আপস করে, বিক্রি হয়ে যায়, তখন ‘বর্তমান’ সত্যে, আদর্শে অবিচল। ভুয়ো চটকদার খবরের বিনিময়ে বিজ্ঞাপনদাতাকে তুষ্ট করা আমাদের কাজ নয়। সমাজের অন্ধকার দিকগুলির উন্মোচনে আগের মতোই তাই আজও অকুতোভয় ‘বর্তমান’। কোবরা পোস্ট সংস্থার পক্ষ থেকে দেশের ১৩৬টি গণমাধ্যমের উপর যে স্টিং অপারেশন চালানো হয়েছে তার চাঞ্চল্যকর ফলই ‘বর্তমান’-এর সেই গৌরবকে শতগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। সেই গোপন অপারেশনে নামি-দামী কাগজ ও চ্যানেল সহজে বিক্রি হয়ে গেলেও ‘বর্তমান’কে অনেক চেষ্টা করেও কেনা যায়নি। আসলে বরুণবাবুর আজীবন শিক্ষাই ছিল সৎ নির্ভীক সাংবাদিকতা যা সত্যে অবিচল এবং লক্ষ্যে স্থির।
সম্প্রতি ‘কোবরা পোস্ট’ কলকাতাসহ দেশের ১৩৬টি নামি-দামী সংবাদমাধ্যম ও চ্যানেলের উপর স্টিং অপারেশন চালায়। সেখানে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমকে মোটা টাকার বিজ্ঞাপনের লোভ দেখিয়ে হিন্দুত্ববাদী খবর প্রচার করার টোপ দেওয়া হয়। অধিকাংশ চ্যানেল ও গণমাধ্যম সেই প্রলোভনের কাছে বিক্রি হয়ে যায়। ব্যতিক্রম বরুণ সেনগুপ্তের ‘বর্তমান’। ১৩৬টির মধ্যে ১৩৪টি সংবাদমাধ্যম ও চ্যানেল সেই টোপ গিলে নেয়। আর এই চাঞ্চল্যকর রিপোর্টেই চোখ খুলে গিয়েছে সবার। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বরুণবাবু ও বর্তমানের শ্রেষ্ঠত্ব। জন্মলগ্ন থেকেই ‘বর্তমান’ কখনও বিজ্ঞাপনের জন্য লালায়িত ছিল না। কী সরকারি, কী বেসরকারি বিজ্ঞাপনের পিছনে না ছুটে প্রাণপণ গরিব মধ্যবিত্ত মানুষের সমস্যাকে জোরালো লেখনীতে সহজ ভাষায় তুলে ধরাই ছিল বরুণবাবুর ধ্যানজ্ঞান। বামফ্রন্ট আমলে বহুবারই দেখা গিয়েছে প্রচার সংখ্যার তুলনায় ‘বর্তমান’-এর ভাগ্যে সরকারি বিজ্ঞাপন জুটেছে নামমাত্র। এমনকী, পরিবারের সব সদস্যের একসঙ্গে বসে দেখতে অসুবিধা হয়, এমন পণ্যের বিজ্ঞাপনও ছাপতে পর্যন্ত তিনি রাজি হতেন না।
স্টিং অপারেশনে দেখা যাচ্ছে, ‘বর্তমান’-এর বিজ্ঞাপন বিভাগের অন্যতম কর্ণধার আশিস মুখোপাধ্যায় যখন ওই বিজ্ঞাপনদাতার মুখোমুখি হন, তখন ‘বর্তমান’কে ৫০ কোটি টাকার বিজ্ঞাপনের টোপ দিয়ে হিন্দুত্ববাদী সংবাদ প্রচারের প্রস্তাব দেওয়া হয়। উত্তরে আশিসবাবু সবিনয়ে জানিয়ে দেন, ‘বর্তমান’ এভাবে কারও নির্দেশমতো, কোনও কিছুর সঙ্গে আপস করে সংবাদ পরিবেশন করে না। বরুণবাবু আজীবন ‘বর্তমান’-এর প্রতিটি কর্মীকে এই শিক্ষাই দিয়ে গিয়েছেন। তাঁর মৃত্যুর ১০ বছর পরেও সেই আদর্শ থেকে আমরা একচুলও বিচ্যুত হইনি। শুধু একবার নয়, বারবার আশিসবাবুকে হিন্দুত্ব ও বিরোধী রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের দিকে কাদা ছেটাতেও প্ররোচিত করা হচ্ছে। কিন্তু অবিচল আশিসবাবু প্রতিবারই সেই প্রস্তাবকে প্রত্যাখ্যান করেন। বলেন, ‘এ প্রস্তাব মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়।’ আসলে এটাই বর্তমানের প্রতিটি কর্মীর শপথ। শত প্রলোভনের সামনেও বরুণ সেনগুপ্তের হাতে গড়া ‘বর্তমান’ কোনওদিন মাথা নত করবে না। আজকের এই উজ্জ্বল মুহূর্তে এটাই আমাদের অঙ্গীকার।

Leave A Reply

Your email address will not be published.