বিজেপিকে জ্বলন্ত উনুনের সঙ্গে তুলনা করে সিপিএম কর্মী-সমর্থকদের চরম হুঁশিয়ারি বুদ্ধদেবের: নিচুতলা শুনবে কি?

তাঁকেই বলতে হল। বলতে হল প্রশ্নের মোড়কে। দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লোকসভা নির্বাচন চলার সময় রাজ্যের পরিস্থিতি এবং তৃণমূল-বিজেপি নিয়ে দলীয় মুখপত্র ‘গণশক্তি’তে এক সাক্ষাৎকারে বাংলার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য পাল্টা প্রশ্ন তোলেন, ‘তৃণমূলের গরম তেলের কড়াই থেকে বিজেপির জ্বলন্ত উনুনে ঝাঁপ দেওয়া কি বুদ্ধিমানের কাজ?’
চার দফা ভোট হয়ে যাওয়ার পর এই সাক্ষাৎকারে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের এই প্রশ্ন থেকেই পরিষ্কার, খাল কেটে কুমির আনতে বিশেষ উদ্যোগী কারা! একজন স্বভাব নেতার মতোই বিবেকি বুদ্ধদেব নিজের দায়িত্ব ও কর্তব্যে অটল। যদিও কাগজেকলমে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য আজ সিপিএমের নেতৃত্বে নেই। তবুও সর্বনাশ সমুৎপন্ন যখন, তখন তিনিই ত্রাতা। তিনিই নেতা। অতীতের মতো এবারও তা প্রমাণ করলেন। আর কখন এই কাজটা করলেন জ্যোতি বসুর উত্তরসূরি? যখন সূর্যকান্ত মিশ্র থেকে সীতারাম ইয়েচুরি পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে রাজনৈতিক অবস্থান স্পষ্ট করে বলছেন, কেন্দ্রে বিজেপি শাসনকে উচ্ছেদ করতে ও রাজ্যে তৃণমূলের দুঃশাসনকে পরাস্ত করতে বামপন্থী প্রার্থীদের ভোট দিতে। এক কথায় তৃণমূল এবং বিজেপিকে একাসনে বসিয়ে দু’দলকেই হারানোর ডাক দিয়েছেন সিপিএম নেতৃত্ব। এই অবস্থানের বিপ্রতীপে দাঁড়িয়ে বিজেপিকে জ্বলন্ত উনুনের সঙ্গে তুলনা করে বুদ্ধদেব বুঝিয়ে দিলেন, যুদ্ধটা কার বিরুদ্ধে জারি রাখতে হবে। দেশে যে নির্বাচন চলছে তা নিয়ে প্রথম মুখ খুলেই বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বুঝিয়ে দিলেন, বাংলায় দলটা ঠিক লাইনে নেই। আর সিপিএম নেতা-কর্মীদের মধ্যে খুঁচিয়ে দিলেন সেই প্রতীতি, বুদ্ধদেববাবু রাজ্যে তৃণমূলের থেকে বিজেপিকে বড় বিপদ বলে মনে করছেন।
নিশ্চয়ই এরপরে আলিমুদ্দিনের ভোটরথীরা বলবেন না, ‘বুদ্ধবাবু সাধারণ একটি প্রশ্ন তুলেছেন। গ্রান্ড ন্যারেটিভ থেকে।’ তাহলে আমাদের জিজ্ঞাসা, ‘কমরেড, এই রাজ্যের সীমানা টপকালে কোথায় পাচ্ছেন ‘তৃণমূলের গরম তেলের কড়াই!’ আসলে এ রাজ্যে সিপিএমের একটা বড় অংশ মনে করছেন, আগে তো তৃণমূলকে ঘায়েল করি, তারপর বিজেপিকে বুঝে নেওয়া যাবে। আর এই বোঝা এবং পড়াটা এখন আর গোপন নেই। তাই মোদী-শাহর বিজেপির হাতে প্রতিদিন নিপীড়িত ত্রিপুরার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার এ রাজ্যে দলীয় প্রার্থীর সমর্থনে প্রচারে প্রায় আর্তনাদ করেছেন। নিজের রাজ্য ত্রিপুরার প্রসঙ্গ টেনে মানিকবাবু বলেন, ‘তৃণমূল থেকে বাঁচতে বিজেপিকে ডেকে আনার ভুল করবেন না। ত্রিপুরার দিকে তাকান। রাজ্যের পঞ্চায়েত ভোটে ৯৬ শতাংশ আসনে বিরোধীদের প্রার্থী দিতে দেয়নি। লোকসভা ভোটেও চরম অরাজকতা করায় একটি কেন্দ্রের নির্বাচন পিছিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছে কমিশন। আমাদের এই অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, এখানে তৃণমূলের বদলে বিজেপিকে ডেকে আনার আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নেবেন না।’
এই বক্তব্যগুলো থেকে একটা জিনিস উঠে আসছে, বামপন্থীরা যে সংসদে গরিব ও খেটে-খাওয়া, পিছিয়ে পড়া মানুষের কথা তুলে ধরার জন্য ভোট চাইতেন, নিজেদের প্রার্থীকে জেতানোর জন্য আবেদন করতেন, এ রাজ্যের সিপিএমের সেখানে প্যারাডাইম শিফট হয়েছে। এই নির্বাচনে এই রাজ্যের তৃণমূলকে হারানোই তাদের মূল লক্ষ্য হয়ে পড়েছে। যা শুধু বামপন্থার ক্ষতিসাধন করবে না, সাড়ে সর্বনাশ হবে আমাদের বাংলার। তাই মুখ খুলেছেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য।
আমার সাধারণ প্রশ্ন, এটা তো কেন্দ্রীয় সরকার গড়ার ভোট হচ্ছে, সেখানে ‘তৃণমূলকে রাজ্য থেকে হটাতে, বিজেপিকে কেন্দ্র খেকে হটাতে’ দিকে দিকে বামপ্রার্থীদের ভোট দেওয়ার পোস্টার পড়ছে কেন? সিপিএম কেন্দ্রীয় কমিটিও তো বিজেপি সরকার হটাবার ডাক দিয়েছে। সেখানে পশ্চিমবঙ্গে এই বিরাট অংশের কর্মী-সমর্থকের ভোট পদ্মে চলে যাওয়াটা কি ‘বেঙ্গল লাইন’? জানি, সিপিএম রাজ্য নেতারা বলবেন, ‘এসব বাজারি প্রচার, সিপিএমের ভোট বিজেপিতে যায় না।’ এই ক্ষেত্রে আমি দুটো উদাহরণ দেব। এক, গত বছর পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময় ২৪ মে সিপিএম পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটি প্রেস বিবৃতি জারি করে জানিয়েছিল, তৃণমূলকে হারানোর জন্য বিজেপিকে সমর্থন করার মোহ ত্যাগ করতে হবে। দুই, রবিবার প্রকাশিত বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যর সাক্ষাৎকার ও মানিক সরকারের বক্তব্যের নির্যাস।
আমার দৃঢ় বিশ্বাস, চটজলদি রাজ্যের শাসক দলকে বেকায়দায় ফেলতে ২০১৪ সাল থেকেই বামদের একাংশ বিজেপির দিকে ভোটের পক্ষে সওয়াল করেছেন, আর সেই রিপোর্ট বাম নেতৃত্বর কাছে আছে। কিন্তু দলের মধ্যে রাশ আলগা হয়ে যাওয়ায়, নেতারাও কিছুটা দিশেহারা। এই অবস্থায় পলিটব্যুরো নেতা মানিক সরকার শেষ লগ্নের প্রচারে এসে নিচুতলার সমর্থকদের বিজেপিকে ভোট দেওয়ার মতো ভুল না করার আবেদন করছেন। এমনকী, অশক্ত শরীরে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যও।
পাঠক জানবেন, আজকের সিপিএমের যে ‘বেঙ্গল লাইন’, অর্থাৎ রাজ্যের পরিস্থিতি অনুযায়ী কংগ্রেসের সঙ্গে নির্বাচনী সমঝোতার লাইন হায়দরাবাদ কংগ্রেসে অনুমোদিত হয়েছে, তারও প্রবক্তা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। ২০১৪ সালের ভোটে যখন দেখা গেল, তৃণমূলকে টাইট দিতে বাম ভোট পদ্মে যাচ্ছে, তখন থেকেই বুদ্ধদেব এই ধস ঠেকাবার একটা রণকৌশল হাতড়াচ্ছিলেন। তার কিছু পরেই বুদ্ধদেববাবুর একটি ছোট্ট নোট আলিমুদ্দিনের অক্ষ বদলের কাজ করল। বুদ্ধদেব জানালেন, তৃণমূলের বোলবোলা ঠেকানো বামদের একার কম্ম নয়। ইশারা পরিষ্কার। কংগ্রেসকে পাশে পাওয়ার লাইন তৈরি হল। যদিও বুদ্ধবাবুর এই লাইন প্রয়োগে স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া ছিল না অনেকেরই। সদ্য রাজ্য সম্পাদক হওয়া সূর্যকান্ত মিশ্রও নিমরাজি ছিলেন। তাই বিধানভবনে হবে, না প্রমোদ দাশগুপ্ত ভবনে হবে, এই নিয়ে টানাপড়েনে সূর্যকান্ত মিশ্র ও অধীর চৌধুরীর মধ্যে প্রথম বৈঠকটিই করা গেল না। তারপর অনেক দড়াদড়ি ও প্রভাবশালী মহলের চাপে ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বাম-কংগ্রেস যে বোঝাপড়া হল, তাকে জোট বলতেই নারাজ সূর্যকান্তরা। এই প্রসঙ্গে আমার মনে পড়ছে, thebengalstory.com এ মইনুল হাসান এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘এই যে ২০১৬ বিধানসভা ভোটে সিপিএম-কংগ্রেস জোট হল। সমস্ত তৃণমূল বিরোধী মানুষ তো এটাকে জোটই বলছিলেন। অথচ সিপিএম আজ পর্যন্ত স্পষ্ট করে বলতে পারল না, জোট হয়েছে। এবং এটা করতে গিয়ে নেতারা এত নিম্নরুচির পরিচয় দিলেন, ভাবা যায় না।’ মইনুল উদাহরণ দিয়েছিলেন, বিধানসভা ভোটের আগে সিঙ্গুরে সিপিএম-কংগ্রেসের যৌথ সভার। যেখানে সীতারাম ইয়েচুরি প্রধান বক্তা, সঙ্গে অধীর চৌধুরীও। কিন্তু সিপিএম নেতারা আগেই ঠিক করে রেখেছিলেন, স্টেজে অধীর আর সীতারামকে একসঙ্গে রাখবেন না। এই যে অস্পষ্টতা, এই যে দ্বিচারিতা, তা এবারও ভোটের আগে জোটের ঘোঁটে আরও হতাশ করল নিচুতলার কর্মীদের। ফলে ঝোঁক গেরুয়া শিবিরে।
যা কখনই ‘বেঙ্গল লাইন’ এর স্থপতি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যর কাম্য ছিল না। তাই অসুস্থ শরীরে মানুষটা বোধহয় শেষবারের মতো হুঁশিয়ারি দিলেন জ্বলন্ত উনুনের কথা তুলে। জানি না, প্রশ্নের মোড়কে তাঁর এই আবেদন নিচুতলার কর্মী-সমর্থকরা এই শেষ দু’ দফায় কতটা কানে তুলবেন!

(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)

Comments are closed.