ভয় পেলে তো শেষ, রুখে দাঁড়ালেই বাংলাদেশ

নিরাপদ সড়কের দাবি বাংলাদেশে নতুন নয়। প্রতিদিন বেপরোয়া গাড়ি চালানো আর ত্রুটিপূর্ণ যানবাহনের কারণে ঝরছে অসংখ্য প্রাণ। মাঝে মাঝে প্রতিবাদ হয়। দু’একটি যানবাহন ভাঙচুর হয়। তারপর যে কে সেই। বাস মালিক বা প্রশাসনের টনক নড়ে না। প্রশাসনে দুর্নীতি, নানা মহলের স্বজন প্রীতি, প্রভাবশালী এবং রাজনীতিবিদ ভিআইপিদের অনিয়ম আর হস্তক্ষেপের কারণে কোনও প্রতিকার হয় না। দিনের পর দিন রক্ত ঝরে রাজপথে। যার বেশিরভাগই শিশু।
গত রবিবার ২৯ জুলাই এয়ারপোর্ট রোডে কুড়িল বিশ্বরোডে রাস্তার বাস উঠে এলো ফুটপাতে। বাসের অপেক্ষায় থাকা সাতজন স্কুল শিক্ষার্থীকে চাপা দিল। শহিদ রমিজুদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুজন শিক্ষার্থী দিয়া ও করিম সেখানেই প্রাণ হারালো। পরে কুর্মিটোলা হাসপাতালে আর কতজন, তার সঠিক হিসাব নেই কারও কাছে।
বন্ধুর মৃত্যু সংবাদ শুনে পথে নেমে আসে তার সহপাঠীরা। পথ অবরোধ করে। যে কোম্পানির বাস চাপা দিয়েছে তাদের বন্ধুদের, সেই কোম্পানির বাস আটকায়। নানাভাবে প্রতিবাদ জানায়। দোষী চালকের বিচার চেয়ে ঘরে ফিরে যায়। অপেক্ষা করে পায় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী আর প্রশাসনের উপেক্ষা আর উপহাস।
এরপর বড়দের শিক্ষা দিতে বইয়ের ব্যাগ কাঁধে ইউনিফর্ম, আইডি কার্ডসহ পথে নামে। তারা শেখায় কীভাবে সড়ক নিরাপদ করতে হয়। অত্যন্ত বিনয়ের সাথে তারা প্রতিটি গাড়ির ফিটনেস আর চালকের লাইসেন্স পরীক্ষা করে। না থাকলে পুলিশকে বাধ্য করে কেস দিতে। চালককে খাতার কাগজ ছিঁড়ে দিয়ে দশবার লিখতে বলে, “আমার লাইসেন্স নাই” বাক্যটি। কারও সাথে কোনও খারাপ ব্যবহার করেছে বলেও শোনা যায়নি। পুলিশকে বা অন্য বড়দের আঙ্কল ছাড়া সম্বোধন করেনি। কেউ খারাপ ব্যবহার করলে পুলিশকে সমাধান করতে বলেছে। গাড়িকে নিজ নিজ গতির লাইনে চলাতে বাধ্য করেছে। ভিড় রাস্তায় অ্যাম্বুলেন্স যাওয়ার পথ করে দিয়েছে। উল্টোপথে চলা গাড়ি ধরেছে। এসব করতে গিয়ে মন্ত্রী, বিচারপতি, পুলিশ, বিজিবি, সবার গাড়ি ধরা পড়েছে। তারা লজ্জা দিয়ে শিক্ষা দিয়েছে।

গণপরিবহণের অপ্রতুলতায় জন-দুর্ভোগ বেড়েছে বটে, কিন্তু জনগণ বিরক্ত হননি। কারণ, যে কাজ ৪৭ বছরে বড়রা করতে পারেননি সে কাজ এই নির্ভীক ক্ষুদে যোদ্ধারা করে দেখিয়েছে।
‌বিভিন্ন স্কুল কলেজ থেকে ঢাকার শাহবাগ, ফার্মগেট, শান্তি নগর, শাপলা চত্বর, সায়েন্স ল্যাব, মিরপুর, মগবাজার, বিশ্বরোডে নেমে এসেছে শিক্ষার্থীরা। সারা দেশের চিত্রও একই। ছোট ছোট শিশুরা নিজের হাতে পোস্টারে লিখে এনেছে হৃদয়স্পর্শী সব কথা। চোখে জল আসে তাদের স্লোগান শুনলে। আবার বুকে বলও পাই। এরাই বাংলাদেশের ভবিষ্যত। এদের হাতেই নিরাপদ আমাদের জন্মভূমি।

তেমন সংগঠিত তারা নয়। হবার সুযোগও নেই। কয়েকটি ফেসবুকের মাধ্যমে অচেনা বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ করেই আজ পাঁচদিন আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে অসাধারণ দক্ষতায়। কোনও দুর্ঘটনা ছাড়াই। প্রথমদিন পুলিশ সহিংস থাকলেও পরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশ এবং কতকটা নিজেদের বিবেকের তাড়নাতেও অনেক ক্ষেত্রে সহায়তাও করছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। বৃষ্টিতে ভিজে, রোদে পুড়ে, না খেয়ে স্কুলে টিসির ধমক আর বাড়িতে বাবা-মায়ের বকুনি খেয়েও পথে নেমেছে স্কুল-কলেজে পড়ুয়ারা। আবার বাবা মায়ের হাত ধরেও এসেছে অনেকে। শিক্ষকরাও সাথে এসেছেন অনেকের।
‌আমার বলবার কথা একটাই, ওদের আন্দোলন ওদেরই থাক। ওরা যে পথে এগুচ্ছে সেভাবেই এগিয়ে নিয়ে যাক তাদের নয় দফা দাবি। তাদের আবেগের দাবিগুলোর যুক্তিযুক্ততা বিচার করুক প্রশাসন। শিক্ষার্থীরা প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাস চেয়েছে, তা পেয়ে যাক। আমরা যে অকর্মন্যরা আজ পর্যন্ত এ কাজ করতে পারিনি তারা যেন এটা করো, সেটা করো বলে ওদের উপর ফপরদালালি না করি। আর যে বিরোধী মহল এ আগুনে আলু পুড়িয়ে খাবার চিন্তায় বগল বাজাচ্ছেন তারাও সাবধান হন। এটা কোনও সরকার বিরোধী বা সরকার পতনের আন্দোলন নয়। এ আন্দোলন ৪৭ বছরের পচা-গলা অনিয়মের গোড়ায় আঘাত করার আন্দোলন।
‌তাই আজকের তারুণ্যর সাথে আছি, পাশেই আছি। আমাদের চোখ, আমাদের সন্তানদের দিকে দৃষ্টি রাখবে অনুক্ষণ। তোমাদের আন্দোলন, তোমরাই নেতৃত্ব দেবে। যদি প্রয়োজন মনে করো ডেকে নেবে। পথ চলবো তোমাদের দেখানো পথেই।
জয় তারুণ্য।
জয় বাংলা।

Leave A Reply

Your email address will not be published.