‘মানিক সরকার কিডনি পাচারকারীদের সঙ্গে যুক্ত’, এই ফেসবুক পোস্টে উত্তাল ত্রিপুরা। ছেলেধরা গুজবে গণপিটুনিতে মৃত ৪

ছেলেধরা গুজব এবং তাকে কেন্দ্র করে গণপিটুনিতে চারজনের মৃত্যুর ঘটনায় আগরতলাসহ ত্রিপুরার বিভিন্ন এলাকায় গত কয়েকদিনে আইনশৃঙ্খলার চূড়ান্ত অবনতি হয়েছে। গোটা ঘটনাকে কেন্দ্র করে উত্তাল হচ্ছে ত্রিপুরার রাজ্য রাজনীতি। সিপিএম পলিটব্যুরো সদস্য এবং রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার এবং তাঁর দল ছেলেধরা এবং কিডনি পাচার চক্রের সঙ্গে যুক্ত বলে ফেসবুকে পোস্টের জেরে উত্তেজনা তীব্র আকার নিয়েছে। মানিক সরকার এবং সিপিএমের বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যমূলকভাবে ভুয়ো তথ্য পেশ এবং মানহানিকর পোস্ট করে গুজব ছড়ানোর অভিযোগে জনৈক অনুপম পালের বিরুদ্ধে শুক্রবার থানায় অভিযোগ জানান এক ব্যক্তি। সব মিলে ছেলেধরা এবং কিডনি পাচার চক্রের গুজবকে কেন্দ্র করে শাসক দল বিজেপি এবং বিরোধী সিপিএমের মধ্যে শুরু হয়েছে চাপান-উতোর। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ৪৮ ঘন্টার জন্য ত্রিপুরায় ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করেছে প্রশাসন। তাতেও পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসেনি।

 

ঘটনার সূত্রপাত গত মঙ্গলবার। মোহনপুরের তারানগরে পুর্ণ (মুন্না) বিশ্বাস নামে এক স্কুল ছাত্রের নৃশংস খুনের ঘটনা ঘটে। নিহতের বাড়ি গিয়ে ওই রাতেই রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী রতনলাল নাথ বলেন, এটা আন্তর্জাতিক কিডনি পাচারকারীদের কাজ। তাদের ঘরবন্দি করার নির্দেশ দেন তিনি। এরপর বুধবার সকাল থেকেই ছেলেধরা গুজব ছড়িয়ে পড়ে এলাকার পর এলাকায়। রটে যায় কিডনি পাচারকারী চক্র বাচ্চা ছেলে-মেয়েদের ধরে নিয়ে যাবে। জনৈক অনুপম পাল নামে এক ব্যক্তি ‘টিম অনুপম পাল’ নামক একটি ফেসবুক পেজে পোস্ট করেন, ‘সিপিএম ও কংগ্রেস কিডনি পাচারের ঘটনায় যুক্ত’। ফেসবুকে এই পোস্ট দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে ত্রিপুরার বিভিন্ন জায়গায়। সিপিএমের অভিযোগ, ‘বিধানসভা নির্বাচনের আগে থেকেই অনুপম পাল নামে ওই ব্যক্তি দিন-রাত বিজেপির হয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় মিথ্যে প্রচার চালিয়েছেন। যার মধ্যে অধিকাংশই সিপিএমের বিরুদ্ধে মিথ্যে অভিযোগ, নোংরা ব্যক্তিগত আক্রমণে পরিপূর্ণ। বুধবার তাঁর ফেসবুক পোস্টের পরই গোটা রাজ্যে বিজেপি-আইপিএফটি কর্মীরা অপরিচিত মানুষ দেখলেই ছেলেধরা অভিযোগে উন্মত্ত হয়ে হামলা শুরু করে। বুধবার থেকে শুক্রবার পর্যন্ত তিন দিনে বিভিন্ন জায়গায় ৪ জনকে পিটিয়ে খুন করা হয়েছে ছেলেধরা অভিযোগে। গুরুতর জখম হয়েছেন অন্তত ২৫ জন।

‘টিম অনুপম পাল’ এর তরফে ফেসবুকে পোষ্ট করা হয়, ‘মানিক সরকার এবং সিপিআইএম কেরালা থেকে লোক আনিয়ে কিডনি পাচার চক্রের কাজ করছেন রাজ্যে’। এই ঘটনার তীব্র নিন্দা করেছেন রাজ্যের বিরোধী দল সিপিএম। শুক্রবার এক বিবৃতিতে মানিক সরকার জানান, ‘আইন হাতে তুলে নেওয়ার বেআইনি কাজ কোনওভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। রাজ্যের সর্বত্র শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখার দায়িত্ব ত্রিপুরাবাসীর। কোনও বিষয়ে সন্দেহ থাকলে তা পুলিশ ও প্রশাসনের দৃষ্টিতে নিতে হবে। রাজ্য পুলিশ ও প্রশাসন পরিস্থিতি মোকাবিলায় ইতিমধ্যে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। পুলিশ ও প্রশাসনকে আরও সক্রিয় এবং সদর্থক ভূমিকা নিতে হবে’। নিহতদের পরিবারবর্গের প্রতি গভীর শোক ও সমবেদনা জানিয়েছেন তিনি। এরই মধ্যে মানিক সরকার এবং সিপিএমের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্থ করতে ফেসবুকে মিথ্যা এবং কুৎসামূলক প্রচার করা হচ্ছে বলে অনুপম পালের বিরুদ্ধে শুক্রবার পশ্চিম থানায় লিখিত অভিযোগ জানান জনৈক কৌশিক রায় দেববর্মা। তাঁর অভিযোগ, রাজ্যে শান্তির পরিবেশকে বিঘ্নিত করতে উদ্দেশ্যমূলকভাবে সিপিএমকে কালিমালিপ্ত করা হচ্ছে।

পুলিশ জানিয়েছে, গুজব ছড়ানোর অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে ১২ জনকে। কুৎসা এবং অপ্রচার করার জন্য বেশ কিছু মামলাও হয়েছে। পাশাপাশি বন্ধ করা হয়েছে ইন্টারনেট পরিষেবা। গুজব ছড়ানোয় ইন্ধন দেওয়ার জন্য শিক্ষামন্ত্রী রতনলাল নাথকে দায়ী করে ঘটনার বিচারবিভাগীয় তদন্ত দাবি করেছে কংগ্রেস।

বিধানসভার বিরোধী দলনেতা মানিক সরকার শুক্রবার এক বিবৃতিতে বলেন, গত ২৬ জুন মোহনপুর মহকুমার তুলাবাগান এলাকার ভূমিহীন কলোনির একটি কিশোরের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনা নিয়ে রাজ্যে অস্বাভাবিক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। এই কিশোরটির হত্যাকাণ্ড নিয়ে কারও কারও ভিত্তিহীন, দায়িত্বজ্ঞানহীন বক্তব্য এই অস্বাভাবিক পরিস্থিতি সৃষ্টিতে ইন্ধন জুগিয়েছে। কোনও এলাকার অপরিচিত কাউকে দেখলেই তাকে সন্দেহের পাত্র করা হচ্ছে। তাঁরা জনতার দৈহিক আক্রমণের শিকার হচ্ছেন। সন্দেহ ও গুজবে বিভ্রান্ত হয়ে আইন হাতে তুলে নিয়ে কোনও কোনও এলাকার একাংশ জনতা উন্মত্ত আক্রমণে লিপ্ত ছিল এবং বিশালগড়ে একজন মহিলা, মোহনপুরে মুড়াবাড়িতে অন্য রাজ্যের এক ফেরিওয়ালা, কলাছড়িতে একজন তবলা শিক্ষক প্রাণ হারিয়েছেন। বেশ কয়েকজন আক্রান্ত ও আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এই সমস্ত ঘটনাবলি সম্পূর্ণ অনভিপ্রেত।

 

Leave A Reply

Your email address will not be published.