ওয়ালমার্টের মতো সংস্থা দেশে আসুক, দুনিয়ার গতির উলটো দিকে যেতে পারি না আমরা

সম্প্রতি প্রায় ১৬ বিলিয়ান মার্কিন ডলারের বিনিময়ে ভারতের বৃহত্তম ই-কমার্স সংস্থা ফ্লিপকার্টের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছে মার্কিন রিটেল জায়েন্ট ওয়ালমার্ট। এই চুক্তির ফলে ফ্লিপকার্টের ৭৭ শতাংশ মালিকানা গিয়েছে ওয়ালমার্টের দখলে। অনেকে এই চুক্তিকে দেশের খুচরো বাজারে বিদেশি বৃহৎ পুঁজির অনুপ্রবেশ হিসাবে দেখছেন। অনেকের অনুমান, এর ফলে মার খাবেন দেশের ছোট, ক্ষুদ্র-মাঝারি ব্যবসায়ীরা। কিন্তু বৃহৎ পুঁজি যে আমাদের দেশের খুচরো ব্যবসায় ঢুকছে তা একদিক থেকে দেখতে গেলে অবশ্যম্ভাবী। সারা পৃথিবী যে দিকে চলেছে আমরা তার উল্টো দিকে যেতে পারি না।

কিন্তু কেন খুচরো ব্যবসায় বৃহৎ পুঁজির এই আগমন? এতে লাভ কী? আর কেনই বা আমাদের দেশে এর বিরোধিতা করা হচ্ছে? আমার মতে, বড় পুঁজি দেশের খুচরো বাজারে এলে এর বেশ কিছু অর্থনৈতিক সুবিধা রয়েছে। যেমন, যেহেতু বিদেশি পুঁজির টাকা লগ্নির অংক অনেক তাই তাঁদের মজুদ করার ক্ষমতাও অনেক। আমাদের দেশে দেখা যায়, মজুতের অভাবে উৎপাদিত কৃষিপণ্য, খাদ্যপণ্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। দূরবর্তী কোনও এলাকায় হয়তো কোনও কৃষিপণ্যের দাম অনেক কিন্তু সেখনে ফসল নিয়ে যেতে না পারায় এবং নষ্ট হয়ে যাওয়ার ভয়ে কৃষকরা অল্প দামেই ফসল বেচে দিতে বাধ্য হন। কিন্তু বৃহৎপুঁজি এলে তারা কৃ্ষকদের থেকে এক লপ্তে অনেকটা কৃষিপণ্য কিনে কোল্ড স্টোরেজে সেগুলি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করবে। ফলে নষ্ট হওয়ার পরিমাণ কমবে। আর উৎপাদিত ফসলের ভালো দামও পাবেন কৃ্ষকরা। তাই দেশের খুচরো বাজারে বৃহৎ বিদেশি পুঁজি ঢুকলে সকলেই ক্ষতিগ্রস্থ হবেন তেমনটা নয়, কৃষকদের লাভ হবে। পাশাপাশি লাভবান হবেন ক্রেতা-উপভোক্তারাও। ওয়ালমার্টের মতো সংস্থা বিপণি খুললে সেগুলি পরিকাঠামো দিক থেকে উন্নত এবং আধুনিক হবে। রোদে-গরমে খোলা বাজার থেকে কেনাকাটা করার চেয়ে ক্রেতারা এই ধরনের বিপণিতে আসতেই বেশি স্বচ্ছন্দ হবেন, তা বলাই যায়।

কিন্তু এর ফলে ক্ষতিগ্রস্থ হবেন মিডলম্যান বা মধ্যস্বত্বভোগীরা। এরা মূলত গ্রামের কৃষকদের থেকে শাক-সবজি, অন্যান্য কৃষিপণ্য কিনে এনে শহরে বিক্রি করেন। আমদের দেশে এই মধ্যস্বত্বভোগীরা বিপুল সংখ্যায় রয়েছেন। ওয়ালমার্টের মতো সংস্থারা এদেশে এলে তারা সরাসরি কৃষকদের থেকে পণ্য কিনে নিজেদের বিপণিতে বিক্রি করবেন। ফলে ক্ষতিগ্রস্থ হবেন এই মধ্যস্বত্বভোগীরা। আর তাঁদের কথা ভেবেই মূলত আন্দোলন, আপত্তি রাজনীতিকদের।

আমরা এখন দেশের খুচরো বাজারে বিদেশি পুঁজির প্রবেশের বিরোধিতা করছি। কিন্তু রিলায়েন্স, বিগ বাজার, স্পেনসার্সের মতো দেশি পুঁজি ইতিমধ্যেই দেশের খুচরো বাজারে বিপুলভাবে ঢুকেছে। ফলে মধ্যস্বত্বভোগীদের ক্ষতি এখনও আটকানো যাচ্ছে না। তাই কোন যুক্তিতে এক্ষেত্রে বিদেশি পুঁজি আটকানো হবে? পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই এখন ছোট ছোট দোকান উঠে গিয়ে শপিংমল গড়ে উঠছে। বছর চল্লিশ আগে আমি যখন প্রথমবার আমেরিকায় গিয়েছিলাম তখনও সেখানকার পাড়ায় পাড়ায় ছোট ছোট দোকান চোখে পড়েছিল। বড় মল আসার পর এখন সে সব উঠে গেছে। এখানেও তাই হতে চলেছে।

কিন্তু ইতিহাসের নিয়ম বলে নতুন কিছু হলে, স্বল্প মেয়াদে কারও কারও ক্ষতি হয়। যেমন ইউরোপে শিল্প বিপ্লবের সময় হয়েছিল। সে সময় কল-কারখানায় যন্ত্রের ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে শ্রমিকদের অবস্থা খারাপ হয়েছিল। বহু শ্রমিক কাজ হারিয়েছিলেন। তাঁদের বেতন বাড়েনি। কর্মসংসস্থান কমে গিয়েছিল। কিন্তু পরে কল-কারখানার উৎপাদিত পণ্য থেকে যে লাভ হয় তা কারখানার মালিকরা অন্যত্র বিনিয়োগ করেন। ফলে কাজের প্রচুর নতুন সুযোগ তৈরি হয়। তাই যারা বর্তমানে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন তাঁদের পরের প্রজন্ম ভবিষ্যতে এর থেকে লাভবান হবে। আমার মতে, ওয়ালমার্টের মতো সংস্থারা আসুক। এই পদক্ষেপকে স্বাগত। এর ফলে লাভবান হবেন কৃষকরা,উৎপাদকরা, ক্রেতা-উপভোক্তারা। কিন্তু এর ফলে যারা রুটি-রুজি খোয়াচ্ছেন তাদের খেয়াল রাখতে হবে। সরকার তাঁদের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করুক। কিন্তু, শুধু মধ্যস্বত্বভোগীদের কথা ভেবে দেশের খুচরো ব্যবসায় বৃহৎ বিদেশি পুঁজি আটকানো ঠিক হবে না।

(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)

Leave A Reply

Your email address will not be published.