কোয়ারেন্টিন মানে ৪০ দিন! ১৪৪৮ সালে কোন মহামারি ঠেকাতে কেন হয়েছিল এই নিয়ম? জানেন দুনিয়ার প্রথম কোয়ারেন্টিন সেন্টারের ইতিহাস

১৩৪৭ সালের অক্টোবর। ইতালির সিসিলির মেসিনা বন্দরে নোঙর করছে ব্ল্যাক সি পেরিয়ে আসা এক ডজন জাহাজ। বন্দরে আসা ভিনদেশি জাহাজ দেখতে তখন ভিড় জমিয়েছেন শহরের আট থেকে ৮০। ক্রমশ জাহাজ এগিয়ে আসে পারের দিকে। হর্ষধ্বনি আর হাততালি দিয়ে আসন্ন জাহাজ দলকে স্বাগত জানানো সিসিলির বহুদিনের রীতি। কিন্তু এ কী!
জাহাজ বন্দর ছুঁতেই এক অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখে হতচকিত স্বাগত জানাতে আসা সিসিলির বাসিন্দারা। কী দেখলেন তাঁরা?
এক ডজন জাহাজের বেশিরভাগ নাবিকই মৃত। আর যাঁরা তখনও হাল ধরে বসে, তাঁরাও ধুঁকছেন। অন্তিম সময় আসন্ন। কী রোগ জানা না গেলেও, আলোর গতিতে জাহাজ বাহিত রোগের কথা ছড়িয়ে পড়ে সিসিলিতে। প্রশাসন পত্রপাঠ জাহাজ ফের সমুদ্রে ফেরানোর নির্দেশ দেন। কিন্তু তখন অনেকটাই দেরি হয়ে গিয়েছে।
সেই খবর ভাসতে ভাসতে পৌঁছে যায় ইউরোপের কোণে কোণে। নতুন এক রোগের কথা তখন মানুষের মুখে মুখে। ইউরোপে সেই শুরু ব্ল্যাক ডেথের ইতিবৃত্ত।

ব্ল্যাক ডেথের আমলে মেসিনা বন্দরের তৈলচিত্র

 

ব্ল্যাক ডেথ

১৩৪৮ থেকে ১৩৫৯ এর মধ্যে ইউরোপে আঘাত হানে ব্ল্যাক ডেথ। ব্ল্যাক সি পেরিয়ে আসায় এই নাম। বুবোনিক প্লেগের প্রকোপে তারপর মাত্র ৫ বছরের মধ্যে কেবলমাত্র ইউরোপেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন ২ কোটিরও বেশি মানুষ। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তৎকালীন ইউরোপ মহাদেশের এক তৃতীয়াংশ জনসংখ্যা শেষ। বিশ্বের ইতিহাসে অন্যতম ভয়াবহ মহামারি।
সিসিলির মেসিনা বন্দরে নোঙর করা ডেথ শিপের মাধ্যমে যে প্রকোপ শুরু হয়েছিল বলে মনে করা হয়, তার আঘাত এসে পড়েছিল এশিয়াতেও। সেখানেও একইভাবে চলেছিল মৃত্যুমিছিল। ব্ল্যাক ডেথের প্রকোপ সামান্য কমতেই ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা শুরু করে ইউরোপ।
কিন্তু টিকা ছাড়া কীভাবে রোখা যাবে এমন অজানা-অচেনা মহামারি? ১৩৭৭ সালের একটি নথিতে রয়েছে তারই হদিশ।
তৎকালীন ডালমেশিয়ার রাগুসা। বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সেই আমলের ইউরোপে একটি গুরুত্বপূর্ণ বন্দর। সেখানে যেমন ইউরোপের অন্য দেশ থেকে জাহাজ এসে নোঙর করত, তেমনই এশিয়া কিংবা আমেরিকা মহাদেশের বাণিজ্যপোতেরও ঠিকানা হত বর্তমান ক্রোয়েশিয়ার অন্তর্গত দুব্রোভনিক। অর্থাৎ, প্রকৃত অর্থেই কসমোপলিটন বন্দর শহর।
বিমান পরিবহণ সেসময় ছিল না। তাই মহামারির প্রবেশ যে জাহাজের মাধ্যমেই তা নিয়ে মতবিরোধ ছিল না। ফলে সেই অনুযায়ী রোগ নিয়ন্ত্রণের প্রশাসনিক পরিকল্পনা নেওয়া হয়। কী ছিল সেই পরিকল্পনা?
ঠিক হয়, রাগুসা বা আজকের দুব্রোভনিকে প্রবেশের আগে জাহাজ সহ নাবিক দল ও সওয়ারিদের বাধ্যতামূলকভাবে ৩০ দিন কাটাতে হবে একটি নির্দিষ্ট জায়গায়। সেই জায়গা মূল ভূখণ্ড থেকে দূরে। এই প্রক্রিয়ার নাম দেওয়া হয় ট্রেনটিন। সেই সময় তীক্ষ্ণ নজর রাখা হবে জাহাজের যাত্রী ও নাবিকদের উপর, ব্ল্যাক ডেথের কোনও উপসর্গ দেখা যায় কিনা।
ইতিহাস বলছে, সেই ছিল প্রথম আনুষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিন। যদিও ইতালিয় ভাষায় যাঁকে বলা হয়েছিল ট্রেনটিন বা ৩০ দিন।
১৪৪৮ সালে ইতালির তৎকালীন ভেনিস প্রশাসন (ভেনেসিয়ান সেনেট) এই অপেক্ষার সময়কে ৩০ দিন থেকে বাড়িয়ে ৪০ দিন করে দেয়। ইতালিয় ভাষায় ৪০ দিন অর্থাৎ কোয়ারেন্টিন। সেই শুরু।
প্লেগ মোকাবিলায় তৎকালীন ভেনেসিয়ান সেনেটের এই সিদ্ধান্ত ব্যাপক সাফল্য পায়। ইউরোপের প্রথম শহর হিসেবে কোয়ারেন্টিন সেন্টার তৈরি করে ইতিহাসে নাম উঠে যায় দুব্রোভনিকের। কোয়ারেন্টিন সেন্টার তৈরি হয় লাজ্জারেত্তোসে। জাহাজ এলেই নাবিক ও সওয়ারিদের বমাল ৪০ দিন কাটাতে হবে দুনিয়ার প্রথম কোয়ারেন্টিন সেন্টার লাজ্জারেত্তোসে।

ইউরোপের প্রথম কোয়ারেন্টিন সেন্টার লাজ্জারেত্তোস

 

কেন ৪০ দিন? 

প্রশ্ন হল, ৪০ দিন সময় হিসেব করার কারণ কী? সেই জবাবও নথিভুক্ত আছে ইতিহাসের পাতায়। আর সেই উত্তরেই লুকিয়ে ইউরোপের প্লেগের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সাফল্য। চিকিৎসা বিজ্ঞান বলে, বুবোনিক প্লেগের ক্ষেত্রে একজন ব্যক্তির সংক্রমিত হওয়া থেকে মৃত্য, এই সময়কাল সর্বোচ্চ ৩৭ দিন। তাই ৪০ দিন সময় যদি সংক্রমিত ব্যক্তিকে সংক্রমণ ছড়ানোর সুযোগ দেওয়া না যায়, তাহলে তাঁর প্রাণের বিনিময়ে হলেও বাকিদের সুস্থ রাখা যায়।

এখনকার দুব্রোভনিক সৈকত (ক্রোয়েশিয়া)

কোভিড ১৯ অতিমারির ত্রাসে যখন কম্পমান বিশ্ব, হাতে নেই প্রতিষেধক, তখন মানুষের একমাত্র হাতিয়ার সেই বহু শতাব্দী প্রাচীন কোয়ারেন্টিন।
বুবোনিক প্লেগের ভয়াবহ প্রকোপে সমগ্র ইউরেশিয়া যখন বিশ্ব মানচিত্র থেকে মুছে যেতে বসেছিল, পথ দেখিয়েছিল দুব্রোভনি। শুরু হয়েছিল কোয়ারেন্টিন। ক্রমশ তা দিয়েই সাফল্য আসে এই রোগ মোকাবিলায়। প্রায় সাড়ে ৫০০-৬০০ বছর পর, ২০২০ সালে দাঁড়িয়ে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়েও মানব সভ্যতার অন্যতম হাতিয়ার সেই ৪০ দিনের কোয়ারেন্টিনই।

Comments are closed.