মাতৃদুগ্ধ উৎপাদন থেকে গর্ভধারণের সক্ষমতা, স্কুলে শিক্ষক নিয়োগের ইন্টারভিউয়ে আপত্তিকর প্রশ্নের মুখে রূপান্তরকামী সুচিত্রা।

১৯৮৭ সালে আমার জন্ম। লিঙ্গগত পরিচয়ের দিক থেকে বলতে গেলে, একজন পুরুষ হিসেবেই আমার জন্ম হয়। কিন্তু আমার নিজেকে পুরুষ শরীরের খাঁচার মধ্যে আবদ্ধ একজন নারী হিসেবেই মনে হতো। আমার মানসিক সত্ত্বার সঙ্গে নিজের শারীরিক সত্ত্বাকে কিছুতেই মেলাতে পারতাম না। এক ধরনের মানসিক এবং লিঙ্গগত পরিচয়হীনতা তাড়া করে বেড়াতো আমাকে।
খুব অল্প বয়সেই আমি বাবাকে হারাই। ফলে সংসার চালাতে অল্প বয়েস থেকেই প্রাইভেট টিউশন পড়িয়ে জীবিকা নির্বাহ করতে হয়েছে আমাকে। আমি লিঙ্গ পরিবর্তন করতে চাই শুনে, আমার বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে অনেকেই আমায় ঠকিয়েছে। আর্থিক সাহায্যের অছিলায় শারীরিক নির্যাতনেরও শিকার হতে হয়েছে আমাকে। হতাশা এবং ডিপ্রেসন এক সময় গ্রাস করে আমায়। এরপর একদিন সংবাদপত্রের এক লেখা থেকে আমি মানবী বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা জানতে পারি। তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করি। অস্ত্রোপচারের ব্যাপারে তিনি আমায় গাইড করেন।
সে সময় খবরের কাগজে কর্মখালি বিজ্ঞাপন দেখে ঝাঁসির একটি স্কুলে আমি আবেদন পাঠাই। স্কুলের অধিকর্তা আমার আবেদন পত্র পড়ে আমায় ইন্টারভিউয়ের জন্য ডাকেন। এরপর তাঁর সঙ্গে একদিন আমার একটি মোবাইল কলিং অ্যাপের মাধ্যমে কথাও হয়। আমার সমস্যা ও ইচ্ছার কথা জানতে পেরে তিনি বলেন, তাঁর এক আত্মীয় দিল্লির নাম করা সার্জেন। তিনি এই ধরনের অস্ত্রোপচার করে থাকেন। এর জন্য ৮০ হাজার টাকা লাগবে। আমি নিজের লিঙ্গ পরিবর্তনের জন্য এতটাই মরিয়া ছিলাম যে, এই প্রস্তাবে আমি রাজি হয়ে যাই। বহু কষ্টে তিল তিল করে জমানো টাকা নিয়ে পাড়ি দিই দিল্লি।
অস্ত্রোপচারের দিন দশেক পর আমি কলকাতায় ফিরে আসি এবং পিয়া আচার্য নামের এক বন্ধুর সঙ্গে থাকতে শুরু করি। একদিন হঠাৎ আমার অস্ত্রোপচারের জায়গা থেকে রক্ত বেরনো শুরু হয়। পরিস্থিতি এতটাই খারাপ হয় যে আমার সেই বান্ধবী বন্ডে সই করে আমাকে হাসপাতালে ভর্তি করে। পিয়ার জন্যই আমি আজও বেঁচে আছি। এরপর মনোজ খান্না নামের আর একজন চিকিৎসক আমাকে পরীক্ষা করে জানান, দিল্লিতে অস্ত্রোপচারের নামে আমার সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে। পরে আমি দিল্লির ওই চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলে তিনি আমার ফোন ধরেননি এবং হোয়াটস অ্যাপেও আমাকে ব্লক করে দেন।
আমি কী করব ভেবে পাচ্ছিলাম না। আমার জীবনের সমস্ত সঞ্চয় দিল্লির ওই অস্ত্রোপচারের জন্য আমি দিয়ে দিয়েছিলাম। আমি পরিবারকেও এ বিষয়ে আমি কিছু জানাইনি। আমার মা’ও এই অস্ত্রোপচারের বিষয়ে কিছু জানতেন না। যদিও পরিবারের মধ্যে একমাত্র মা’কেই আমি আমার এই লড়াইয়ে পাশে পেয়েছিলাম। পরিবারের বাকি সদস্যরা আমায় নিয়ে হাসি-ঠাট্টাই করত। এরপর ডাঃ খান্না এবং ডাঃ শশাঙ্ক চট্টোপাধ্যায় পুনরায় আমার অস্ত্রোপচার করেন এবং সু্চিত্রা দে নামে আমার পুনর্জন্ম হয়।
বি এড করা ছাড়াও, ইংরেজি এবং ভূগোলে আমি ডবল এম এ করেছি। আমি একটি বেসরকারি স্কুলে পড়াই। পাশাপাশি, আরও ভালো সুযোগের জন্য বিভিন্ন স্কুলে আবেদন পত্রও পাঠাই। মাঝে মাঝেই বিভিন্ন স্কুল আমায় ইন্টারভিউয়ের জন্য ডাকেও। সম্প্রতি আমি জোকা এবং ঠাকুরপুকুর অঞ্চলের কয়েকটি আইসিএসসি স্কুলে ইন্টারভিউয়ের জন্য যাই। প্রায় সবকটি স্কুলেই আমায় এমন কিছু প্রশ্ন করা হয়, যাতে আমি বিব্রত ও অপমানিত বোধ করেছি। আমার পড়াশোনা ও যোগ্যতার বিষয়ে প্রশ্ন না করে একাধিক অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন করা হয় আমাকে। যেহেতু বিভিন্ন রেজাল্ট এবং সার্টিফিকেটে আমার নাম পুরুষ হিসেবে রয়েছে, তাই আমাকে ছেলেদের পোশাক পরতে বলা হয়। কিন্তু আমি কেন সেই পোশাক পরব? আমি নিজের অতীতকে অস্বীকার করছি না, কিন্তু বর্তমানে তো আমি আর পুরুষ নেই। তাহলে কেন পরব?
এমনকী একটি স্কুলের প্রিন্সিপাল (পুরুষ) যাবতীয় শালীনতা বিসর্জন দিয়ে আমায় প্রশ্ন করেন, যৌন মিলনের পর আমি গর্ভধারণে সক্ষম কিনা? এমনকী আমার স্তন দুগ্ধ উৎপাদনে সক্ষম কিনা সেই প্রশ্নও শুনতে হয়েছে আমাকে। একজন শিক্ষক হয়ে এবং এতও যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও যদি আমাকে এই ধরনের প্রশ্নের সন্মুখীন হতে হয়, তবে যাঁরা কোনও দিন স্কুলে যাননি তাঁদের কী অবস্থা হচ্ছে প্রতিদিন?
এ বিষয়ে বিচার চেয়ে আমি রাজ্য মানবাধিকার কমিশনকে চিঠি লিখেছি। রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান বিষয়টি বিবেচনার আশ্বাস দিয়েছেন।

Leave A Reply

Your email address will not be published.