পুতুলনাচ’কে বাঁচিয়ে রাখতে একাধিক উদ্যোগ কলকাতার ডলস থিয়েটারের

পশ্চিমবঙ্গসহ ভারতের প্রাচীন শিল্পকলাগুলির মধ্যে অন্যতম ‘পুতুল নাচ’, যা বিদেশে ‘পাপেট শো’ নামেও পরিচিত। সঠিক তথ্য পাওয়া না গেলেও এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত অনেকেই মনে করেন ভারতের মাটিতেই এর উৎপত্তি। পশ্চিমবঙ্গে পুতুল নাচ হিসেবে পরিচিত হলেও, দেশের অন্যান্য রাজ্যে আরও বেশ কয়েকটি আঞ্চলিক নাম রয়েছে এই আর্ট ফর্ম’টির। যেমন রাজস্থানে একে ‘কাঠপুতলি’ এবং কেরলে ‘থোলপাভাকুঠু’ নামে ডাকা হয়। কিন্তু একদিকে বিশ্বায়নের প্রভাব, অন্যদিকে মানুষের সচেতনতার অভাবে আজ দেশের এই প্রাচীন শিল্পকলাটি প্রায় লোকচক্ষুর আড়ালে বলা চলে। তবে এখনও বেশ কিছু সংস্থা এবং ব্যক্তি নিজ উদ্যোগে এই শিল্পকলাটি বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা চালাচ্ছেন। যাদের মধ্যে অন্যতম কলকাতার ডলস থিয়েটার।


ডলস থিয়েটারের কর্ণধার সুদীপ গুপ্ত জানিয়েছেন, প্রথমে মূলত ব্যক্তিগত আগ্রহ থেকেই তিনি এই শিল্পকলাটির প্রতি আকৃষ্ট হন। ১৯৮৩ সালে যোগ দেন কলকাতা পাপেট থিয়েটরে।পরে এই শিল্প কলাটিকে বাঁচিয়ে রাখার তাগিদেই তিনি ডলস থিয়েটার তৈরি করেন। ১৯৯০ সালে পথ চলা শুরু হয় এই থিয়েটরের। যার বর্তমান কার্যালয় কলকাতার সেলিমপুর। এই মুহূর্তে ৭-৮ টি প্রডাকশন চলছে এই গোষ্ঠীর। ডলস থিয়েটারের সঙ্গে ১০-১১ জন শিল্পী যুক্ত রয়েছেন। সুদীপবাবু জানিয়েছেন, বিভিন্ন সামাজিক বার্তা তাঁরা পুতুল নাচের মাধ্যমে দিয়ে থাকেন। তাদের প্রোডাকশনের মাধ্যমে একদিকে যেমন পণপ্রথা বা গাছ কাটার বিরুদ্ধে বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। তেমনি বাচ্চাদের জন্য বিভিন্ন রূপকথার গল্প পুতুলের মাধ্যমে মঞ্চস্থ করেও দেখানো হয়। কলকাতার পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এবং বিদেশেও শো করে থাকে ডলস থিয়েটর। গ্লাভস, স্ট্রিং, রড এবং শ্যাডো মূলত এই চার প্রকারের পুতুল নাচ বিশ্বজুড়ে প্রদর্শিত হয়ে থাকে। সুদীপবাবু জানিয়েছেন, চলতি বছরের নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে কলকাতায় তারা একটি পাপেট ফেস্টিভালের আয়োজন করতে চলেছেন। সেখানে রাজস্থান, কেরালা, দিল্লি, ওড়িশা থেকে বিভিন্ন গোষ্ঠী অংশ নেবে।

তবে এই প্রাচীন আর্ট ফর্ম-এর ব্যাপারে জনসাধারণের মধ্যে চেতনার অভাব কষ্ট দেয় সুদীপবাবুকে। তিনি জানিয়েছেন, কেন্দ্রীয় সরকার তাদের বিভিন্ন বিজ্ঞাপনে পুতুল নাচ ব্যবহার করে জনসাধারণের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছে। কেন্দ্রীয় তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রকের অধীনস্থ সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমি প্রতি বছর ‘পুতুল নাচের’ উপর ফেস্টিভালের আয়োজন করে থাকে। কলকাতার রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়েও ড্রামা কোর্সের অধীনে পুতুল নাচ নিয়ে একটি পৃথক অধ্যায় রয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও সংগীত, নাটক, সিনেমা র মতো শিল্পকলার তুলনায় অনেকটাই লোকচক্ষুর আড়ালে রয়ে গিয়েছে এই প্রাচীন এই শিল্পকলাটি। এখন সুদীপবাবুরা চেষ্টা চালাচ্ছেন দিল্লিতে সংশ্লিষ্ট আধিকারীকদের সঙ্গে কথা বলে সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমির সহায়তায় ‘পুতুল নাচের’ কোনও পাঠক্রম তৈরি করার। যা ইরানের তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে। সুদীপ গুপ্তর মতে, দেখার আগ্রহ থাকলেও বর্তমান প্রজন্ম যে এই পুতুল নাচকে পেশা হিসাবে বেছে নিতে কম উৎসাহ দেখাচ্ছে, তার মূলত দু’টি কারণ। প্রথমত, পুতুল নাচের কারিগরী শিখতে অনেক সময় লাগে, তাই অনেক ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে হয়। আর দ্বিতীয়য়, অন্যান্য আর্ট ফর্মের তুলনায় এক্ষেত্রে মূল শিল্পীকে নেপথ্যে থেকেই কাজ করতে হয়। তাই পরিচিতি বা সরাসরি লাইম লাইটে আসার সুযোগ কম। সুদীপবাবু জানিয়েছেন, পেশা হিসাবে এই লোকশিল্পে যথেষ্টই সম্ভাবনা আছে। তাঁরা নিয়মিত কেন্দ্র থেকে অনুদানও পাচ্ছেন। কলাকুশলীদের নিয়মিত পারিশ্রমিক পেতেও অসুবিধা হয় না।

Leave A Reply

Your email address will not be published.