জগদীপ ধনকড় মনে করাচ্ছেন অতীতের ধরমবীরকে, রাজভবন নবান্ন বিরোধের শেষ কোথায়?

রাজ্যপালের সঙ্গে রাজ্য সরকারের সংঘাত ভারতে নতুন কোনও ঘটনা নয়। বিভিন্ন রাজ্যেই বিভিন্ন সময়ে নানা ইস্যুতে ক্ষমতাসীন রাজ্য সরকারের সঙ্গে রাজ্যপালের সংঘাত হয়েছে এবং তা মিটেও গিয়েছে। এই রাজ্যে ৩৪ বছরের বাম জমানাতেও অনেক সময় মহাকরণ রাজভবনের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছিল। পালাবদলের পর তৃণমূল জমানাতেও যে ক’জন রাজ্যপাল এসেছেন, কোনও না কোনও সময় তাঁরা নবান্নের সঙ্গে বিতর্কে লিপ্ত হয়েছেন। তবে জুলাই মাসে রাজভবনে আসার পর থেকে পেশায় আইনজীবী, রাজস্থানের বাসিন্দা জগদীপ ধনকড়ের সঙ্গে ছোট-বড় নানা ইস্যুতে যেভাবে তৃণমূল সরকার সংঘাতে লিপ্ত হচ্ছে, তা এক কথায় নজিরবিহীন।
রাজ্যপাল একের পর এক ইস্যুতে রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে মুখ খুলে শাসক দলের মন্ত্রী-নেতাদের বিরাগভাজন হচ্ছেন। দুই তরফের মধ্যে প্রায় প্রতিদিনই চলছে কথার লড়াই। এসব দেখে শুনে, অনেকেরই ছ’য়ের দশকের শেষে যুক্তফ্রন্ট জমানার রাজ্যপাল ধরমবীরের কথা মনে পড়ছে। যেভাবে নবান্ন বনাম রাজভবন লড়াই চলছে, তাতে ভবিষ্যতে ধনকড় ধরমবীরের ফটোকপি হয়ে উঠবেন না তো? এই নিয়েও প্রশ্ন উঠছে।
এই প্রসঙ্গে একটু অতীতের দিকে চোখ ফেরানো যাক। ১৯৬৭ সালে নভেম্বর মাসে শেষে বাংলা কংগ্রেসের প্রবীণ নেতা অজয় মুখোপাধ্যায়ের যুক্তফ্রন্ট সরকারকে বরখাস্ত করে বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে আসেন রাজ্যপাল ধরমবীর। যুক্তফ্রন্ট সরকার ব্যাপক হইচই শুরু করে। অবশ্য ১৯৬৯ সালে ফের ক্ষমতায় আসে সেই যুক্তফ্রন্ট। সাংবিধানিক প্রথা অনুযায়ী, রাজ্যপাল কিংবা রাষ্ট্রপতি সরকারের তৈরি করে দেওয়া লিখিত ভাষণই বিধানসভায় বা লোকসভায় পাঠ করেন। ১৯৬৯ সালে মন্ত্রিসভা গঠনের পর, বিধানসভায় পাঠ করার জন্য তাঁকে ভাষণ তৈরি করে দিয়েছিল সরকার। সেই বিবৃতিতে লেখা ছিল, ‘আমি প্রথম যুক্তফ্রন্ট সরকার অন্যায়ভাবে ভেঙেছিলাম’। রাজ্যপাল ওই অংশটুকু বাদ দিয়েই লিখিত ভাষণ পাঠ করেন। যুক্তফ্রন্টের নেতা-মন্ত্রীরা বারবার দাবি করা সত্ত্বেও, ধরমবীর ওই অংশ পাঠ করেননি। ওই সময় নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই তাঁর সঙ্গে যুক্তফ্রন্টের বিরোধ শুরু হয়। পরে রাজ্য সরকারের চাপে তখনকার প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ধরমবীরকে সরিয়ে এস এস ধাওয়ানকে বাংলার রাজ্যপাল করে পাঠান। ১৯৭১ সালে ধাওয়ানের সঙ্গেও বামেদের বিরোধ বাধে। ওই বছর বিধানসভা ভোটে বামেরা ১৩০ টি এবং কংগ্রেস ১০৫ টি আসন পেলেও রাজ্যপাল সংখ্যালঘু কংগ্রেসকেই সরকার গড়তে ডাকেন।
জরুরি অবস্থার অবসানের পর ১৯৭৭ সালে বিপুল সরকার গরিষ্ঠতা পেয়ে রাজ্যে ক্ষমতায় আসীন হয় জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে বামফ্রন্ট। তখন রাজ্যপাল হন ত্রিভুবন নারায়ণ সিংহ। অত্যন্ত সজ্জন বলে পরিচিত ত্রিভুবন নারায়ণের সঙ্গে জ্যোতি বাবুদের সম্পর্ক ছিল খুবই ভালো। আটের দশকে রাজভবনের মালিক হন ভৈরব দত্ত (বিডি) পাণ্ডে। তখন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। ওই সময় সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক ছিলেন প্রমোদ দাশগুপ্ত। তিনি বিডি পাণ্ডের নাম দিয়েছিলেন ‘বাংলা দমন পাণ্ডে’। বামেদের অভিযোগ ছিল, তাদের শায়েস্তা করতেই ইন্দিরা গান্ধী বিডি পাণ্ডেকে রাজ্যপাল করে পাঠিয়েছেন। তবে পাণ্ডের সঙ্গে মহাকরণের তেমন কোনও বিরোধ হয়নি। পরবর্তীকালে ‘৮৪ সাল নাগাদ রাজ্যপাল হয়ে আসেন অনন্ত প্রসাদ শর্মা। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বাছাই নিয়ে শর্মার সঙ্গে চূড়ান্ত বিবাদ দেখা দেয় বামফ্রন্ট সরকারের। রাজভবনের পাঠানো উপাচার্য পদের জন্য তিনটি নামের মধ্যে সবচেয়ে অপছন্দের সন্তোষ ভট্টাচার্যকেই উপাচার্য হিসেবে বাছেন অনন্ত প্রসাদ। তারপর থেকেই রাজ্যপালের সঙ্গে বাম সরকারের বিরোধ চলতে থাকে। ১৯৯০ সালে প্রাক্তন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা প্রধান টি ভি রাজেশ্বরকে রাজ্যপাল করে পাঠানো হয় বাংলায়। তিনিও ছিলেন জ্যোতিবাবুদের অপছন্দের রাজ্যপাল। এরপর, প্রথম এনডিএ জমানার বীরেন জে শাহ-সহ অনেকেই রাজ্যপাল হয়ে এসেছেন। তাঁদের সঙ্গেও বামফ্রন্টের মোটামুটি ভালো সম্পর্কই ছিল।
২০০৭ সালে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম পর্বে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নেতৃত্বাধীন শেষ বামফ্রন্ট সরকারের সঙ্গে তুমুল বিরোধ হয় রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গান্ধীর। ওই বছরের ১৪ মার্চ নন্দীগ্রামে পুলিশ অভিযানে ১৪ জনের মৃত্যুর পর রাজ্যপাল কড়া বিবৃতি দিয়ে কোপে পড়েছিলেন বাম সরকারের। ওই বছরেরই নভেম্বর মাসে নন্দীগ্রামে সিপিএমের তথাকথিত সূর্যোদয় অভিযানকে দিওয়ালির রাতে রাজ্যপাল ‘হাড় হিম করা আতঙ্ক’ বলে লিখিত বিবৃতি দিয়েছিলেন। তা নিয়েও বামেরা তাঁর তীব্র সমালোচনা করে। মার্চ মাসে নন্দীগ্রামে ওই পুলিশি তাণ্ডবের পরে রাজ্য সরকারের সঙ্গে কোনও আলোচনা না করেই গোপালকৃষ্ণ ওইসব উপদ্রুত এলাকায় চলে গিয়েছিলেন, যা বুদ্ধবাবুরা ভালোভাবে নেননি। সিঙ্গুর বিতর্কে মমতা ব্যানার্জি যখন ধর্মতলায় অনশন করছেন, তখন গোপালকৃষ্ণ সেই অনশন মঞ্চে গিয়েও বিতর্কে ইন্ধন দেন। এমনকী সিঙ্গুরের সমস্যা মেটাতে রাজ্যপালের মধ্যস্থতাকেও পছন্দ করেননি বাম নেতারা। বুদ্ধবাবু তাঁর ‘ফিরে দেখা’ বইয়ের প্রথম খণ্ডে গোপালকৃষ্ণের ভূমিকার সমালোচনা করে লিখেছেন, ‘আমিই তাঁকে রাজ্যপাল করে নিয়ে এসেছিলাম।’
২০১১ সালে পালাবদলের পর রাজ্যপাল হন এম কে নারায়ণন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির সঙ্গে নারায়ণনের বিরোধ বাধে খিদিরপুরে একটি কলেজের গোলমালে কলকাতা পুলিশের এক এসআই তাপস চৌধুরির মৃত্যুকে ঘিরে। ওই ইস্যুতে মমতার নির্দেশে সরতে হয় কলকাতার পুলিশ কমিশনার রঞ্জিত পচনন্দাকে। রাজ্যপাল ওই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে তোপে পড়েন তৃণমূল নেতা-মন্ত্রীদের। রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠীর সঙ্গেও বসিরহাট, বাদুড়িয়া, দেগঙ্গা সাম্প্রদায়িক গোলমাল নিয়ে বিরোধ হয় তৃণমূল সরকারের। তিনি রাজ্য প্রশাসনের সমালোচনা করায় মুখ্যমন্ত্রী প্রকাশ্যে অভিযোগ করেন, রাজ্যপাল তাঁকে অপমান করেছেন।
অতীতের রাজ্যপাল-সরকার বিরোধের এই সমস্ত নজিরকেই কিন্তু ছাপিয়ে গিয়েছে বর্তমান রাজ্যপাল ধনকড়ের সঙ্গে নবান্নের বিবাদ। একেবারে প্রথম থেকেই ধনকড় একের পর এক বিতর্কিত কথাবার্তা বলে রাজ্য সরকারকে বিপাকে ফেলছেন। যাদবপুরের ছাত্র বিক্ষোভ থেকে শুরু করে হালে ফোনে আড়িপাতা এবং চলচ্চিত্র উৎসবে আমন্ত্রণ না পাওয়াকে কেন্দ্র করেও তিনি নানারকম কড়া কথা বলছেন মিডিয়ার সামনে। আর বরাবরই তাঁর দাবি, তিনি রাজ্যপালের ক্ষমতা সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবহিত থেকেই যা করার করছেন। তাঁর এসব মন্তব্যের বিরুদ্ধে তৃণমূলের মন্ত্রীরাও মুখ খুলছেন বটে। তবে তা তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হল, এখনও পর্যন্ত এসব নিয়েই মুখ্যমন্ত্রী একেবারের জন্যও টুঁ শব্দটি করেননি।
এখন প্রশ্ন হল, রাজ্যপাল কি এভাবেই নবান্নের সঙ্গে বিরোধ চালিয়ে যাবেন? বিধানসভায় আগামী বাজেট অধিবেশনে সরকারের তৈরি করা ভাষণই তিনি পাঠ করবেন তো? নাকি তার বাইরে গিয়ে জগদীপ ধনকড় ধরমবীর হবেন?

Comments are closed.